প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫, ১৪:১৯
তারাবির নামাজ ৮ রাকাত নয়, ২০ রাকাত
মুফতি আব্দুল আলী ক্বাদেরী

৮ রাকাত নয়, সহীহ হাদিসের ভিত্তিতে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়বো, ইনশাআল্লাহ।
তারাবির নামাজ রাসুলুল্লাহ (দ.)-এর ৪ জন প্রধান খলিফা, সাহাবীদের, তাবেয়ীদের ও ৪ মাযহাবের ইমামগণের মতেÑ
রামাদান মাসের রাতে ইশার নামাজের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে তারাবি নামাজ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করতে হয় এবং দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয়। এজন্য এই নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
রামাদান মাসের নির্দিষ্ট নামাজ হচ্ছে সালাতুত তারাবিহ। তারাবি নামাজ জামাতে পড়া (নারীদের বাসায় পড়তে হবে) ও সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ (দ.) নিজে তারাবির নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবির নামাজের রাকাতের বিষয়ে বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, সর্বজন সমর্থিত হলো ২০ রাকাত।
তারাবীহর নামাজ ৮ রাকায়াত মনে করাটাই বেদায়াত। আর ৮ রাকায়াত মনে করে এর উপর আমল করা হল বেদায়াতের উপর আমল করা। ১৪০০ বছর পর পথভ্রষ্ট ব্যক্তির ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে ৮ রাকায়াত তারাবীহর সূচনা ঘটে মুসলিম উম্মাহের কিছুর মধ্যে। যখন এই বেদায়াত আমলের দলিল বুখারী থেকে দেওয়া হয় তখন অবশ্যই এর বিরোধিতা ব্যাপকভাবে হওয়া চাই। সাধারণ মানুষ যেন গুটিকয়েক লোকের কথার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবস্থান থেকে ছিটকে না পড়ে।
২০ রাকাত তারাবি নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রামাদানের রাতে তারাবি নামাজ আদায় করে, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ মাহে রামাদানে রোজা, তারাবি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুন আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। রাসুলুল্লাহ (দ.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রোজা রাখে, তারাবি নামাজ পড়ে এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁর জীবনের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসুলুল্লাহ (দ.) সর্বদা তারাবি নামাজ জামাতে পড়েননি। কারণ, নবীজি (দ.) মনে করেছিলেন যে যদি তিনি সর্বদা জামাতে তারাবি নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতের উপর এটি যে এটা ফরজ হয়ে যেতে পারে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (দ.) আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা রামাদানের রোজাগুলো ফরজ করেছেন এবং এর রাতে তারাবি নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে অশেষ পুণ্যের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’
আল্লাহ আমাদের তারাবির নামাজের অপরিসীম ফজিলত এবং জামাতে খতম তারাবি আদায়ের মাধ্যমে অধিক পুণ্য লাভের তাওফিক দান করুন! আমিন!
সাহিহ হাদিসে তারাবির নামাজ
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (দ.) রমজান মাসে বিশ রাকাত এবং বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২/২৯৪, হাদিস নং-৭৬৯২, মুসনাদে আব্দবিন হুমাইদ-২১৮, আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-১২১০২, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদিস নং-১৭২, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদিস নং-৪৩৯১}
এবার দেখার বিষয় হল, উম্মতের ঐক্যমত্বের আমল এর উপর আছে কি নেই? যদি দেখা যায় যে, উম্মতের আমল এর উপরই। তাহলে আমল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার দ্বারা উক্ত হাদিস সহীহ হয়ে যায়।
ওমর (রা.)-এর আদেশ : হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়ার হুকুম দিলেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২/২৯৩}
হযরত ওমর (রা.)- এর শাসনামল
হযরত সায়েব বলেন, হযরত ওমর (রা.)-এর সময়কালে বিশ রাকাত তারাবীহ ছিল। {ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬} যার সনদ বুখারীতে দুই স্থানে আছে।
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ (রা.) বলেন, আমরা হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতির পড়তাম। {সুনানে সুগরা লিল বায়হাকী, হাদিস নং-৮৩৩, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদিস নং-১৪৪৩}। ইমাম নববী (রহ.), সুবকী (রহ.) [শরহুল মিনহাজ], মোল্লা আলী কারী (রহ.) [শরহুল মুয়াত্তা] ও সুয়ুতী (রহ.) এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।
মুহাম্মদ বিন কাব কুরজী বলেন, ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে লোকেরা রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতির পড়তো।
হযরত ইয়াজিদ বিন রূমান বলেন, লোকে হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির রমজান মাসে আদায় করতো। {মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদিস নং-১৪৪৩, মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং-৩৮০, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদিস নং-৪৩৯৪}
হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত। হযরত ওমর (রা.) লোকদেরকে হযরত উবায় বিন কাব (রা.)-এর কাছে একত্র করে দিলেন। আর তিনি লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। {সুনানে আবু দাউদ-১/২০২, সিয়ারু আলামিন নুবালা-১/৪০০}
হযরত উবায় বিন কাব (রা.) বলেন, হযরত ওমর (রা.) আমাকে এই মর্মে আদেশ দিলেন যে, আমি যেন লোকদেরকে তারাবীহ পড়াই। তখন বিশ রাকাত পড়া হতো। {কানযুল উম্মাহ-৮/২৬৪}। ইমাম বায়হাকী, আল্লামা বাজী, কাশতাল্লানী, ইবনে কুদামা, ইবনে হাজার মক্কী, তাহতাবী, ইবনে হুমাম, বাহরুর রায়েক প্রণেতা (রহ.) প্রমুখগণ এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহের উপরই সকলের সিদ্ধান্ত স্থির হয়। এবং এভাবেই চলতে থাকে।
