প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২২:১৭
ডিজিটাল ভূত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অনিক, স্বপ্নীল ও তাসনীমকে অনেকদিন ধরে না পেয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। পুলিশের এএসআই করিম বখত এ ব্যাপারে দায়িত্ব পেয়েছে। প্রতিটি থানায় তাদের তিনজনের ছবি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ এ ব্যাপারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ-খবর নিচ্ছে। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে যায়। তাদের কোনো খোঁজ খবর পায়নি।
এদিকে কবিরাজ তাদের মনমতো ওদেরকে ব্যবহার করছে। মাঝে মাঝে অনিক এর মনে পূর্বের সব স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন সে ঘুম থেকে জেগে উঠে।
একদিন এভাবেই ঘুম থেকে জেগে উঠে সে তার টিয়াটাকে পাশে দেখতে পায়। টিয়াটা তাকে বলে : অনিক তুমি এখনও সাবধান হয়, অনিক তুমি সাবধান হও।
অনিক যেনো ঘুমের ঘোরেই টিয়ার কথা শোনে। কিন্তু সে কী করবে বুঝতে পারে না। সে এমন একটা জগতে আছে যে জগতে শুধু কবিরাজের কথাই শোনা যায়, মানা যায়। অন্য কিছুই সে ভালোমতো বুঝতে পারে না।
আরেকদিনও টিয়াটা তাকে বলে : অনিক তোমাকে যাদু-মন্ত্র দিয়ে পোষ মানানো হয়েছে। তুমি জেগে উঠো, তুমি জেগে উঠো।
অনিক টিয়ার কথায় কিছুই বুঝতে পারে না। সে মনে মনে বলে : আমি তো জেগেই আছি। তাহলে আবার জাগবো কীভাবে?
টিয়া বললো : তোমার মা, মামা তোমাকে খুঁজছে। তুমি তাদের কাছে চলে যাও।
অনিক বলে : আরে আমার মা-মামা আবার কে? আমি তো তাদেরকে চিনি না। আমি শুধু কবিরাজকেই চিনি। সে আমাকে যা বলে, আমি তো তাই করি। আর তো কাউকে চিনি না।
টিয়া বললো : তোমাকে যাদু করেছে, মন্ত্র করেছে, তোমার ঘাড়ের পিছনে চীপ বসানো হয়েছে। তোমাকে একটা পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছে কবিরাজ। তুমি বুঝতে পারে না?
হাসলো অনিক। আমি আবার পুতুল হতে যাবো কেনো? পুতুল আবার কি? যাদু, মন্ত্র, চীপ এগুলো আবার কি?
এ সময় কথার আওয়াজ পেয়ে পাশের রুম থেকে ঘুম থেকে উঠে জামশেদ। তারপর এসে দেখলো অনিকের পাশে একটা টিয়া বসে আছে। টিয়াটা তাকে দেখেই জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেলো।
জামশেদকে দেখে অনিকও আবার ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর সে একটা স্বপ্ন দেখলো :
একটা মহিলা কাঁদছে। বাবা অনিক ফিরে এসো, বাবা অনিক ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না বাবা। তোমার মামা তোমাকে খুঁজছে।
আবারও অনিক জেগে উঠে। কিন্তু তার ঘাড়ে খুব ব্যথা করছে। ঘাড়টা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে।
পাশে স্বপ্নীল ও তাসনিম ঘুমিয়ে আছে। কি সুন্দর ঘুম। কিন্তু তার ঘাড়ে এতো ব্যথা কেনো? সে এসব স্বপ্ন কেনো দেখছে? ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো সে।স্বপ্নীল ও তাসনিমের বাবা বোরহান সাহেব বিদেশ থেকে চলে এসেছেন। এয়ারপোর্ট নেমে কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ি চলে আসেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ঘরের দরজায় টোকা মারতেই রুমা বেগম দরজা খুলে তার স্বামীকে দেখেই অবাক হয়ে যান। তারপর তাকে সালাম জানিয়ে ঘরে নিয়ে এসে ঠা-া পানি পান করতে দেন।
মি. বোরহান সাহেব ঘরের চারপাশে তাকান। তারপর বলেন : আমার বাচ্চারা কই?
