সোমবার, ৩০ জুন, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে বিএনপি অফিস ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মামলায় সাবেক এমপি প্রতিনিধি নিরু আটক

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ০৮:৫১

বাঙালি সাহিত্যিকের রোগের পাঠ

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বাঙালি সাহিত্যিকের রোগের পাঠ

প্রয়াত বাঙালি সাহিত্যিকদের জীবনে রোগ ও রুগ্নতার ধরন কেমন ছিল তা নিয়ে পাঠক মাত্রেরই কৌতূহল অপরিসীম। এ বিষয়ে নিবিড় পাঠের প্রয়াসে তিরিশ জন সাহিত্যিকের জীবন-সংশ্লিষ্ট রোগের হদিশ নেওয়া হয়। তিরিশ জন সাহিত্যিকের মধ্যে একজন নারী, উনত্রিশ জন পুরুষ। তাঁদের একজন আবার স্বয়ং চিকিৎসক। দুজন আছেন প্রতিষ্ঠিত চিত্র পরিচালক এবং নজরুলকে সহ ধরলে তিনজন। তিরিশ জনের মধ্যে ষোলজন কবি এবং চৌদ্দজন গদ্যশিল্পী। আবার ষোলজন কবির মধ্যে কয়েকজন যুগপৎ গদ্যশিল্পীও বটে। এঁদের রোগের পাঠ নিতে গেলে প্রথমেই আসে রোগের ধরন। তাঁদের রোগের ধরন বিভিন্ন রকম। যেমন :

ক. জীবাণুঘটিত সংক্রমণযোগ্য রোগ যেমন : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালাজ্বর, সুকান্তের যক্ষ্মা, শামসুজ্জামানের করোনা, বুদ্ধদেবের মায়ের ধনুষ্টংকার, জসীমউদদীন-সংশ্লিষ্ট কলেরা, শহীদ কাদরীর নিউমোনিয়া ইত্যাদি।

খ. জীবাণুঘটিত কিন্তু সংক্রমণযোগ্য নয় যেমন : রবীন্দ্রনাথের ইরাসিপিলাস।

গ. অনাল গ্রন্থি বা হরমোনজনিত রোগ যেমন : বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুমূত্র বা ডায়বেটিস, আব্দুল মান্নান সৈয়দের হাইপোগ্লাইসেমিয়া ইত্যাদি।

ঘ. জীবনাচরণ সংশ্লিষ্ট রোগ যেমন : মাইকেল মধুসূদন দত্তের লিভার সিরোসিস, বনফুলের ব্রেন স্ট্রোক, সত্যজিত রায়ের হার্ট অ্যাটাক, আসাদ চৌধুরীর রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বার্জার্স ডিজিজ ইত্যাদি।

ঙ. বার্ধক্যজনিত রোগ যেমন : ড. আনিসুজ্জামানের প্রোস্টেট গ্রন্থি বৃদ্ধি, আল মাহমুদের বার্ধক্যজনিত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ইত্যাদি।

চ. কিছু কিছু রোগ দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত হয়। যেমন : শামসুর রাহমানের গ্লুকোমা, সমরেশ মজুমদারের সিওপিডি।

ছ. স্নায়ুতন্ত্র সংশ্লিষ্ট রোগ যেমন : নজরুলের পিক’স্ ডিজিজ, সুনীলের অ্যানোরেক্সিয়া, সৈয়দ মুজতবা আলীর প্যারালাইসিস ইত্যাদি।

জ. কিছু কিছু রোগ আছে শৈশবের। যেমন : বঙ্গবন্ধুর বেরিবেরি, আবুল হাসানের রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর।

ঝ. কয়েকজন সাহিত্যিক ভুগেছেন ক্যান্সারে। যেমন : জাহানারা ইমাম, হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ।

ঞ. মানসিক রোগ যেমন : জীবনানন্দের বিষণ্নতা।

ট. মস্তিষ্কের অসুস্থতা যেমন : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃগীরোগ বা এপিলেপ্সি।

ঠ. কেউ কেউ ভুগেছেন শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বিকলতায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহান একুশের সঙ্গীত রচয়িতা বরেণ্য সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি কিডনির বৈকল্যে ভুগে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন।

