প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৭
প্রিয় শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা দূরপরবাস থেকে খোলা চিঠি দিলাম তোমাদের কাছে
![প্রিয় শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা দূরপরবাস থেকে খোলা চিঠি দিলাম তোমাদের কাছে](/assets/news_photos/2025/02/06/image-58682-1738813697.jpg)
বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে, এক মহাসাগর রক্তের বিনিময়ে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। সেই স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের নয়, ছিলো একটি স্বপ্নেরÑগণতন্ত্র, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও স্বনির্ভর অর্থনীতির। কিন্তু আজ, ৫৩ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, আমরা কি সত্যিই সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পেরেছি?
স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়েছিলাম, কিন্তু সেই স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য দিতে পেরেছি কি? আজ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈষম্য। এ যেন স্বাধীনতার আদর্শের সাথে এক নির্মম প্রতারণা!
বর্তমান পরিস্থিতি
দুর্নীতির রাজত্বে
আজকের বাংলাদেশ যেন এক দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য। রাজনীতির নামে চলছে লুটপাট, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর আত্মস্বার্থের প্রতিযোগিতা। একদল স্বার্থান্বেষী দেশকে শাসন নয়, শোষণ করছে। জনগণের টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন, বিদেশে সম্পদ গড়া, প্রশাসনের ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণÑএসব এখন স্বাভাবিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, যারা দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়তে চেয়েছিল, তারা আজ নিঃস্ব, অপমানিত, অবহেলিত। আর যারা নতুন করে দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ফিরিয়ে এনেছে, তারা এখন অনেকের চোখে অনভিজ্ঞ, অপরিপক্ব। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে না, কারণ তাদের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের দিশেহারা বলে প্রচার চালানো হচ্ছে, যেন জনগণের আস্থায় ফাটল ধরানো যায়। অথচ বাস্তবতা হলো, একটি দল যখন সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে, তখন অভিজ্ঞতার অভাবই তাদের একমাত্র দুর্বলতা হতে পারেÑএবং এই অভাব সময়ের সঙ্গে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু সুবিধাভোগী এক শ্রেণি তাদের বিভ্রান্ত করতে চায়, পথভ্রষ্ট করতে চায়, যাতে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এভাবেই ষড়যন্ত্র চলছে, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে নড়বড়ে করার জন্যে।
নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব : পরিবর্তনের বার্তা?
তবে আশার আলোও রয়েছে। এক ঝাঁক তরুণ, একদল সংগ্রামী ভাই-বোন নতুন করে দেশের জন্যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে। কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের জন্যে কোনো সঠিক ব্যবস্থা নিয়েছে?
প্রশাসনের গাফিলতি, সশস্ত্র বাহিনীর নীরবতা, এবং গণমাধ্যমের সারাক্ষণ প্রপাগান্ডা, গুজব আর মিথ্যাচারের বন্যায় দেশ ভাসছে। বাকস্বাধীনতা যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতির মূল ভিত্তি হওয়ার কথা, সেখানে সেটাই সবচেয়ে বড়ো উপহাসে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেনÑশারীরিক, মানসিক, আর্থিক দিক থেকে। তাদের জন্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ, ক্ষমতাসীনদের জন্যে রাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত!
বিদেশে প্রবাসীদের অবদান ও রাষ্ট্রের অবহেলা
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আমরা যারা বিদেশে আছি, তারা নিজেদের রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠাই, যেন দেশ এগিয়ে যায়, পরিবার সুখে থাকে। কিন্তু এই রেমিট্যান্সের টাকা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে?
আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ কি দেশের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে, নাকি ক্ষমতাসীনদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে? আমরা পরিশ্রম করি, আর দেশের একদল গডফাদার সেই অর্থ দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ায়, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে শকুনের হানা
বর্তমানে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দেশের হাল ধরতে এসেছে। কিন্তু তারা কি পারছে? নাকি তারা এতোটাই দুর্বল যে, একদল দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী শকুন সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের সম্পদ ভাগাভাগি করছে? তারা দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্ষমতার লড়াই, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ কি আবার স্বৈরশাসনের পথে?
এই অবস্থায় প্রশ্ন জাগেÑবাংলাদেশ কি আবার স্বৈরশাসনের পথে হাঁটছে? যদি তাই হয়, তাহলে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ২০২৪-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের জন্যে আমাদের এতো বছরের সংগ্রামের মূল্য কী?
