শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৬

শিশুর উন্নত শিখন পরিবেশ ও প্রধান শিক্ষক

রাশেদা আতিক রোজী
শিশুর উন্নত শিখন পরিবেশ ও প্রধান শিক্ষক

কোষের প্রাণ যেমন নিউক্লিয়াস, তেমনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাণ হচ্ছে প্রধান শিক্ষক। বর্তমানে বিকেন্দ্রীকরণকৃত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রধান শিক্ষক একাধারে ব্যবস্থাপক ,নেতা, অভিভাবক ,আদর্শ শিক্ষক এবং মূল কারিগরের কাজ করে থাকেন। যে কোনো তথ্য শিশুতোষভাবে উপস্থাপন, অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করা ,পাশাপাশি শিক্ষার মূলভিত্তি রচনা করতে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণান্তকর চেষ্টা করে থাকেন আজীবন শিশু শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা এবং বিদ্যালয়টিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু প্রধান করণীয় বিষয় আলোচনা করা হলো:

১। নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণা :

একজন প্রধান শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ নেতা হিসেবে কাজ করা। তাঁকে এমনভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে যাতে সবাই অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে। তিনি বিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে সবার সামনে তুলে ধরবেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য সবাইকে উৎসাহিত করবেন। ২ । শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি :

শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রধান শিক্ষক বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। এর ফলে শিক্ষকেরা নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং শ্রেণিকক্ষে তা প্রয়োগ করতে পারবেন। তিনি শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পরিবেশ তৈরি করবেন।

৩ । শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা : একটি সুস্থ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার জন্য অপরিহার্য। প্রধান শিক্ষককে অবশ্যই কঠোরভাবে বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন প্রয়োগ করতে হবে। একই সাথে, তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহনশীল হবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা এবং দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।

৪ । পিতামাতা ও সমাজের অংশগ্রহণ : শিক্ষার মান উন্নয়নে পিতামাতা এবং সমাজের সহযোগিতা অপরিহার্য। প্রধান শিক্ষক নিয়মিতভাবে পিতামাতার সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করবেন। তিনি সমাজের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগীদের বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার মানোন্নয়নে তাদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করবেন।

৫ । আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার : শিক্ষাদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। প্রধান শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হবে যে বিদ্যালয়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রজেক্টর ইত্যাদি আধুনিক শিক্ষা উপকরণগুলো সহজলভ্য এবং শিক্ষকেরা সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবেন।

৬ । সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ : বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রধান শিক্ষককে দ্রুত ও বিচক্ষণতার সাথে সেইসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ। তিনি সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

একজন প্রধান শিক্ষক যদি নিজস্ব দায়িত্ববোধ, প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েএকনিষ্ঠ চিন্তা -চেতনা, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা কে আঁকড়ে ধরে এই বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে পালন করেন, তবে তিনি একটি সফল ও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারবেন, যা শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।

কিন্তু বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নানাবিধ তথ্যের আদান-প্রদান, বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, সরকার নির্ধারিত যেকোনো কাজ তাৎক্ষণিকভাবে সম্পাদন করে- তার আলোকে প্রধান শিক্ষক তার ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব দিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। ফলশ্রুতিতে প্রধান শিক্ষকের মূল যে দায়িত্ববোধ- প্রতিদিন দুইটা করে পাঠদান করা(শুরুতে ১টা এবং শেষে ১ টা)এবং সহকারী শিক্ষকদের পাঠদান মনিটরিং করা, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত অধ্যায়ভিত্তিক মূল্যায়ন পর্যবেক্ষণ করা এবং ফিডব্যাকে সহযোগিতা করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কেননা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফান্ডের যথাযথ ব্যয় নির্বাহ করা, সুনিপুণভাবে বিদ্যালয়ের সকল কার্য পরিচালনা করা ,জবাবদিহিতা, দক্ষতার সাথে জনবল পরিচালনা করা-এই সমস্ত কাজে ঘাটতি দেখা যায় অনেক সময়ে। নিরবিচ্ছিন্নভাবে শুধুই পাঠদানে মনযোগ দেয়া,জনবল পরিচালনা , ফিডব্যাক দেওয়া এগুলোর কোনটাতেই একনিষ্ঠতার সাথে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। এছাড়াও থাকে হোম ভিজিট, এবং বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরন কর্মশালার আয়োজন করা, নিজে অংশগ্রহণ করা ,সকলের সাথে মতবিনিময় করা এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি যুগে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য আপডেট রাখা ও প্রধান শিক্ষকের আরেকটি দক্ষতা।

