প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে ধূমকেতু সহজে আসে না। মাঝে মাঝে আসে। সব সময় দেখাও যায় না। যখন ধূমকেতু সূর্যের কাছ দিয়ে যায় তখনই ওরট মেঘের আকর্ষণের কারণে তাকে ‘কমা’র মতো দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে নজরুলকে অনেকেই ধূমকেতুর সাথে তুলনা করেছেন। ধূমকেতু যেমন হঠাৎ আবির্ভাব হয়, বিপুল শক্তি ধরে, তেমনি নজরুলও হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে বিপুল প্রাণশক্তিতে মাতিয়ে বেড়াতেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নজরুলকে সেরকম এক বিপুল শক্তিমান ধূমকেতু বলেই মনে হয়। ১৯১০ সালে আবিষ্কৃত হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে কবি নজরুল নিজেও কবিতা লিখেছেন। ধূমকেতু কবিতায় তিনি নিজের আগমনের হেতু বর্ণনা করে বলেছেন, ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লবহেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!’
তখন যে স্রষ্টার শনি বা দুর্ভাগ্য বাহকরূপে তিনি নিজেকে মহাকাল বলেছেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না মোটেও, এই স্রষ্টা ছিল ব্রিটিশরাজ, যারা এই বাংলার মানুষের বেদনার কারণ হয়ে শাসন চালিয়ে যাচ্ছিল।
ভারততত্ত্বের লেখক আলবেরুনির লেখায় ধূমকেতু ছিল তৎকালীন সমাজের কাছে পূর্বজন্মের কর্মফলের রূপ। তাই গৃহবাসী যারা ছিল তারা ধূমকেতু দেখলেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসতো শিশুদের হাত ধরে। কিন্তু নজরুল যে ‘ধূমকেতু’ কবিতা রচনা করেছিলেন তা ছিল ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপানোর পূর্ববাণী। ইংরেজি ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি যে পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ পায় তার নামও ছিল ‘ধূমকেতু’। সময়ের হিসেবে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্ট মাস ‘ধূমকেতু’ কবিতা ও কবিতাকে বুকে ধারণকারী ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার শতবর্ষ। পরবর্তী সময়ে ১৯২২ সালের অক্টোবরে ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি বারোটি কবিতার অন্যতমরূপে অমর কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় মলাটবদ্ধ হয়। প্রথম প্রকাশের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে এখনও আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নজরুলের ‘ধূমকেতু’ কবিতায় বর্ণিত অবস্থার মতোই রয়ে গেছে।
কবি যে পুনঃ বিপ্লবের ডাক দিয়ে গেছেন, সে বিপ্লবের জন্যে বাঙালি জাতির জনক বলে গিয়েছিলেন, 'আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না।' কিন্তু শতবর্ষের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা আজও দেখছি, শোষিতের মুক্তি দুনিয়ার কোথাও পূর্ণাঙ্গ অর্জিত হয়নি। বিশ্ব মোড়ল এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কারণে অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ আজও আকাশে-বাতাসে প্রকম্পিত করে ধ্বনিত হয়। কবি সর্বদর্শী বলেই শতবর্ষ আগে বসে এ কথা জানতে পেরেছিলেন অন্তরে। তাই তাঁর কণ্ঠ হতে বের হয়ে আসে সাত জনমের আক্ষেপ,
‘সাত সাতশো নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে,
মম ধূমণ্ডকুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।’
নিপীড়িতের বেদনাকে আপন বক্ষে ধারণ করে কবি যে শোষিতের মুক্তিবাণী নিয়ে এসেছিলেন, সে শোষিতের সঙ্কটে কবি ক্রোধের আগুনে স্বয়ং প্রজ্বলিত। কবি তাই শেষমেষ নিজেই নিথর ঈশ্বরের নীরবতায় বিদ্রোহ করে নিজের দুঃখণ্ডমুক্তির লক্ষ্যে বলেন,
‘আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!
তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!’