এ সময় রুমা বেগম কান্না করতে থাকেন। তার চোখ বেয়ে অঝোরধারায় অশ্রু ঝরছে। তিনি সব খুলে বললেন।
প্রচণ্ড ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও রাতে আর বোরহান সাহেব খানা খেলেন না। পরদিন সকাল দশটা বাজতেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সাথে রুমা বেগম।
থানায় এসেই ওসি সাহেবের সাথে কথা বললেন। ওসি সাহেব বেশ ভালো মানুষ। তাঁর নাম ইরফান খান। চট্টগ্রামের মানুষ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলেন। তবে মাঝে মাঝে বেশ শুদ্ধ করেও কথা বলেন মনটা ভালো থাকলে।
আজ তাঁর মন বেশ খুশি। মি. বোরহান সাহেবের আনা মিষ্টির বাক্সটি থেকে একটি একটি করে দশটি মিষ্টি খেলেন। তারপর বললেন : ডায়াবেটিস তো, তাই বেশি মিষ্টি খেতে পারি না ভাই।
মনের মাঝে অনেক দুঃখের বান থাকা সত্ত্বেও ওসি সাহেবের কথায় হাসলেন মি. বোরহান। তারপর বললেন : ডায়াবেটিস না থাকলে তো মনে হয় দুই-তিন বাক্স মিষ্টি খেতে পারতেন, তাই না?
ওসি সাহেবও হাসলেন। বেশ মজার হাসি। তারপর বললেন : ঝা-ুদার কাহিনী মনে আছে?
মি. বোরহান বুঝতে পারছেন, ওসি সাহেব আরও খেতে চাইছেন, কিন্তু ঝা-ুদার কাহিনী মনে করে আর খেতে পারছেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন : ঝাড়ুদার আবার কে?
ওসি ইরফান খান অবাক করা হাসি হাসলেন : আরে ঝাড়ুদার না, ঝাড়ুদার না। ঝা-ুদা। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প।
সম্বিৎ ফিরে পেলেন মি. বোরহান : ওহ, তাই বলেন। এখন মনে পড়ছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর হাসির গল্প ‘রসগোল্লা’র নায়ক ঝা-ুদার কথা বলছেন। হ্যাঁ মনে আছে গল্পটা, তিনি বলতে লাগলেন :
“হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ঝান্ডুদা তামাম ভুঁড়িখানা কাউন্টারের ওপর চেপে ধরে ক্যাঁক করে পাকড়ালেন চুঙ্গিওলার কলার বাঁ হাতে, আর ডান হাতে থেবড়ে দিলেন একটা রসগোল্লা ওর নাকের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে মোটা গলায় বললেন, ‘তুমি খাবে না? তোমার গুষ্টি খাবে। ব্যাটা তুমি মস্করা পেয়েছো? পইপই করে বললুম, রসগোল্লাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, তা তুমি শুনবে না!’ ততক্ষণে কিন্তু তাবৎ চুঙ্গিঘরে লেগে গেছে ধুন্ধুমার। আর চিৎকার-চেঁচামেচি হবেই না কেন? এ যে রীতিমতো বেআইনি কর্ম। কর্মটির জন্য আকছারই জেলে যেতে হয়। ঝা-ুদার কোমর জাবড়ে ধরে আমরা জনাপাঁচেক তাকে কাউন্টার থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছি। তিনি পর্দার পর পর্দা চড়াচ্ছেন, ‘খাবিনি, ও পরান আমার, খাবিনি ব্যাটা।’ চুঙ্গিওলা ক্ষীণকণ্ঠে পুলিশ ডাকছে। কিন্তু কোথায় পুলিশ? চুঙ্গিঘরের পাইক, বরকন্দাজ, ডান্ডাবরদার, আসসরদার, বেবাক চাকর-নফর বিলকুল বেমালুম গায়েব। এ কি ভানুমতি, এ কি ইন্দ্রজাল!”
মি. বোরহানের মুখে একনাগাড়ে গল্পের কিছু অংশ হুবহু শুনে হাসির তুবড়ি ছোটালেন ওসি ইরফান খান। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলেন : আরে, জানাই তো হলো না আপনি থানায় কেনো আসছেন?
এবার কথা বললো রুমা বেগম। তিনি কান্না করতে করতে বললেন : ভাইজান ...।
তাকে থামিয়ে দিলেন ওসি ইরফান খান : বলুন ওসি সাহেব।
কাঁদতে কাঁদতেই রুমা বেগম বললেন : ওসি সাহেব। ওসি সাহেব।
মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না রুমা বেগমের।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে ইঙ্গিত করলেন ওসি ইরফান খান। বললেন : ওনাকে চোখ মোছার জন্য এক পিচ তোয়ালে... দুঃখিত মনে করতে পারছি না.. শাড়ি..। ও মনে পড়ছে, এক পিচ টিসুর ব্যবস্থা করো।
কনস্টেবল : স্যার বুঝতে পারছি তোয়ালে না। শাড়ি। নাকি টিসু আনবো?
ওসি ইরফান খান কটমট করে তাকিয়ে আছেন কনস্টেবলের দিকে। তারপর মনে মনে ভাবছেন যেমন ওসি, তেমনই কনস্টেবল।
একটু ভেবে ওসি ইরফান খান বললেন : যাক সেকথা। এবার আপনিই বলুন মি. বোরহান আপনারা এই মিষ্টিমুষ্টি নিয়ে কেনো এসেছেন?
