মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:১৪

পৃষ্ঠার গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে

কাজী নজরুল ইসলাম নজু
পৃষ্ঠার গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে

আমরা বড়ো হয়েছি বইয়ের পাতায় চোখ রেখে। বৃষ্টি হলে জানালার পাশে বসে বই পড়তাম, রোদ হলে ছায়ায় বসে পাতার পর পাতা উল্টাতাম।

জানা-অজানার মাঝে এক স্বপ্নের ভ্রমণ ছিলো আমাদের প্রতিদিনের অংশ। সেই বই ছিলো শুধু গল্প নয়--বন্ধু, আশ্রয়, আবিষ্কার।

আজকাল দেখি, ছেলেমেয়েদের চোখ মোবাইল স্ক্রিনে আটকে থাকে, তারা চেনে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ফলোয়ার’, কিন্তু চেনে না শরৎ চন্দ্র, ফাল্গুনী, বিমল মিত্র কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম।

তারা জানে কতো এই র‍্যাম, বইয়ের পাতার গন্ধ তারা বোঝে না, বইয়ের ভঁাজে লুকিয়ে থাকা অনুভবের শীতলতা তারা পায় না।

আমরা বড়ো হয়েছি বইয়ের ঘ্রাণে,

পাতা ওল্টানোর শব্দে কেটেছে সন্ধ্যে।

গল্পের রাজ্যে ডুবে থাকতো মন, মোবাইল ছিলো না, ছিলো চোখে স্বপ্ন। আমরা পড়ে বেড়ে উঠেছি--ভাবনার গভীরে,

আর আজ? ওরা ক্লিক করে, হারায় নীরবে।

তবু আশা করি, একদিন হয়তো আবার কেউ বলবে--’একটা বই দাও না একটু’। আবার কেউ ঘুমোবে পছন্দের গল্প জড়িয়ে, পৃষ্ঠার গন্ধে হারিয়ে যাবে গভীরে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, বইয়ের পাতা ছিলো আমাদের খেলার মাঠ। ছুটির দিনে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে আসা ছিলো এক উৎসব। মোবাইল, ইন্টারনেট কিছুই ছিলো না, তবু মনে হতো, পুরো পৃথিবীটা বইয়ের পাতায় ধরা আছে। আর এখন?

শিশুরা একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে—চোখে ক্লান্তি, মনে খালি।

বই পড়া এখন নাকি ‘অপচয়’ মনে হয় অনেকের কাছে।

কিন্তু আমরাই জানি, একটা ভালো বই মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বই শুধু পৃষ্ঠা নয়, বই একটা চরিত্র গঠনের জায়গা।

আমি আমার কথাই বলি।

বই পড়ে কেঁদেছি, বই পড়ে হেসেছি। কারণ আমি শুধু পড়িনি, আমি বেঁচেছি প্রতিটা গল্পের ভেতর। কখনো হিমুর মতো হেঁটেছি সন্ধ্যাবেলায়, কখনো ফেলুদার সঙ্গে রহস্যে ডুবে গেছি। একেকটা বইয়ের চরিত্র যেনো আমারই ছায়া হয়ে যেতো। আমি গল্পের ভেতরে ঢুকে যেতাম নিঃশব্দে, কখনো হঁাটতাম কঁাচা রাস্তায় গ্রামের কোনো মেয়ের সঙ্গে,

কখনো ভালোবেসে ফেলতাম সেই চরিত্রটাকেই, যার বুকে জমা ছিলো এক পৃথিবী নীরবতা। বইয়ের অলিগলি দিয়ে হঁাটতে হঁাটতে আমি ভুলে যেতাম আমি কার মাঝে আছি--

আমি পাঠক, না চরিত্র, না লেখক নিজেই।

একটা বইয়ের কথা না বললেই নয়, বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। এটা শুধু একটা উপন্যাস নয়, এ যেনো একটা সময়, একটা সমাজ, আর কিছু জটিল অথচ অমলিন মানুষের গল্প। আমি যখন বইটা পড়ছিলাম, বাস্তব যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমি হয়ে উঠেছিলাম দীপংকর--

ভেতরে ক্লান্তি, সমাজের ছদ্ম মুখোশের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ।