‘ধূমকেতু’ কবিতার দীর্ঘ দেহকে ধারণ করে যে পত্রিকাটি সম্পাদক নজরুলের পরিচয়কে তুলে ধরেছিল, সে পত্রিকাটির নামও যে ‘ধূমকেতু’ হবে তা আর ব্যতিক্রম কী। কিন্তু সেই পত্রিকার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল কবিগুরুর আশীর্বাণী, যার মাধ্যমে তিনি ধূমকেতুর মত এক সদ্যোজাত পত্রিকার নবীন সম্পাদকের ওপর তাঁর ভবিষ্যতের স্বপ্ন গচ্ছিত রেখেছিলেন। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট যে ‘ধূমকেতু’র জন্ম হয়েছিল, যুগের আঁধারে অগ্নিসেতু বাঁধার দায়িত্ব কবিগুরু তাকেই দিয়ে বসলেন। এ কেবল নজরুলের শক্তি ও দর্শনের ওপর কবির আস্থা নয়, এ যেন তাকে বরদান করা যাতে অলক্ষণের মন্দণ্ডতিলক সে-ই ঘোচাতে পারে। জাতির দুর্দিনে স্বাধীনতার দুর্গে যেন ‘ধূমকেতু’ই বিজয় কেতন ওড়ানোর সামর্থ্য রাখে। যে কবি নিজেকে মহাবিপ্লবহেতু পুনঃ আবির্ভাবের দাবি করেছেন, সেই কবির ঘাড়েই কবিগুরু তাঁর আশিসের বরদান দিয়েছেন যাতে দ্রোহের বিজয়ে অগ্নিবীণার কবির বিজয় অবধারিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু একের পর এক লেখার মাধ্যমে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুলের ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপের কারণে ব্রিটিশরাজের মনোবলে চিড়্ ধরে যায়। ফলে নজরুলকে যেতে হয় কারাগারে। ১৯২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি নজরুল কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি সংখ্যার ‘ধূমকেতু’ নজরুল সংখ্যারূপে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯২৩ সালের মার্চে এসে অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। যতদিন ধূমকেতু সচল ছিল ততদিন তার কাজই ছিল বাংলার পরাধীন মানুষকে জাগিয়ে তোলা। আজ শতবর্ষে এসে এই অতৃপ্তি মনে রয়ে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মান্ধতার মুক্তির জন্যে ‘ধূমকেতু’র পুনর্জাগরণ জরুরি ছিল। আজ যখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হতে শুরু করে প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষ গড়ার কারখানায় আমরা মধ্যযুগের প্রতিক্রিয়াশীলতার চাষ দেখি তখন আমাদের সেই আক্ষেপ আরো প্রগাঢ় হয়ে ওঠে।
‘ধূমকেতু’তে নজরুলের মোট আটাশটি লেখা প্রকাশিত হয় যার সবকটাই তীব্র তাপিত দ্রোহের পাবকের মতো। সাহিত্য সমালোচক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের ভাষায়, ধূমকেতুর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো যেন কালি নয়, রক্তে ডুবিয়ে লেখা। তৎকালীন তরুণদের মধ্যে কাজী নজরুলের প্রভাব বেশি থাকায় তরুণশ্রেণির মধ্যেই ধূমকেতুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকাটি তার দ্রোহধর্মের কারণে দৈনিকের মতোই প্রচার পায় এবং এ কারণে খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যেত প্রতিটি সংখ্যা। ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধের শরনিক্ষেপকারী হলেও একসময় ‘ধূমকেতু’ কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে যায় তার লেখার মধ্য দিয়ে। ফলে শ্রমিক-মজুরের দিকে ধাবিত করার প্রয়াসে বিফল কবিবন্ধু মোজফ্ফর আহমদ ‘ধূমকেতু’ হতে আলগা হয়ে আসেন। ‘ধূমকেতু’র অর্থ যোগানদাতারূপে ‘মেসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের ছেলে আফজালুল হক এগিয়ে আসেন। কিন্তু নজরুলের কারাবন্দিতার কারণে পত্রিকাটি আর এগুতে পারেনি, যদিও কবিবন্ধু বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলাল মিলে ১৯২৩ সালের মার্চ অবধি একে টেনে নিয়ে যান। ‘ধূমকেতু’র কারণেই কবি আটক হন বৃটিশ রাজের হাতে। এই কারাবন্দিতা বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’র মতো অসামান্য সাহিত্যমূল্যসমৃদ্ধ বই। ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে ধূমকেতুর কারণে বন্দী নজরুলের মুখেই আমরা আত্মপক্ষ সমর্থনে জবানবন্দী শুনি, ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে রাজার মুকুট, আরধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড, আরজন সত্য, হাতে ন্যায় দণ্ড।
আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়।...’
‘ধূমকেতু’ একটা পত্রিকামাত্র নয়। ‘ধূমকেতু’ কেবল সাহিত্য-সওগাতই নয়। ধূমকেতু হলো একদিকে যুগমানসের যুগবাণী আর অন্যদিকে পরাধীন জাতির বিজয়ভেরী। ‘ধূমকেতু’ সর্বকালে সর্বযুগে বাঙালির জন্যে সমান প্রাসঙ্গিক। ‘ধূমকেতু’র শতবর্ষে কবি নজরুলের এ ধরাধামে আগমনের অপরিহার্যতা আমরা আজ প্রতিটি নিঃশ্বাসে উপলব্ধি করি। এই অন্ধ সাম্প্রদায়িক সময়ে আবারো ‘ধূমকেতু’ অগ্নি প্রলয়ের মতো জেগে উঠে দুর্দিনের দুর্গশিরে বিজয় কেতন উড়িয়ে দিবে, এই প্রত্যাশা আমাদের অনিবার।