প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
করোনা মহামারীর কারণে দেশের সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চের ১৭ তারিখ থেকে বন্ধ রয়েছে। বহুবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার কথা বলা হলেও তা বাস্তবে পরিণত হয়নি। দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশে সবকিছুই খোলা, বন্ধ শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুম। ব্যাংক-বীমা, হাট- বাজার, শপিংমল, পর্যটন কেন্দ্র, কোথাও যেতে বাধা নেই। বাধা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবার। এতে করে শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাকের এক জরিপে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এই ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে জানা যায় যে, সংসদ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্লাস অধিকাংশ প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে পারেনি। ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ক্লাসে অংশ নেয়নি। দূরশিক্ষণে যারা অংশ নিচ্ছে না তাদের ৭১ শতাংশের বাসা বাড়িতে টিভি নেই, বিদ্যুৎ নেই, ডিস লাইন কিংবা ইন্টারনেট নেই। আবার তাদের মধ্যে ২১ ভাগ শিক্ষার্থী জানেই না যে, তাদের জন্য এ ধরনের একটা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। এদিকে করোনা সংক্রমণের সময়ে শতকরা ১৬ ভাগ শিক্ষার্থী ‘বিভিন্ন উদ্বেগ ও আতঙ্কে’ ভুগছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অনেকের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠার প্রবণতাও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্র্যাকের জরিপে আরও দেখা যায়, টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও অতিমূল্য, ক্ষুদ্র বা নৃগোষ্ঠীর শিশুদের ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যাসহ বহুবিধ কারণে অনেক শিক্ষার্থী করোনাকালীন দূরশিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি। তাদের শিক্ষা জীবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন তারা পাঠ্যবই থেকে বহুদূরে। গ্রামের অবস্থা আরো শোচনীয়। শহরের শিক্ষার্থীদের অবস্থা গ্রামের চেয়ে অনেকাংশে ভালো।
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের ১০ দিনের মাথায় ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সব অফিস-আদালত আর যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে শুরু হয় ‘লকডাউন’। দুই মাস পর ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে মে ২০২১ মাসের ৪-৭ তারিখে দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলায় ব্র্যাক পরিচালিত জরিপে অংশ নিয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১ হাজার ৯৩৮ শিক্ষার্থী।
জরিপে দেখা যায়, গড়ে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্কের চিত্র দেখা গেছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি। তাদের মধ্যে এ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
নারী শিক্ষার্থী, মাধ্যমিক পড়ুয়া, পল্লী অঞ্চলের বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে উদ্বেগ-আতঙ্কে ভোগার হার ১৭ শতাংশ। করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে পড়ালেখার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়ার কথা জানিয়েছে ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখার ব্যাপারে নির্দেশনা না পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে জরিপে বলা হয়েছে। জরিপ থেকে জানা যায় যে, গ্রামে বসবাসরত শিক্ষার্থী ও মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি।
জরিপের উপাত্ত অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৩% শিক্ষার্থী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব নিপীড়নের ধরণ মানসিক। তবে শারীরিক ও যৌন নিপীড়ন, ঘরে বন্ধ করে রাখা বা জোর করে কাজ করানোর মতো ঘটনাও জানিয়েছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।
এখানেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি, সে সংখ্যা ১৬ শতাংশ। এছাড়া ২ ভাগ নারী শিক্ষার্থী নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেছে। জরিপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, নারী শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আরও বেশি হতে পারে। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো দীর্ঘায়িত হয়।
শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অর্থাৎ ৫৪ ভাগ স্কুল খোলার পর বাড়তি ক্লাস করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের চলমান সংক্রমণের হার জানা সত্ত্বেও ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। এছাড়া পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস ছোট করা এবং পরীক্ষায় কড়াকড়ি না করে তা শিথিল করার পক্ষেও অনেকে মত দিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমকে স্বাভাবিক করা এখন সার্বজনীন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্ত সরকার নির্বিকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকার এখনো ঘোষণা করতে পারেনি। সরকার এখনো দ্বিধান্বিত। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কালবিলম্ব না করে তাদের প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার পক্ষে। দেশে যখন সব কিছুই উন্মুক্ত, তাহলে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন এ প্রশ্নে সরকার বেশ চাপে রয়েছে।
