প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:১৭
অনুনাদিত খেদোক্তি

এক সময়ের শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত এই ব-দ্বীপ বাংলাদেশটি পারস্পরিক সংবেদনশীলতার অলংকারে বিভূষিত ছিলো। তখন মানুষের মানবিক অনুভূতি ছিলো যে, “সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই।” কবির ভাষায় উক্ত হয়েছে “মিথ্যা তো শুনিনি ভাই এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।” আবার মধ্যযুগীয় কবি আব্দুল হাকিম বলেছেন, ‘বঙ্গেতে জন্মে যে জন হিংসে বঙ্গ বাণী; সে জন কাহার জন্ম নির্ণয়-ন জানি।’ এই ধরাধামে জীবশ্রেষ্ঠ মানবের আবির্ভাবের পর পাস্পরিক মতান্তরে সৃষ্টি হয়েছে ধর্মানুভূতি। যা আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্নতা থাকলেও মৌলিকত্বে এক ও অভিন্ন। যেমন প্রাণী জগতের তৃষ্ণা নিবারক হলো : অম্বু-জীবন-নীর-জল-বারি-সলিল-উদক-অপ্ ইত্যাদি। এগুলো স্থান বা সংস্কৃতি অনুযায়ী নামান্তর হতেই পারে। বাস্তবে কার্যকারিতা কিন্তু একই। এগুলোর অর্থ বোধকে অনর্থক বিভাজনে রঞ্জিত করে আমাদের এই চির শান্ত বাংলাকে করে ফেলেছে কুশাঙ্কু-কন্টকে আবৃত। অবাধে চলাচল এবং নির্বিঘ্নে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। মানব জাতি সৃষ্টিতে পঞ্চ ইন্দ্রিয় চক্ষু-কর্ন-নাসিকা-জিহ্বা এবং ত্বক এগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-অনুভূতি, সকলের মধ্যেই সমভাবে অনুভূত হয়। এখানে কিন্তু ধর্ম ভেদে বৈষম্য হয় না। মানব সৃষ্ট বৈষম্য অনভিপ্রেত এবং বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচায়ক। আবার মানবতার প্রধান অরি হলো কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ এগুলো অপরিহার্য। কিন্তু সীমাবদ্ধতায় অনতিক্রান্তবৃত্তে থাকা উচিত। বর্তমানে এগুলোর বৃত্তাতিক্রান্ত অবস্থানটাই সামাজিক রাজনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। এর প্রতিফলনে দেশে চলছে অভূতপূর্ব কিম্ভূতকিমাকার অনাচার, যা দেশ পরিচালনার ট্রেনটি লাইনচ্যুত করে ফেলেছে। পক্ষান্তরে দেশের মানুষ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং করোনা নামক সংক্রামক ব্যাধিতে আজ নাজেহাল। এবং এনবিআর-এর আন্দোলনে দেশের অর্থনীতি প্রতিদিন ২৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত। ভারতের অসংলগ্ন পুশইন। এমন কি দেশে লাশ বাহী অ্যাম্বুলেন্স ও কিশোর সন্ত্রাসী ডাকাতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭-০৬-২০২৫)। দেশটা আজি সকল সেক্টরেই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথের পথিক। হাসপাতালে মানুষ ঔষধ-টিকা পায় না। দেশ এখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রকট দ্বন্দ্ব, খুনাখুনির আদিম বর্বরতার উলঙ্গ নৃত্যে এবং অসংলগ্ন ধর্মোন্মাদনায় মেতে উঠেছে। যাহা সংখ্যাল্প সম্প্রদায়ের অস্তিত্তের জন্যে মারাত্মক অশনি সংকেত। তারপর রয়েছে নেতাদের পারস্পরিক ক্ষেত্রের মলিন বাক্ যুদ্ধ। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের তিক্ত তীব্রতায় শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ন্যাক্কারজনক অবস্থার উদ্রেক হয়েছে। (সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন ৩০-০৬-২০২৫) ফলে শিক্ষার মান নিম্নতম পর্যায়ে পেঁৗছে যাবে। এবং বিশ্বমানের শিক্ষায় আমরা নিশ্চয়ই পশ্চাদমুখী হবো। বিশ্বের ছাপ্পান্নটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মধ্যে একমাত্র মালয়েশিয়া আমাদের অনুসরণীয়-অনুকরণীয় এবং অনুতোষণীয় হলেই আমরা দ্বি-চারিতামুক্ত শাসন ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবে।
