প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
ঋতু পরিবর্তনে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্ম হলেও বাস্তবে চৈত্র হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত তীব্র গরম পড়ে। আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে এই গরমে ঘাম হয় প্রচুর। সারা দেহ ঘামে ভিজে জবজব অবস্থা। শরীর আঠালো হয়ে উঠে। সাদা ছোপ ছোপ লবণের দাগ পড়ে এবং প্রকট গন্ধ হয়। ঘর্মাক্ত মানুষের এক অস্বস্তির সূচনা হয়। গরমের তীব্র দাপটে ঘামের এই নহর নিয়েই আজকের সাতকাহন।
ঘাম কী?
স্তন্যপায়ী প্রাণীর ত্বকে অবস্থিত কতিপয় ঘর্মগ্রন্থি হতে নিঃসৃত তরলকে বলা হয় ঘাম। মানবদেহে দুই ধরনের ঘর্মগ্রন্থি পাওয়া যায়। ইক্রাইন গ্রন্থি এবং অ্যাপোক্রাইন গ্রন্থি। ইক্রাইন স্বেদগ্রন্থিই সারা দেহে বিস্তৃত।
ঘামের কারণ কী?
আসলে ঘামানো হচ্ছে দেহের তাপসাম্য রক্ষা করার একটা বড় উপায়। জলীয় অংশপ্রধান নিঃসৃত তরল বা ঘামের মাধ্যমে ইক্রাইন গ্রন্থি তাপসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে।
দৈনিক ঘাম উৎপাদনের হার
অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি ঘণ্টায় ২-৪ লিটার ঘাম তৈরি করে যা ১০-১৪ লিটার প্রতিদিন। বয়ঃসন্ধির বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তা কিছুটা কম। বাষ্পীভবনের কারণে ঘাম শুকানোর কালে দেহ হতে লীন তাপ গ্রহণ করে বিধায় ওই অংশ শীতল বোধ হয়। অতিরিক্ত ঘাম নিঃসরণকে হাইপার হাইড্রোসিস বলে। হাইড্রোমিয়োসিস হলো ঘাম হ্রাস পাওয়া।
ঘামের উপাদান
ঘামের উপাদান মূলত পানি। তার সাথে ০.২-১% কঠিন দ্রব। এতে থাকে খনিজ, ল্যাকটিক এসিড, ইউরিয়া। খনিজ পদার্থের মধ্যে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, কপার, আয়রন, ক্রোমিয়াম, নিকেল, লেড ইত্যাদি। ঘামের প্রকৃতি কিছুটা এসিডিক।
ঘামের ব্যবহার
ড্যানিয়েল সি বয়্যার নামে এক চিত্রশিল্পী ঘামের মধ্যে গুয়াশে রঙ মিশিয়ে পেইন্টিং তৈরি করেন।
ঘামের কুফল
ঘামের ফলে দেহে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। ত্বকে জমে থাকা ঘামের সাথে বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণে ঘামে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। অতিরিক্ত ঘাম উৎপাদনকারী ত্বকগুলো ফেটে যায় এবং চামড়া শুষ্ক হয়ে যায়।
ঘামের বিভিন্ন গন্ধ ও বর্ণ
কিছু কিছু খাবার ও ঔষধের কারণে ঘামের উৎকট গন্ধ হয়। কিডনী ফেইলিওর, ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসে ঘামের গন্ধ বিশেষভাবে প্রকট হয়।
ঘাম সাধারণত বর্ণহীন। তবে যে সকল স্থান হতে অধিক ঘাম নিঃসৃত হয় ওই সব স্থান গোলাপী বা সাদা হয়ে যায়।
কতিপয় শারীরবৃত্তীয় অবস্থা ও ঘাম
মহিলাদের রজঃনিবৃত্তিতে ঘামের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ভয়, আতঙ্কে দেহের অ্যাড্রেনাল গ্লান্ড হতে এপিনেফ্রিন ও নর এপিনেফ্রিন হরমোন নিঃসৃত হয় যা ঘাম উৎপাদন করে। জ্বরে, রাগে, ক্ষোভে ঘাম উৎপন্ন হয়। অতিরিক্ত ব্যায়াম, শারীরিক কসরতে ঘাম উৎপন্ন হয়।
ঘাম উৎপাদনকারী কতিপয় রোগ
* হাইপারথাইরয়েডিজমে অতিরিক্ত ঘাম হয়।
* কোনো স্থানে পুঁজসহ ফোঁড়া হলে কেঁপে কেঁপে জ্বর হয় ও ঘাম হয়।
* যক্ষ্মা রোগী, নিউমোনিয়া রোগী রাতে প্রচুর ঘামায়।
* ম্যালেরিয়া কিংবা ভাইরাস জ্বর হলেও তীব্র ঘাম দেখা দেয়।
* হাটের মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশানে চিকন ঘাম হয়।
* হাইপোগ্লাইসেমিয়াতেও ব্যক্তি প্রচুর ঘামায়।
* সেপ্টিসেমিয়া হলে তীব্র জ্বরে রোগী ঘামাতে পারে।
* ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, মরফিন সেবন করলেও ঘাম হয়।
* অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিতে টিউমার হলে প্রচুর ঘাম দেয়।
* মার্কারী বিষক্রিয়ায় অতিরিক্ত ঘাম হয়।
* কারও কারও দেহের শীতলন প্রক্রিয়া এমন যে তারা প্রচুর ঘাম উৎপন্ন করে দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে।
অতিরিক্ত ঘাম নিয়ন্ত্রণের উপায়
* বিষণœতা দূর করা, প্রফুল্ল থাকা
* রাগ, উত্তেজনা পরিহার
* যে রোগের কারণে ঘাম হয় সেই রোগের চিকিৎসা করানো এবং ঘামের কারণ উৎপাটন করা।
* অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ঔষধ সেবনে কিছুটা ঘাম কমতে পারে।
* অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ সেবনেও ঘামের মাত্রা কমে।
* বগলের নীচে রোল অন বা ঘামনিরোধী বডি স্প্রে ব্যবহার করে ঘাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ঘামের দুর্গন্ধ প্রতিকারের উপায়
* প্রতিদিন নিয়মিত গোসল করা।
* যারা বেশি ঘামান তারা দিনে দুইবার গোসল করা।
* গোসলে ডেটল সোপ জাতীয় অ্যান্টিসেপ্টিক ব্যবহার করা।
* অ্যান্টি পারস্পিরেন্ট সুগন্ধী ব্যবহার করা ও ডিওডরেন্ট ব্যবহার করা।
ঘামের কারণে দুর্বলতা প্রতিকার
যারা অতিরিক্ত ঘামান তারা অতি দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন পানিশূন্যতার কারণে। তাই তারা নিয়মিত ওরাল স্যালাইন, ডাবের জল, রসালো ফল খেতে পারেন। প্রচুর পরিমাণ তরল পানীয়, লেবুর শরবত খেতে পারেন। অন্যথায় বেশি ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন শিরায় দেয়া যেতে পারে।