প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২২:১৯
দ্বিতীয় ভাগ : বিলাসিতা ও অসমতা

শিল্প ও বিজ্ঞানের উত্থানের সঙ্গে বিলাসিতা এসেছে। এই বিলাসিতা আমাদের সমাজে অসমতা তৈরি করেছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব আরও গরিব। যারা শিক্ষিত হয়েছে, তারা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে উচ্চ মনে করে। এই অহংকার আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। আমরা আর একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখাই না।
দেখুন, কৃষকরা তাদের জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু তারা শিল্পীদের মতো সম্মান পায় না। সৈনিকরা দেশের জন্য জীবন দেয়, কিন্তু কবি ও দার্শনিকরা বেশি প্রশংসা পায়। এই অসমতা আমাদের সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে।
সত্যের পরিবর্তে কৃত্রিমতা
বিজ্ঞান আমাদের সত্যের কাছে নিয়ে যায় না। এটি আমাদের জীবনকে জটিল করে। আমরা এখন এমন জিনিসের পেছনে ছুটছি, যা আমাদের প্রকৃত সুখ দেয় না। আমাদের কথাবার্তা, আমাদের আচরণÑসবকিছু এখন কৃত্রিম। আমরা সত্যকে ভুলে গিয়ে চেহারা রক্ষার জন্য বেঁচে আছি।
প্রতিভা ও দুর্নীতি
যারা শিল্প ও বিজ্ঞানে প্রতিভাধর, তারা প্রায়ই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। তারা তাদের প্রতিভাকে ধনী ও ক্ষমতাশালীদের সেবায় ব্যবহার করে। তারা সত্যের জন্য লড়ে না, বরং প্রশংসা ও পুরস্কারের জন্য কাজ করে। এই প্রতিভা যদি সৎভাবে ব্যবহার করা হতো, তাহলে হয়তো আমরা উপকৃত হতাম। কিন্তু বাস্তবে এটি আমাদের আরও ক্ষতি করেছে।
উপসংহার
আমি শিল্প ও বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি না। আমি বলছি না যে আমাদের সবকিছু ত্যাগ করে বনের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবেÑএই উন্নতি কি আমাদের সত্যিকারের সুখ দিয়েছে? আমি প্রস্তাব করছি যে আমরা আমাদের জীবনে সরলতা ফিরিয়ে আনি। আমাদের জ্ঞান ও প্রতিভাকে এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত, যাতে এটি আমাদের গুণকে বাড়ায়, আমাদের দুর্বলতাকে নয়।
আমি জানি, আমার এই কথা শিক্ষিত ও উচ্চবর্গের মানুষদের কাছে অপছন্দ হবে। তারা বলবে আমি অজ্ঞ ও পশ্চাদপদ। কিন্তু আমি সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলছি, যারা এই জ্ঞানের আলোয় কিছুই পায়নি। আমি তাদের জন্য বলছি যে সততা, সাহস ও সরলতাই জীবনের আসল সম্পদ।
আমরা মানুষ অতীব বিচিত্র প্রাণী! আর তার জন্যই বুঝি আমাদের তুলনা চলে বিচিত্র প্রাণীদের সাথে। মানুষকে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে চাইলে সারা জীবন ব্যাপী সাধনা করতে হয়। সারা জীবন যদি সাধনাই করবো তবে সাধ-আহ্লাদ, শখ পূরণ করি কবে! তাই মানুষ হবার সাধনা বাদ দিয়ে অন্যকে মানুষ করার মধুর সাধনায় (সমালোচনা) লিপ্ত হই।
বিষয়টি হলো ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। তাও বাস্তবে নয়,ভার্চুয়াল ঢং এ। যে ব্যক্তিটি উদারতার “উ” নিয়েও ভাবে না সেও সুযোগ পেলে (অবশ্যই স্বার্থ সিদ্ধির আশায়) আপনাকে উদারতার জ্ঞান দিতে আসবে। বাস্তবে তো সম্ভব নয় (বুকের পাটা নেই) তাই মাধ্যম হলো ভার্চুয়াল জগত। কীভাবে সম্ভব হবে! যেই মানুষ আপনার মাথায় দিনের পর দিন কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়ে খেয়ে ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়েছে ; এখন সেই মাথাটি সরিয়ে নিলে আপনার মাথা তো তার চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করবেই। সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। ভাগ্যিস চিবিয়ে খাওয়ার আগ মুহূর্তে মাথাটি সরানো সম্ভব হয়েছিল!
বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় মানুষ অসীম ক্ষমতাধর প্রাণী। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ সারা জীবনেও সেই ক্ষমতার এক ভাগও ব্যবহার করতে পারে না। খুব কাছে থেকে দেখেছি ধর্মীয় আচারে (শারীরিক ধার্মিক) সমস্ত দিন অতিবাহিত করে দিলেও গীতার সার কথাটি নিজের জীবনে আয়ত্ত্ব করতে পারেনি (প্রত্যহ গীতা পাঠক)। অলসতা আর কর্ম বিমুখতা এদের নিত্য সঙ্গী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তো আর তাদের কাছে প্রত্যাশাই করা যায় না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ এবং কর্মই ধর্ম, কর্মই মুক্তিÑএই দুটি মন্ত্র যদি কারো মাথায় গেঁথে যায় তার কী পরামুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কোন সুযোগ থাকে!
আসল কথায় আসি। শিল্প ও বিজ্ঞান মানব জীবনের সকল স্তরে সরলতায় ও আন্তরিকতায় প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালি মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে চুল চেঁড়া বিশ্লেষণ চলতে থাকে বউটির কী কী দোষ আছে। আমিও যেহেতু এই কাতারে ছিলাম তো বিশ্লেষণ শেষে (সবাই না, যাদের বৈষয়িক হিসাবে দুঃশ্চিন্তা ছিল) জানতে পারলাম আমার ভেতরে ভেতরে রাগ আছে। মনে মনে বললাম, “ভুল, ওটা রাগ নয়, ওটা মেরুদণ্ড।” আসলে মেরুতে মেরুদণ্ড থাকে না, ওটা থাকে মগজে, মননে। বাংলাদেশে অবশ্য মেরুদণ্ড থাকা মেয়েদের সহজে কেউ হজম করতে পারে না। কারণ এটা কেবল এক পক্ষের এখতিয়ারভুক্ত বিশেষণ! অবশ্য উদার দৃষ্টিভঙ্গি যে সকল ক্ষেত্রে খাঁচায় বন্দি তেমনটি নয়।
অনেকদিন মাথাটা ভারি ভারি লাগছিল। চারিদিকে শুধু দুঃখ-কষ্ট,বিয়োগ-বেদনা। যদি সেগুলো নিয়ে কাঁদতে বসি তবে এই সমাজ-সংসার,অফিস-আদালত সকলে আমাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। আর আমি মরার আগেই সকলের নিকট মৃত বলে প্রমাণিত হবো। যাঁরা আমায় নিষ্ঠুর জানে জানুক, অনেক সাধনার পর চোখের জল আড়াল করতে শিখেছি তাকে টেনে সামনে আনা এতো সহজ না। জন্ম-মৃত্যুর সত্যতা ধর্মীয় গ্রন্থ থেকেই আত্মস্থ করেছি। তাতে উপলব্ধি করতে পেরেছি, সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত যত দ্রুত মেনে নেওয়া যায় জাগতিক বা আধ্যাত্মিক দুই জগতেরই ভারসাম্য বজায় থাকে। মায়াকে জয় করার সাধনা সে তো কঠোর সাধনা।
“ঈশ্বর এতো দুঃখ যদি দিবে তবে বহিবার তরে দিও শক্তি”
এবার দেখা যাক-শিল্প ও বিজ্ঞান এর সরলতা, আন্তরিকতা মানব জীবনের জেনারেশনের মধ্যে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে : আপনি যদি সর্বনিম্ন তিন জেনারেশনের শিক্ষিত হন, আপনার মাঝে আসবে আত্মশুদ্ধিতা।
আপনি যদি সর্বনিম্ন তিন জেনারেশনের ধনী হন আপনার মাঝে আসবে বিনয় ও ভদ্রতা।
প্রথম বা দ্বিতীয় জেনারেশন হলে আপনার মাঝে থাকবে উদ্ধতস্বভাব, টাকা দিয়ে দুনিয়া কেনার প্রবণতা অথবা আপনি হবেন গোয়ার এবং অভদ্র।
আপনি আপনার বংশের কতোতম প্রতিনিধি সেইটা জানানোর জন্য সাইনবোর্ড নিয়ে হাটতে হবে না, আপনার আচার আচরণই সেইটা প্রমাণ করবে (শিক্ষিত বলতে এখানে সুশিক্ষিতকে বোঝানো হয়েছে!