কয়েক যুগ আগ থেকেই আমরা মৌলিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় অপরিহার্য নৈতিক শিক্ষাকে পুনঃ প্রর্বতন করতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই দেশে আবির্ভাব ঘটেছে ভয়ংকর ক্ষমতাবাজ, মবসন্ত্রাসী এবং আদর্শ বিবর্জিত গোষ্ঠীবদ্ধ বিদ্বেষী শক্তির, যারা অবশ্যই কোন না কোন অদৃশ্য অপশক্তির মদদপুষ্ট। মানব বিবেক কতেক দৃশ্যমান ঘটনা প্রত্যক্ষ করে হতচকিত হয়ে যাওয়ার কথা। এর ব্যতিক্রমীরা কিন্তু নরপশু। মানবতার অঁাতে ঘা দেওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট এবং ৯ই আগস্ট। এই ঘটনা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অমানবিক বিপর্যয় হিসাবে আজও হৃদয়বানদের আহত করে। বিপর্যস্ত জাপানী আবালবৃদ্ধবনিতারা দেশপ্রেমের প্রতি একনিষ্ঠ চূড়ান্ত মননশীল হয়ে আজ জাপানের মাথা পিছু আয় প্রায় সাড়ে ৩৮ হাজার মার্কিন ডলার, যা পৃথিবীতে ২৫তম। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার মার্কিন ডলারের মত। এর কারণ শুধুই ‘সিস্টেমেটিক-পলিউশান।’ যাহা প্রায় সর্বস্তরে সর্বজন বিদিত। এর মুখ্য কারণ হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদেরকে নৈতিক ছবক আর মাধ্যমিক পর্যায়ে নৈতিকতার বাস্তব প্রয়োগ আদৌ নিয়মসিদ্ধ গতিতে চালিত হচ্ছে না। এদেশে এক সময়ের চরম নৈষ্ঠিক আচরণে সিদ্ধ তরুণ যে কোনোভাবে প্রাপ্ত ক্ষমতার উত্তাপে যুগোপযোগী হয়ে মানবিক নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে। পরে মানবতা বিরোধী পচনধরা সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তখন সে অসামাজিক এবং মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে আসক্ত হয় অথবা প্ররোচনা দেয়। তাতেই মানব সমাজ অশান্ত-অস্থিতিশীল এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। মুক্তির একমাত্র পথ হলো শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষায় মানবতার ছবক আর কৈশোরে মাধ্যমিক শিক্ষায় এর যথাযথ প্রয়োগ, যা চলমান মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য পাথেয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে দ্বি-চারিতার চাষাবাদ নিশ্চয়ই ক্ষমতা চ্যুতির নিয়ামক জন্ম দেবে। চলমান অরাজকতায় মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হলে অতিদ্রুত কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে দেশটাকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি থেকে রক্ষা করতে না পারলে আসন্ন রাজনৈতিক ‘সিডরে’ প্রবলভাবে দেশের প্রকৃত চেহারা বিকৃত হয়ে যাবে। আর এটি পতনোন্মুখতার হাত থেকে রক্ষা করাই মহান শাসকের ভূষণ। যে দেশে কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা ফোটে, সে দেশেই তো কোনো ঘটনা ঘটে না--ঘটানো হয়। এটাই এদেশের বাস্তবতা। আমাদের মধ্যে অতলান্ত শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। হারোনো বঙ্গীয় সংস্কৃতির শুভ নতুন প্রত্যুষের অঁাধার বিদারী অরুণোদয় স্নাত প্রকৃতি এবং পূর্ণ শশীর মনোমুগ্ধকর স্নিগ্ধতায় গভীর জলধির উপর শশীর নৃত্য যেমন চিরন্তন বঙ্গীয় সংস্কৃতির সাবলীল বন্ধন তেমনি হৃদয়ে একমাত্র পোষণ।
লেখক : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চঁাদপুর।