তাঁদের কেউ কেউ শৈল্য চিকিৎসার ভয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ না হয়ে বিকল্প চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ সর্বাগ্রে। কেউ কেউ দারিদ্র্যের কারণে চিকিৎসায় অবহেলার শিকার হয়েছেন। এই তালিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকান্ত অগ্রগণ্য। কবি নজরুলের চিকিৎসায় রোগ নিরূপণে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে। এর ফলে সুচিকিৎসা সম্ভব হয়নি। নিঃসঙ্গতা ও দারিদ্র্য জীবনানন্দের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করেছিলো। এতে অকালে বিষণ্নতায় ঝরে যায় একটি মূল্যবান জীবন। অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান যেমন মধুকবির লিভার সিরোসিসের কারণ তেমনি অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে বার্জার্স ডিজিজে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিলো। কেউ কেউ করোনা অতিমারির শিকার (শামসুজ্জামান খান) আবার কেউ কেউ অর্থ-বিত্তশালী হয়েও ক্যান্সারের হাত থেকে রেহাই পাননি (হুমায়ূন আহমেদ, জাহানারা ইমাম, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ)। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে যে সময় বিভূতিভূষণ মারা যান সে সময় এর উপযুক্ত প্রতিকার ছিল না। এখন হলে তিনি হয়তো কালাজ্বরে মারা যেতেন না। আবার আজকের যুগে হলেও সুকান্ত ভট্টাচার্যকে হয়তো যক্ষ্মায় এত সহজে মরতে হতো না। যাপিত জীবনের নানা টানা পোড়েন সাহিত্যিকদেরও ছুঁয়ে যায় বলেই সাহিত্যিকরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হন সহজেই। অন্যের জীবন-মনকে প্রফুল্ল রাখার কাজ সাহিত্যিকরা ঠিকমতো করলেও নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বেলায় তারা ততো মনোযোগী নন। এ কারণেই সময়ের সমস্যা সময়ে সমাধান হয় না, অন্তিমে গিয়ে টানাটানি।

দুয়েকজনের জীবনাচরণ থেকে এটাও বুঝা যায়, কেবল সচেতন ও সুশৃঙ্খলিত জীবনযাপন করলেই হয় না, বরং রোগের হদিশ প্রাথমিক স্তরে পাওয়া দরকার। তাহলে বরং জীবনের ব্যাপ্তি বর্ধিষ্ণু হওয়ার সুযোগ থাকে। বাঙালির ঈশ্বর তথা বিদ্যাসাগর কোনরূপ কু-অভ্যাসগ্রস্ত না হওয়ার পরও রেহাই পাননি ক্যান্সারের আঘাত থেকে।

আলোচিত সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিণত বয়স পেয়েছেন। যেমন : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. আনিসুজ্জামান, আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ। সবচেয়ে কম বয়সে প্রয়াত হয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং আবুল হাসান।

দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন জীবনানন্দ আবার ঘাতকের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাক মারা গেছেন কাজী নজরুল আর নিশ্চল মারা গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রবাসে মারা গেছেন জাহানারা ইমাম, শহীদ কাদরী, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ। বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হয়ে মারা যান জীবনানন্দ।

আলোচ্য গ্রন্থভুক্ত প্রয়াত বাঙালি সাহিত্যিকরা জীবনে একাধিক রোগের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। অনেকের মৃত্যু আলোচিত রোগে না হলেও তিনি ঐ রোগে ভুক্তভোগী ছিলেন। কবি জসীমউদদীন দেশে যেমন পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তেমনি প্রবাসে জার্মানিতে গিয়েও রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিছুদিন। বিভূতিভূষণের মৃত্যুর সাথে যেমন রয়েছে রহস্যময় অলৌকিক ঘটনার সংশ্লিষ্টতা তেমনি কারও কারও রোগে ভুগে মৃত্যু মানব সভ্যতার অসহায়ত্বকে তুলে ধরে। তারপরও বাঙালির সাহিত্যের আকাশগঙ্গায় যাঁরা জ্বলছেন নক্ষত্র হয়ে, তাঁদের কয়েকজনের বরাতে আমরা কিছু রোগ সম্পর্কে পাঠ গ্রহণ করতে পারলাম, এটাই বা কম কীসে?

বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের জয় হোক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়