সরকার যেন শিক্ষার্থী অনুপাতে প্রয়োজনীয় জনবল ও আর্থিক বরাদ্দ দেয়, যাতে একজন প্রধান শিক্ষক নির্দ্বিধায় এবং শান্তিতে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা বা আইনি ঝুঁকির ভয় ছাড়া-এটাই আমাদের সকলের চাওয়া।

একটি স্কুলের প্রধান হিসেবে তাঁর ওপর যে বিশাল গুরু দায়িত্ব, তা আমরা পুরোপুরি অনুভব করতে পারছি। অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবসম্মত কথা হচ্ছে একটা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান হিসেবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা এবং সার্বিক পরিবেশ ভালো রাখার জন্য এই ধরনের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রধান শিক্ষক, যারা প্রতিনিয়ত উপরোক্ত কারণে বিভিন্ন সময়ে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কারণ এগুলোর সমাধান হলে শিক্ষাব্যবস্থার মান এবং প্রধান শিক্ষকদের কাজের পরিবেশ উভয়ই উন্নত হবে। এইজন্য প্রধান শিক্ষকদের গভীর হতাশা এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রথমত, সরকারের দিক থেকে কী কী উদ্যোগ নিতে পারে,যা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণের ওপর নির্ভর করে আর দ্বিতীয়ত, সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে স্থানীয়ভাবে কী কী করার আছে, যা শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সরকারের জন্য কল্যাণকর ও সম্মানজনক হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ : প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে শিক্ষকদের ওপর চাপ না দিয়ে অবকাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তন আনা জরুরি।

শিক্ষার্থী অনুপাতে জনবল বরাদ্দ নীতি: সরকার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও স্কুলের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মী (দারোয়ান) নিয়োগের ব্যবস্থা থাকবে। এই নীতিমালা অনুযায়ী,প্রায় ২০০০ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে কমপক্ষে ৪ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং ২ জন দারোয়ান নিয়োগ করা আবশ্যক। এতে শিক্ষকদের ওপর থেকে অতিরিক্ত চাপ কমবে এবং স্কুল পরিচালনা আরও সহজ হবে।

বিশেষ বাজেট বরাদ্দ : বড় স্কুলগুলোর জন্য সরকার বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। এই বাজেটের একটি অংশ দিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বেতন এবং অন্যান্য খরচ মেটানো যেতে পারে। এতে প্রধান শিক্ষকদের অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা তোলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হবে না। এটি প্রধান শিক্ষকদের সততা ও সম্মান রক্ষা করবে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে।

স্কুল পরিচালনা কমিটির ক্ষমতা বৃদ্ধি : সরকার স্কুল পরিচালনা কমিটির (এসএমসি) ক্ষমতা ও দায়িত্বের একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে পারে। এই রূপরেখা অনুযায়ী, স্কুলের প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, প্রধান শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে না, বরং পুরো কমিটি সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এবং তার লিখিত রেকর্ড থাকবে। এতে প্রধান শিক্ষকের ওপর কোনো আইনি চাপ আসবে না।

ডিজিটাল সমাধান ও সরঞ্জাম সরবরাহ : সরকার সকল স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন, সিসিটিভি ক্যামেরা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম সরাসরি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে করে স্কুলের ব্যয় কমবে এবং প্রতিটি স্কুলের মান একই রকম হবে। এসব সরঞ্জাম কিনতে প্রধান শিক্ষকদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে না।

সততা ও জবাবদিহিতার সুরক্ষা : প্রধান শিক্ষকরা যখন স্কুলের কল্যাণের জন্য কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন, তখন তাদের যেন কোনো মিথ্যা অভিযোগের শিকার না হতে হয়, সেজন্য একটি সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। যদি কোনো প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, তাহলে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত সত্য উদঘাটন করতে হবে। পাশাপাশি, যারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এই ধরনের পদক্ষেপগুলো সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকরা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন। এতে করে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, যা শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সরকারের জন্য সম্মানজনক হবে। তাহলেই এই সোনার বাংলায় সোনার প্রজন্মের সোনার মানুষ গড়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষা ব্যবস্থায়ও আসবে সেই কাঙ্খিত পরিবর্তন।

লেখক : রাশেদা আতিক রোজী, ইনস্ট্রাক্টর, উপজেলা প্রাইমারি এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টার (ইউপিইটিসি), হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়