বোরহান : ভাই, আমার দুটি ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেছে।
ওসি ইরফান খান : আরে মানুষ আবার হারিয়ে যায় কীভাবে? বলুন নিখোঁজ হয়েছে।
বোরহান : হ্যাঁ নিখোঁজ হয়েছে।
ওসি ইরফান খান : থানায় জিডি করেননি?
বোরহান তার স্ত্রী রুমার দিকে তাকালেন। সুমি কাঁদতে কাঁদতে বললো : জিডি করা হয়েছে ভাই।
ওসি ইরফান খান : আরে, কয়বার বলি, আমারে ভাই কইতে বইলছে কেডা? স্যার বলিয়েন।
রাগ উঠলে ওসি সাহেব বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেন। কারণ এ পর্যন্ত তিনি ৬৪ জেলার মধ্যে ১৪ জেলায়ই পোস্টিং পেয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মানুষের কথা শুনতে শুনতে রাগ উঠলে সবার জেলার আঞ্চলিক ভাষা একত্র করে ফেলেন। তখন তার অধিনস্তরা বুঝতে পারেন, তিনি রেগে গেছেন। সবাই সচেনত হয়ে যান। তবে বড় কর্তাদের কাছে গেলে তাকে যা ইচ্ছে তাই বলে তখন তিনি নীরব থাকেন। কারণ না হলে তার মুখ দিয়ে ১৪ জেলার ভাষা বের হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে মুখটা চেপেও রাখেন। কারণ নিজের হাতকেই মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না, মুখতে বিশ্বাস করবে কি করে?
বোরহান : ওসি সাহেব। আমার ছেলেমেয়েগুলো ...।
ওসি ইরফান খান : আরে পাইবেন। পাইবেন না বলছি। এই কে আছিস? ওনাদের ফাইলটা নিয়ে আয়।
মেজাজ গরম থাকলে ওসি সাহেব তুই তোকারি বেশি করেন। আর যারা এই ভাষা শুনে তখন তাদের দৌড়ের মাত্রা বেড়ে যায়।
এ সময় দায়িত্বরত এএসআই করিম বখত ফাইল নিয়ে এগিয়ে এলেন। তাকে দেখেই ধমকে উঠলেন ওসি সাহেব। তারপর বললেন : এরা জিডি করেছে কয় মাস হলো?
এএসআই করিম বখত কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দিলো : মাত্র ছয় মাস স্যার।
ওসি ইরফান খান : আরে বলেন কি? ছয় মাসকে আবার মাত্র বলেন কেনো?
ওসি সাহেবের আরেকটি গুণ হলো তিনি আরো বেশি রেগে গেলে জুনিয়রদেরকেও আপনি আপনি বলে সম্বোধন করেন। তার সহকর্মীরা তখন বুঝতে পারেন, ওসি সাহেবের মেজাজ এবার সপ্তমে। এবার রক্ষা নাই।
হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে উঠে গ্লাস করা টেবিলে একটা ঘুশি মেরে বলে উঠলেন ওসি ইরফান খান : এই তোমাকে চাকুরি দিয়েছে কে? এই লোকটার দুটি ছেলেমেয়ে নিখোঁজ হয়েছে ছয় মাস হয়েছে, তোমরা কি থানায় বসে আঙ্গুল চুষছো?
এ সময় রুমা বেগমের কান্না আরও উঠলে উঠলো। ওসি তার দিকে চোখ লাল করে কটমট করে তাকাচ্ছেন, আর এএসআই করিম বখত এর দিকে ঘুরছেন।
এএসআই করিম বখত এ অবস্থা দেখে বললো : স্যার আমরা সব থানায়ই খবর পাঠিয়েছি। কিন্তু ...
মেজাজ সপ্তমে ওসি সাহেবের। হঠাৎ করেই বলে উঠলেন : যাও ওরা দেখো গিয়ে ভিক্ষা করছে।
কথাটা বলেই তিনি বলে উঠলেন : ইউরেকা ইউরেকা।
এএসআই করিম বখত : স্যার নিউটন পেয়েছেন?
ওসি ইরফান খান : ওরে আমার বোকার দল। নিউটন তো নাইরে, আমি তো আসল ঘটনা পেয়ে গেছি। কমলাপুর স্টেশনে আমার বাবা মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। তিনটা ছেলেমেয়েকে ভিক্ষা করতে দেখেছি।
এবার রুমা বেগম কান্না থামালেন। তারপর অবাক হয়ে বললেন : ভাইজান হ, তিনটাই। আমাদের পাশের বাসার একটা ছেলেও আছে নাম অনিক।
ওসি ইরফান খান : মিলে গেছে। এএসআই করিম বখত জলদি গাড়ি নামাও। (চলবে)