কখনো আমি সতী লক্ষ্মীর চোখ দিয়ে দেখেছি সংসার, আত্মত্যাগ, আর নিঃশব্দ হাহাকার। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা যেনো ছিলো একটা দরজা, যেখানে ঢুকলেই এক অন্য জীবন শুরু হতো। কখনো ব্যথা পেয়েছি, কখনো ঘৃণা, আবার কখনো মুগ্ধতা। কী গভীরভাবে অঁাকা চরিত্র! কী তীব্র, অথচ মৃদু সেই সমাজচিত্র! এই উপন্যাসটা পড়া মানে শুধু সময় কাটানো নয়,

নিজেকে আবিষ্কার করা, প্রশ্ন করা, ভেতরে ঢুকে যাওয়া। আজও মনে পড়ে কিছু সংলাপ, কিছু নীরব দৃশ্য, যা আজও আমার চিন্তায়, অনুভবে জায়গা করে নিয়েছে।

‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ আমি শুধু পড়িনি,

আমি সেখানে থেকেছি।

আমার ভেতরে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি সেই অঘোর দাদুর চরিত্রে। ছিটেফেঁাটা বলা যায়--হয়তো পাগলাটে, আবার কখনো চিন্তাশীল এক বিপ্লবী মনের প্রতিচ্ছবি। তঁাদের প্রতিটি সংলাপ ছিলো সময়ের গায়ে ছুরির মতো ধারালো। আর এই গল্পের পটভূমিতে ছিলো সেই সময়, যখন ভারতের মাটি উত্তাল ছিলো স্বদেশী আন্দোলনে, যখন দেশপ্রেম মানে ছিলো আত্মত্যাগ, চোখে আগুন, মুখে প্রতিবাদ।

এই প্রেক্ষাপটে দীপংকর, সতী লক্ষ্মী, আর অঘোর দাদুর মত মানুষরা শুধু চরিত্র নয়, তারা একেকটা সময়ের মুখ।

অঘোর দাদুর মুখে হাসি ছিলো, কিন্তু চোখে ছিলো আগুন। তার ছিটেফেঁাটার মধ্যে লুকিয়ে ছিলো এক ধূর্ত, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, যা বোঝে সমাজের ভণ্ডামি, রাজনীতির ছলনা। এই উপন্যাসটা পড়ে শুধু গল্প জানিনি, জেনেছি ইতিহাস, দেশপ্রেম, আর মানুষের ভেতরের সেই লড়াই, যা সময় বদলায়, সমাজ গড়ে।

আমি আর বই আলাদা ছিলাম না মোটেও।

আমাদের সময়টা ছিলো কাগজের পাতায় বোনা এক জাদুময় সময়।

পাঠ্যবই তো ছিলো, কিন্তু তার ফঁাকে ফঁাকে জায়গা করে নিতো গল্প, উপন্যাস আর ভ্রমণকাহিনি। আমরা বই পড়তাম লুকিয়ে মায়ের বকুনি এড়াতে, পরীক্ষার ভয়ে নয়, ভালোবাসার লোভে।

পাঠ্যবইয়ের নিচে চাপা দিয়ে রাখা শরৎচন্দ্র, নিহাররঞ্জন এসব ছিলো আমাদের গোপন সঙ্গী।

সন্ধ্যাবেলা পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতায় আমরা চলে যেতাম কক্সবাজার, কাশ্মীর বা কোনো পাহাড়ি ট্রেকে।

গল্পে ঢুকেই আমরা হারিয়ে যেতাম অন্য এক জগতে, যেখানে পরীক্ষার চাপ, সিলেবাস বা ক্লাসটেস্টের ভয় ছিলো না। মাঝে মাঝে মা হঠাৎ এসে দেখে ফেললে

ভয়ে বই বন্ধ করতাম, কিন্তু চোখের তৃপ্তি লুকানো যেতো না। মা হয়তো বকতো, কিন্তু সেই বকুনির মধ্যেও একটা স্নেহের গন্ধ থাকতো, যেনো তিনিও জানতেন, এই বইগুলোই আমাদের বড়ো করে তুলছে ভোতর থেকে। আর মা নিজেই ছিলেন বইয়ের পোকা।

আজও সেই পুরোনো পাতাগুলোর কথা মনে পড়ে, যেখানে লেখা ছিলো শুধু গল্প নয়,

আমাদের শৈশব, স্বপ্ন, আর ছোট্ট এক জীবন-ভ্রমণ। সেই সময়গুলো আজও বুকে বাজে।

বই শুধু কাগজ আর মুদ্রিত অক্ষর নয়,

আমার জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতিগুলো যেন ঠিক ওই পাতাগুলোর মাঝেই লুকানো।