মহামারীতে লম্বা সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায যে, যত বেশি সময় শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে- সহিংসতা, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকির কারণে তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা তত কমে যাবে। ইতোমধ্যে অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে। ইউনিসেফ দ্রুত স্কুলগুলো খুলে দিতে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তার জন্য বিস্তৃত পরিসরে পদক্ষেপ নিতে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সে আহ্বানে এখনও সাড়া দেয়নি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গত প্রায় দেড় বছরেরও অধিককাল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানো যায়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ নানা পর্যায় থেকে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা ও সংক্রমণ পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় নেমে আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু যে গতিতে টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তাতে করে এটা বলা যায় যে, এ কাজ খুব দ্রুত সময়ে শেষ করা যাবে না। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে আশার কথা হলো, জনদাবির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সরকার দেশেই করোনা টিকা উৎপাদন করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন যত দ্রুত চুক্তি অনুয়ায়ী টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায় ততই উত্তম। জীবন-জীবিকা, শিক্ষা ও শিল্প স্বাভাবিক করতে চাইলে দ্রুত সময়ের মধ্যে গণটিকা কার্যক্রমকে শেষ করতে হবে। আর সেটা টিকা আমদানি করে করা সম্ভব নয়। দেরিতে হলেও সরকারের শুভবুদ্ধির জন্য জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
ভাইরাস থেকে বাঁচতে অন্য সবার মত শিশুরাও এখন ঘরবন্দি, পাশের ফ্ল্যাটের বন্ধুটির সঙ্গেও খেলা বারণ। শিশুদের ভরসা এখন গ্রিলবন্দি ব্যালকনি, সেখান থেকেই হাত নেড়ে নেড়ে চলে গল্প। মোবাইল ফোনের আসক্তি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দারুণ ক্ষতি করছে। কোভিড-১৯-এর কারণে যেসব দেশে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
দীর্ঘ সময় সরাসরি পাঠদান বন্ধ থাকলে পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার উপর ‘অত্যন্ত গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে’ বলে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী জানা যায় ‘প্রান্তিক শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা তাদেরকে অধিক দারিদ্র্য এবং অসমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। নিরাপদে স্কুল পুনরায় খুলে দেওয়া এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আজকের এই সিদ্ধান্ত এই শিশুদের পুরো জীবনকে প্রভাবিত করবে।’
ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বব্যাপী দেশগুলো দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলেও প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ২৯ শতাংশের কাছে এই শিক্ষা পৌঁছানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে এই হার আরও বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় শিশুদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শিক্ষা সংকট যাতে শিক্ষা বিপর্যয়ের দিকে না যায় সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলে দিতে প্রচারাভিযান চালানো জরুরি। নিরাপদে স্কুল খোলার লক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ইউনিসেফ তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মহামারীর কারণে প্রথমবার স্কুলে যাবে বিশ্বের এমন প্রায় ১৪ কোটি শিশুর পাঠচক্রে ঢোকার সুযোগ পিছিয়ে গেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ শিশু বাংলাদেশের।
এই শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮০ লাখ এমন স্থানে বাস করে, যেখানে মহামারীর পুরো সময় স্কুল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে সশরীরে শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দিনটির জন্য তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে, যা বেড়েই চলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারী শুরুর পর বিশ্বের ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলগুলো প্রায় সারা বছর বন্ধ ছিল। ফলে অনেক শিশুকে ঝরে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের মতো পরিণাম ভোগ করতে হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের বরাদ দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সমাধানমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা না হলে পুরো প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।
খুব স্বল্প সময়ে এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সহজ হবে না। শিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এ ক্ষতি পূরণে সহায়ক হবে। জাতি সেটাই প্রত্যাশা করে।
□ প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।