প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০
একটা সময় ছিলো, খুব বেশি না হলেও ফরিদগঞ্জ সদরস্থ এআর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হাতে গোণা যে ক’টি ফুটবল কিংবা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো, তাতে উৎফুল্লতা থাকতো বেশ। স্থানীয় ক্রীড়ামোদী দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা নিজেদের সামর্থ্যরে প্রমাণ রাখতে পারতো। সে সময়ে ব্যতিক্রম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিলো স্থানীয় ক্লাবের আয়োজনে ছোটদের নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন। এছাড়া বছরের দুটি ঈদকে উপলক্ষ করে নাইট মিনি ক্রিকেট, স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে ফরিদগঞ্জ প্রিমিয়ার লীগ আয়োজন, বিভিন্ন সময়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বড় পরিসরে প্রীতিম্যাচ কিংবা একদিনের টি-২০ ম্যাচ আয়োজন ছিলো নিয়মিত কর্মকাণ্ডের অংশ। কালক্রমে সব যেন হারিয়ে গেছে অদৃশ্য এক অপশক্তির প্রভাবে।
উপজেলা সদরে এখন ক্রীড়া আয়োজন বলতে বোঝায় সরকারি দু-একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন, আর বিকেলে স্থানীয় যুবকদের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, এতেই শেষ।
উঠতি বয়সি শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্যে গত কয়েক বছর আগের আয়োজনগুলো যেন অনেকটা স্মৃতির মতোই। স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গন কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কাছে কতটা অসহায় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, চলতি বছরের শুরুতে ২২ জানুয়ারি হাঁক-ডাক দিয়ে একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের ঘোষণা আসলেও উদ্বোধনের ঠিক আগ মুহূর্তে কোনো এক ইঙ্গিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। বছরের ৭ মাস কেটে গেলেও সে টুর্নামেন্টের কোনো কর্মকাণ্ড আলোর মুখ দেখেনি। ফরিদগঞ্জ কিশোর একাডেমির আয়োজনে মিনি ক্রিকেটের আয়োজন হলেও তা বছরে মাত্র একটা। যার পরিসর একান্ত ইনডোর ক্রিকেটের মতোই।
প্রতিবেদনে পূর্বে যতগুলো আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবক’টিই স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠন ইত্যাদি স্পোর্টস্ ক্লাব, বর্তমান ফরিদগঞ্জ স্পোর্টস্ ক্লাবের কল্যাণেই আয়োজন করা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্লাবটির সক্রিয় কর্মকাণ্ড কিছুটা থমকে যাওয়ায় পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরস্থ ক্রীড়াঙ্গন। তবে এ অঞ্চলের ক্রীড়াপাগল মানুষদের প্রশ্ন, কেনো ক্লাবকর্তাদের এমন স্থবিরতা, কী এমন অপশক্তির থাবায় আয়োজন হয় না বড় কোনো ক্রীড়া আয়োজন।
উপজেলা সদরের এমন অবস্থায় বিপরীতে একই উপজেলা সদরের বাইরের ১৫নং রূপসা উত্তর ইউনিয়নে নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হচ্ছে উপজেলার সবচেয়ে বড় ও সফলতম ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ‘রূপসা গোল্ড কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’। এছাড়া ৭নং পাইকপাড়া উত্তর ইউনিয়নের ‘পাইকপাড়া গোল্ড কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’, ৯নং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের ‘নয়ারহাট প্রিমিয়ার লীগ’ এবং ১৬নং রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের গৃদকালিন্দিয়ার মৌলবী আয়ুব আলী খান স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বছরের বিভিন্ন সময়ে ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আরো বেশ ক’টি আয়োজন সাড়া ফেলেছে। উপজেলা সদরের বাইরে এমন বড় পরিসরে সফলতম আয়োজন হলেও সদরের মাঠটিতে কেন নয়?