বই পড়ে আমি শুধু সময় কাটাইনি, আমি একেকটা জীবনের ভেতর ডুবে গেছি। আর কখনো কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি ওদের মাঝখানে। যখন আমি কোনো বই হাতে নিই, মনে হয় একটা দরজা খুলে যাচ্ছে একটা নতুন জগতের, যেখানে আমি একাকী নই। আমি পাঠক থেকে চরিত্র হয়ে যাই, গল্পের শহরে হেঁটে বেড়াই,

ভালোবাসি, ভুল করি, ক্ষমা চাই। যারা বই পড়ে, তারা কেবল শব্দ শিখে না, তারা শেখে অনুভব করতে, ভাবতে,

একটা বাক্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ কান্নাটাকেও তারা টের পায়। তারা যখন কথা বলে, চোখে-মুখে থাকে গভীরতা। কারণ তারা অনেক জীবনের গল্প পড়ে এসেছে--ভাঙ্গা মানুষ, নিঃস্ব চরিত্র, সাহসী সিদ্ধান্ত, হারিয়ে যাওয়া প্রেম। অন্যদিকে যারা বই পড়ে না, তারা হয়তো অনেক তথ্য জানে, তবে অনুভব জানে না, সংবেদনশীল হয় না। তারা মেধাবী হতে পারে, তারা বিশ্লেষণ করতে পারে না। কিন্তু মুছে যাওয়া কোনো চরিত্রের চোখে জল দেখতে পায় না।

বই মানুষকে শুধু জ্ঞানী নয়, মানুষ করে। একজন বইপাঠক মানুষের মনটা হয় আরেকটু নরম, একটু গভীর। বই পড়া মানুষ কখনোই একা থাকে না।

তারা অনেক জীবনের গল্প জানে, অনেক হৃদয়ের ভাষা বোঝে।

তারা শব্দের মধ্য দিয়ে দেখে, অনুভব করে, ভালোবাসে। যারা বই পড়ে, তারা কল্পনায় উড়তে জানে, তারা বাস্তবের ভেতরে থেকেও অনেক গভীরে যেতে পারে। তাদের মুখে হয়তো কম কথা, কিন্তু চোখে থাকে গল্পের জোয়ার।

আর যারা পড়ে না, তারা হয়তো দুনিয়া দেখে, কিন্তু মন ছুঁতে পারে না। তারা সময় কাটায়, কিন্তু অনুভব করে না।আজকাল হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন, চোখে রঙিন ভিডিও--তরুণ মন দৌড়ায় খুব দ্রুত, কিন্তু গভীরে যায় না। তারা জানে ট্রেন্ডিং, জানে ভাইরাল, কিন্তু জানে না বিভূতিভূষণের পথের পঁাচালি।

বই পড়া মানে ক্লাসের বোঝা নয়,

বই মানে নতুন চোখে দেখা এক জীবন,

যেখানে গল্পে শেখা যায় ভালোবাসা, উপন্যাসে শেখা যায় সহানুভূতি।

এই সময়ের তরুণ প্রজন্ম জানে প্রযুক্তি, জানে স্ক্রিনের আলো। কিন্তু বইয়ের পাতার সেই নরম গন্ধ তারা ভুলতে বসেছে।

তারা জানে কোন্ অ্যাপে কত ডাটা খরচ হয়,

কিন্তু জানে না একটা ভালো গল্প কীভাবে হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে। বই পড়া মানে শুধু জ্ঞান অর্জন নয়, বই মানুষকে সংবেদনশীল করে, গভীর করে, স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। যেখানে ফেসবুকে আমরা রিয়্যাক্ট দিই, সেখানে বই শেখায় প্রতিক্রিয়া দিতে--চুপচাপ, ভেতর থেকে। একটা ভালো বই তোমার বন্ধু হতে পারে,

যখন চারপাশে সবাই ব্যস্ত, তোমার ভেতরে একটা ভালো বই আলো জ্বালিয়ে যেতে পারে,

যখন বাইরের দুনিয়া অন্ধকার। বইপাঠ মানুষকে শুধু জ্ঞান দেয় না, বইপাঠ মানুষকে হৃদয় দেয়।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাহিত্য একাডেমি, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়