দেশের সাধারণ মানুষ আজ বিভ্রান্ত, হতাশ। তারা দেখতে পাচ্ছে না মুক্তির পথ। তারা দেখতে পাচ্ছে না সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ। তারা কেবল দেখতে পাচ্ছে ক্ষমতালোভী দুর্নীতিবাজদের, যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।আমাদের করণীয় কী?
আমাদের আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। প্রবাসে থেকেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে।
প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : আমাদের রেমিট্যান্স যেন দুর্নীতিবাজদের পকেটে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সরকার জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়।
সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে : যাদের সত্যিকারের দেশপ্রেম আছে, যারা দেশকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেশের উন্নয়নে সকল প্রশাসনিক ও বাস্তবমুখী কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।
দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে শিক্ষার্থীদের শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগও দিতে হবে। এজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা 'অন দ্য জব ট্রেনিং' প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। এই প্রশিক্ষণ কমপক্ষে দুই বছরব্যাপী হতে হবে, যাতে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের গভীরতা বুঝতে পারে এবং ভবিষ্যতে দক্ষ নেতৃত্ব দিতে পারে।
শুধু প্রশাসনিক কাজেই নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলার জন্যে কর্মমুখী দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিতে হবে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্যও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, যাতে উচ্চশিক্ষার মান উন্নত হয় এবং শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
শিক্ষার্থীদের জন্যে পেশাভিত্তিক শিক্ষা এবং বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন, ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের বাস্তব চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত করে। একইভাবে, প্রকৌশলী, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদসহ অন্যান্য পেশার শিক্ষার্থীদেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং কর্মজীবনের জন্যে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি ইন্টার্নশিপ ও গবেষণা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়, তাহলে তারা শুধুমাত্র দক্ষ পেশাজীবী হয়ে উঠবে না, বরং প্রশাসনিক দুর্নীতি, সম্পদ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং নীতিগত গাফিলতির মতো বিষয়গুলোকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্যে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সুতরাং, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে রূপান্তর করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন করতে পারে, বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় পারদর্শী হয়ে ভবিষ্যতের সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ, তোমার কী মত?
প্রিয় বাংলাদেশ, তুমি আমাদের গর্ব, আমাদের ভালোবাসা। তোমার জন্যে আমরা জীবন দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি। কিন্তু তোমার এক দল সন্তান কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারছে? নাকি তোমাকে একদল লুটেরা, স্বার্থান্বেষী শকুনের হাতে ছেড়ে দিয়েছি?
প্রিয় শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা,
তোমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। বিজয়ের দাবিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই, পিছু হটার সময়ও নয়। ঘরে ফিরে গেলে ইতিহাস তোমাদের ক্ষমা করবে না, ভবিষ্যৎ তোমাদের প্রশ্ন করবে। তোমাদের হাতেই আজ দেশের ভাগ্যÑতোমাদের শক্তি, তোমাদের ঐক্যই পারে এই স্বৈরাচারী শাসনের যবনিকা টানতে।
স্বাধীনতার স্বপ্ন, গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনÑএসব কি সত্যিই অর্জিত হয়েছে? নাকি আমরা কেবল নতুন এক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছি? আজ তোমাদের সামনে দুটি পথÑহয় স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হও, নয়তো ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলো।
তোমরা যদি বিভক্ত হয়ে পড়ো, যদি নিজেদের মধ্যে ফাটল ধরাও, তাহলে শত্রুরা জয়ী হবে, আর বাংলাদেশ আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। তাই নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে, বিভেদ পেছনে ফেলে, এক কাতারে দাঁড়াও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেÑএই লড়াই থেকে পিছু হটার সুযোগ নেই।
তোমাদের লড়াই কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, তোমাদের লড়াই একটি সুশাসিত, ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের জন্যে। কিন্তু তোমাদের ভেতর ভাঙ্গন সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র চলছে। তারা চায় তোমরা বিভক্ত হও, নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে জড়াও, যেন তারা আবার স্বৈরশাসন কায়েম করতে পারে। কিন্তু তোমাদের ঐক্যই তাদের ভয়। তোমরা যদি একসঙ্গে দাঁড়াও, তাহলে কেউই তোমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
আজ তোমাদের কাছে একটি আহ্বানÑ
এই দেশ এখন শুধুই তোমাদের, এই মাটি তোমাদের, একে রক্ষা করাও তোমাদের পবিত্র দায়িত্ব। তোমরা কি প্রস্তুত সেই লড়াইয়ে আবার নামতে?
সময়ের চাকা ঘুরে গেছে। এখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। সামনে এগিয়ে চলো, বাংলাদেশকে রক্ষা করো!
রহমান মৃধা : গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)