শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৫

মাঝি ও তপন

কাজী আজিজুল হাকিম নাহিন
মাঝি ও তপন

এটি এমন একটি গ্রাম, যে গ্রামের নদী, খাল, নদীর পাড়ে সারি সারি গাছ। দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্রামের নাম রূপগঞ্জ। সেই গ্রামেরই এক যুবকের নাম তপন। তপন মিশুক স্বভাবের ছেলে। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসে। কারণ গ্রামের সকল মানুষকে তপন বুদ্ধি, পরামর্শ, সুন্দর ব্যবহার, উপকার, হাসি মুখ প্রতিনিয়ত উপহার দেয়। এভাবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।

তপন ব্যবসা করে। প্রতিদিন তাকে গ্রামের নদী-খাল পেরিয়ে বাজারে যেতে হয়। গ্রামের একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা লঞ্চ ও নৌকা। তখন গ্রামটিতে মোবাইল ফোনের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। গ্রামের লাইনের লঞ্চে যাতায়াত করে সে। লাইনের ট্রলারগুলো ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়। তপন কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতে কখনো সন্ধ্যা কখনো রাত হয়ে যায়। তপনের বাড়িতে পৌঁছাতে হলে একটি নদী পার হতে হয়। সেই নদীতে একজন মাঝি এক টাকা কিংবা দু টাকা দিয়ে নদী পারাপার করে।

তপনের মাঝির সাথে প্রায়ই অনেক কথা হতো। মাঝির খোঁজ-খবর নিতো। মাঝিও তপনের খেয়াল রাখতো। একদিন দুপুর বেলা মাঝি নৌকা বাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেদিনই তপন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো। তপনের নজর গেলো মাঝির নৌকায়। মাঝির নৌকা দেখে, কিন্তু মাঝিকে দেখতে পাচ্ছে না দূর থেকে। সে প্রথমে মাঝিকে ডাক দিলো। মাঝিকে ডাকতো মেবাই (মিয়াভাই) বলে। কিন্তু মাঝির কোনো খোঁজ নেই। তপন নৌকায় মাঝির উপস্থিতি টের না পেয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে নৌকার কাছে গেলো। গিয়ে দেখলো মাঝি নৌকায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। গিয়ে বললো, মেবাই মেবাই, কী হয়েছে আপনার? মেবাইর কোনো উত্তর ছিলো না। নৌকায় আরেকটি বৈঠা থাকার কারণে দ্রুত নদীর পাড়ে গিয়ে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় দ্রুত গ্রাম্য হাসপাতালে ভর্তি করলো।

চিকিৎসা পাওয়ার পর মাঝি সুস্থ হলো। সে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলো। মাঝি জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর তপনের কথা জানতে পারলো, তার উপকারের কথা জানলো। তপনের চেষ্টায় সে জীবন ফিরে পেয়েছে।

মাঝি তপনকে ধন্যবাদ জানায়। তপনের প্রতি মাঝির অনেক মায়া জন্মায়। মাঝি ক’দিন পর সুস্থ হয়ে আবারো নৌকা চালানো শুরু করে।

মাঝি তপনকে বলে, তুমি যতো রাতই হোক নদীর ওপার থেকে ডাক দিলে আমি তোমাকে নৌকা বেয়ে নিয়ে আসবো।

তপন কাজের কারণে কখনো কখনো রাত হয়ে যেতো বাড়িতে ফিরতে। নদীর ঐ পাড়ে এসে ‘মেবাই মাঝি’ বলে ডাক দিতো। মাঝিও দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ শুনে বুঝতে পারতো তপন এসেছে। তপন ডাকছে।

মাঝি দ্রুত বৈঠা নিয়ে নৌকা বেয়ে তপনকে নিয়ে আসতো।

এভাবেই সন্ধ্যা হোক, রাত হোক, মাঝি সব সময় তপনকে নিয়ে আসতো নৌকা করে।

এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। বর্ষাকালের একটি দিন। তপনের ব্যবসায়ের কাজ সেরে আসতে রাত ১১ টা বাজছিলো। তপন ঐ পাড় থেকে ডাকছে ‘ওওও মেবাই...আমি আইছি, ওওও মেবাই...আমি আইছি’।

কিন্তু সেদিন মেবাইয়ের কোনো উত্তর ছিলো না।

একঘন্টা নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছিলো তপন। যখন দেখলো অনেক রাত হয়ে গেছে, তখন তপনের মা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখলো তার ছেলের ডাক শোনা যায় কিনা। প্রথমে শুনতে না পেলেও পরে শুনতে পেলো মেবাইকে ডাক দেয়ার শব্দ।

তপনের মা দ্রুত হেঁটে চলে গেলো মাঝির বাড়ি। গিয়ে দেখে অন্যরকম পরিবেশ। মাঝি আজই মারা গিয়েছে রাত আটটায়। মাঝির একটি ছেলে ছিলো ক্লাস নাইনে পড়ে। তার বাবা মারা গেছে বলে সে কান্না করছিলো। ওদিকে তপন জানে না এদিকের পরিবেশ। তপন এখন কীভাবে আসবে?

তপনের মা কোনো উপায় না পেয়ে মাঝির নৌকা করে গ্রামের একটি ছেলেকে নিয়ে তপনকে ঐ পাড় থেকে নিয়ে আসলো। যখন নৌকা তপনের কাছে পৌঁছাবে, তপন ভাবছে মাঝি আসছে। তপন বললো ‘ও মেবাইল ঘুমিয়ে গেছিলেন...?’

নৌকা থেকে ভেসে আসলো ‘আমি তোর মা। মাঝি আর নেই’।

তপনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তপন খুব কষ্ট পেলো। সকাল বেলাও মাঝির সাথে কথা হয়েছে। অথচ সে নেই। কাকে ডাকবো মেবাই বলে? কে আমাকে স্নেহ, মমতা দিয়ে নৌকায় পার করাবে? কে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে?

তপন খুব শোকে কাতর। তপনই মাঝিকে কবরে নামালো এবং ঠিক তখনই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো তপনের এবং বললো ‘ওওও মেবাই’ ভালো থাকবেন।

তপন যখনই কাজে যায়, কাজ থেকে ফিরে আসে মাঝির কথা মনে পড়ে। মাঝির নৌকা এখন মাঝির ছেলে চালায়।

তপন কাজ থেকে ফিরে নদীর ওপারে থেকে এখনও ‘মেবাই’ বলেই ডাকে। মাঝির ছেলে তাকে নিয়ে আসে তার বাবার মতো। যখন নৌকা বেয়ে রাতের অন্ধকারে তপনকে আনতে যাওয়া ছেলেটাকে দেখতে পায়, তখন মনে হয় তার মেবাই আসছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়