শিক্ষার সাথে নৈতিকতা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, বিনয় এবং পরিমিতিবোধের সমন্বয়কে বোঝানো হয়েছে।
আপনার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা কি?
প্রথমত আপনার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা কি?
প্রথমত আপনার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা থাকবে ভাষাগত জ্ঞান চর্চা করা। হোক সেটা বাংলা, হোক ইংরেজি।
দ্বিতীয়ত প্রত্যাশা হচ্ছে, আপনাকে অবজারবেশনের দিকে একটু নজর দিতে হবে। কমিউনিকেশনের একটা অংশ হচ্ছে নিজে বলা, নিজে লিখা ও নিজের বডি লেংগুএজ। আরেকটা ভেরি ক্রিটিক্যাল পার্ট হচ্ছে অবজারবিং আদার্স। আরেকজনের কথা মন দিয়ে শুনা, রেস্পেক্ট করা, তার স্পেসটা কতটুকু তা দেখা। তার কতোটা কাছাকাছি যেয়ে আমি কথা বলবো, কতো দূরে যাবো, আই কন্টাক্ট কিভাবে হবে, তার প্রতি আমার হাস্যজ্জ্বল মুখ হবে নাকি গম্ভীর মুখ হবে, ব্যাপারগুলো বুঝা। অবজারবেশন করা।
তৃতীয়ত এম্পেথি বা সহমর্মিতা। আপনি যার সাথে কমিউনিকেট করছেন তার মানুষিক অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করা এবং তাকে জাজ না করা।তার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা থাকবে ভাষাগত জ্ঞান চর্চা করা। হোক সেটা বাংলা, হোক ইংরেজি।
দ্বিতীয়ত প্রত্যাশা হচ্ছে, আপনাকে অবজারবেশনের দিকে একটু নজর দিতে হবে।কমিউনিকেশনের একটা অংশ হচ্ছে নিজে বলা, নিজে লিখা ও নিজের বডি লেংগুএজ।আরেকটা ভেরি ক্রিটিক্যাল পার্ট হচ্ছে অবজারবিং আদার্স। আরেকজনের কথা মন দিয়ে শোনা, রেস্পেক্ট করা,তার স্পেসটা কতটুকু তা দেখা। তার কতোটা কাছাকাছি যেয়ে আমি কথা বলবো, কতো দূরে যাবো, আই কন্টাক্ট কিভাবে হবে, তার প্রতি আমার হাস্যজ্জল মুখ হবে নাকি গম্ভীর মুখ হবে, বেপার গুলো বুঝা। অবজারবেশন করা।
তৃতীয়ত এম্পেথি বা সহমর্মিতা। আপনি যার সাথে কমিউনিকেট করছেন তার মানুষিক অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করা এবং তাকে জাজ না করা।
তাই পরিশেষে বলবো মানব জীবনের পারিবারিক বন্ধনের সুদৃঢ়তাকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দেই। আবেগ অনুভূতি সরলতাকে জীবনের অবিচ্ছেদ অংশ মনে করলে প্রাচীনকালের সেই পারিবারিক শিক্ষা পুনরায় ফিরে আসবে শিল্প বিজ্ঞান যতই ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে, মানুষের আবেগ ততটা অস্থির হয়ে উঠছে। পরিবারে নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করলে পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য তার কাছে যেন জীবনের অবিচ্ছেদ অঙ্গ হয়ে ওঠে।সকল নেতিবাচক দিক নিয়ন্ত্রণ করে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আচরণের মধ্যে যেন সর্বাধিক সরলতা প্রকাশ পায় সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয়।লেখক : ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।