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ সদরের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ফরিদগঞ্জ স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জিয়াউর রহমান জিয়া জানান, পূর্বে উপজেলার ক্রীড়াঙ্গনের উৎসবমুখরতা থাকাটা আমাদের সকলের জন্যেই ছিলো আনন্দের এবং একই সাথে গর্বেরও। বেশ ক’বার চেষ্টার পরও নানা জটিলতার তোপে পড়ে বড় টুর্নামেন্ট থেকে পিছু হটতে হয়েছে। সবশেষে আমরা ঘোষণা দিয়েও একটা বড় টুর্নামেন্টে আয়োজন করতে পারিনি। তবে বয়সভিত্তিক ছোটদের যে টুর্নামেন্টেগুলো আয়োজন হতো, সেগুলো আয়োজন না করার পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে যতজনকে নিয়ে একটা টুর্নামেন্টে করা যায়, এখন আর আগের মতো অল্প বয়সী কিশোরদের মাঠে সে পরিমাণ আসতে দেখা যায় না। স্থানীয় ক্রীড়ার উন্নয়নে ক্রীড়া সংগঠকদের পাশাপাশি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যতিক্রমী কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়াও দরকার।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নুরুন্নবী নোমান জানান, করোনার কারণে শুধু আমাদের ফরিদগঞ্জেই নয়, সারাদেশের ক্রীড়াঙ্গন স্থবির হয়ে পড়েছে। সেজন্যে ক্রীড়া অনেকটা উৎসবমুখরতা হারিয়েছে। পূর্বে মাঠে যে বড় আয়োজনগুলো হতো, সেগুলোর অনেকটাই নির্ভর করতে হতো স্পন্সরের ওপর। সে সময়কালে একটা টুর্নামেন্টে লক্ষাধিক টাকা বাজেট থাকলেও খুব সহজে স্পন্সর পাওয়া যেতো, বর্তমান সময়ে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। পলিটিক্যাল নানা ইস্যুর কারণে অনেক সময় এমন আয়োজন করাটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ এবং স্কুল টুর্নামেন্ট ব্যতীত স্থানীয়ভাবে এরকম টুর্নামেন্ট আয়োজনে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারিভাবে উপজেলা পর্যায়ে কোনো বরাদ্দই আসে না। বছরের বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে যে প্রীতিম্যাচ আয়োজন করা হয় তা উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ব্যবস্থাপনায় হয়ে থাকে। আমরা উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার একাধিক মিটিংয়ে ক্রীড়া উৎসবের মুখরতা ফিরিয়ে আনার জন্য করণীয় বিষয়ে আলোচনা করেছি। টুর্নামেন্টে আয়োজনের জন্যে পরিবেশ এবং স্পন্সর পেলে আমরা ইউনিয়ন ভিত্তিক বড় কোনো টুর্নামেন্টে আয়োজনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
ক্রীড়াঙ্গনের এমন স্থবিরতার বিষয়ে স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠন ফরিদগঞ্জ স্পোর্টস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সজিব বলেন, যখনই বড় কোনো আয়োজন হাতে নেয়া হয়, তখনই রাজনৈতিক কোনো না কোনো পক্ষের অদৃশ্য থাবায় সেটি বাস্তবায়নের মুখ দেখে না। ছোটদের নিয়ে পূর্বে যে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন করা হতো, সেই ছোটরাই তো এখন মাঠমুখী নয়। আগে যেমন ছোটরা মাঠে বড়দের সাথে খেলার বায়না ধরতো, এখন সেই একই বয়সী ছেলেগুলোকে বিকেলে মাঠে খুব একটা দেখা যায় না। হাতে গোণা যে ক’জন মাঠে আসে, তারাও মাঠের এক পাশে বসে কোনো একটা মোবাইল গেমস কিংবা ফেসবুকিংয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা ক্লাব কর্তারা বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করবো কাদের নিয়ে? ইন্টারনেটের অধিক ব্যবহার তরুণদের মাঠবিমুখ করছে।
ফরিদগঞ্জ স্পোর্টস্ ক্লাবের দায়িত্ব পালন করা ক্লাবের সাবেক এক সাধারণ সম্পাদক চাঁদপুর কণ্ঠের এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় জানান, সরকারি টুর্নামেন্টে ব্যতীত এ অঞ্চলে ক্রীড়া মুখরতা নেই বললেই চলে। এর জন্য স্থানীয় ক্লাবের নিষ্ক্রিয়তা যেমনিভাবে কিছুটা দায়ী, একই সাথে বড় কোনো সফল টুর্নামেন্টের আয়োজনে রাজনীতির রোষানলও দায়ী। বলা যায়, এই রোষানল একটি প্রতিবন্ধকতার নাম। অতীতে উপজেলা সদরস্থ এআর পাইলট মডেল পাইলট হাইস্কুল মাঠে বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ক্লাব কর্তাদের বহু প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। টুর্নামেন্ট পরিচালনায় বড় অংকের অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতির শর্তে টুর্নামেন্টের ফাইনালে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান শেষে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনাও আছে বেশ। এতে ক্লাব কর্তাদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে শেষ করতে হয়েছে সেই টুর্নামেন্ট- এমন দৃষ্টান্তও আছে। মাঠে নিয়মিত খেলা ফিরলে প্রজন্ম উপকৃত হবে। সেখানে প্রজন্মকে সুপথে এগিয়ে নিতে রোষানল নয়, বরং স্থানীয় ক্লাবগুলোর কর্মকাণ্ডগুলোকে জনপ্রতিনিধিরা একান্ত আপন করে নেয়া দরকার। এ ব্যাপারে অবশ্যই স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠকদের নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
অদৃশ্য সকল অপশক্তিকে দূর করে স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠকদের আরো অধিক দায়িত্বশীল মনোভাবের মধ্য দিয়ে আবারো ক্রীড়া উৎসবে মেতে থাকবে ফরিদগঞ্জ সদরস্থ ক্রীড়াঙ্গন-এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় খেলোয়াড় এবং ক্রীড়ামোদী দর্শকদের।