ইংরেজ আমলের পূর্বে কোন একজন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ এটাকে অস্বীকার করেননি। আর সুন্নত হওয়ার জন্য সেটির নিরবচ্ছিন্ন হওয়া শর্ত। তাই এই বিশ রাকাত তারাবীহ সুন্নতে ফারূকী হয়েছে। এ সেই ওমর (রা.), যার ব্যাপারে রাসূল (দ.) এরশাদ করেছেন যে, যদি আমার পর কোন নবী হতো তাহলে নবী হতো ওমর (রা.)। তিনি আরো বলেছেন, দ্বীনের ব্যাপারে সবচে’ মজবুত হলেন ওমর (রা.)। রাসুল (দ.) আরও বলেছেন, ওই সত্তার কসম, যার আয়ত্বে আমার প্রাণ, শয়তান কখনো তোমার (ওমর রা.) চলার পথে তোমার সঙ্গে মিলিত হয়নি। বরং তোমার রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় চলে গেছে। মুসলিম শরীফ, ৭ম খণ্ড-হাদিস নম্বর-৬০২৫। সুবহানআল্লাহ।
এছাড়া ওমর ইবনে খাত্তাবকে (রা.) রাসুল (দ.) তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন বলেছেন। যার অর্থ-গোপন প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত। তত্ত্বজ্ঞানকে আরবিতে ইলহাম বলা হয়। মহান আল্লাহ্ রব্বুল আ’লামিন হযরত ওমরকে (রা.) এমন সুক্ষ জ্ঞান দান করেছেন যে তিনি বিভিন্ন সময় যে মতামত ও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন পরে তা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রিয় নবীজি (দ.) তাঁর পরে হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত ওমরের (রা.) অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হুজাইফা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, আমার পরে তোমরা তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমরের অনুসরণ করবে। তিরমিজি, ষষ্ঠ খণ্ড-হাদিস নম্বর-৩৬০১।
হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা.) যার এতো মর্যাদা, যিনি এতো জ্ঞানের অধিকারী সেই ওমরই (রা.) তারাবির নামাজ বিশ রাকআত জামায়াতে পড়ার প্রচলন করেন যদি বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ বিদআত হয়, তাহলে হযরত ওমর (রা.)সহ সে সময়কার সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের বিদআতি হওয়ার আবশ্যক হয়! নাউযুবিল্লাহ।
হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামল
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেন, হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। আর হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে লম্বা কেরাতের কারণে লাঠির উপর ভর দিতেন। {বায়হাকী-৪/২৯৬}। হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলের কেউ বিশ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলেছে এমন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না।
হযরত আলী (রা.)-এর শাসনামল
হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী বলেন, হযরত আলী (রা.) রমজান মাসে কারীদের ডাকতেন। তারপর তাদের মাঝে একজনকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর বিতরের জামাত হযরত আলী নিজেই পড়াতেন। {বায়হাকী-৪/৪৯৬}। হযরত আবুল হাসনা বলেন, হযরত আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়াতে হুকুম দিয়েছেন। {সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদিস নং-৪৮০৫, ৪৩৯৭, কানযুল উম্মাল, হাদিস নং-২৩৪৭৪}। এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বিশ রাকাতওয়ালা নামাজের নাম তারাবীহ হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন। কোন খোলাফায়ে রাশেদীন বা কোন সাহাবী আট রাকাতের সাথে তারাবীহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। হাদিস ভাণ্ডারে এর কোন প্রমাণ নেই।
হযরত জায়েদ বিন ওহাব বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) আমাদের তারাবীহ পড়িয়ে ফারিগ হতেন এমতাবস্থায় যে, তখনো রাত অনেক বাকি থাকতো, ইমাম আমাশ বলেন, তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ আর তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। {কিয়ামুল লাইল-১৫৭}।
জমহুর ও মশহুর সাহাবাগণ (রা.) : হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ.), হযরত ইবরাহীম [মৃত্যু-৯৬হিজরি] থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় লোকেরা [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তো। {কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ}
হযরত আব্দুল আজীজ বিন রফী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত উবায় বিন কাব (রা.) লোকদেরকে রমজান মাসে মদিনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির নামাজ পড়াতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
হযরত আতা [মৃত্যু-১১৪ হিজরি] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি লোকদের [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির পড়তে দেখেছি। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
তাবেঈদের মতে তারাবির নামাজ : হযরত সুয়াইদ বিন গাফালা যিনি বয়সে রাসূল স্বাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলেন। তিনি ইমামতি করাতেন। হযরত আবুল হাজীব বলেন, হযরত সুইয়াইদ বিন গাফালা রমজান মাসে আমাদের জামাতের সাথে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাত নামাজ পড়াতেন। {বায়হাকী-২/৪৯}। হযরত আবুল বুখতারী (রহ.) বলেন, তিনি রমজানে বিশ রাকাত ও তিন রাকাত বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদিস নং-৭৬৮৬}
বাইতুল্লাহ শরীফে বিশ রাকাত তারাবীহ : মক্কা মুকাররমায় হযরত আতা বিন আবী রাবাহ (রহ.) [ইন্তেকাল ১১৪ হিজরি] বলেন, তথা আমি লোকদের [সাহাবা ও তাবেয়ীগণ] বিতির নামাজসহ ২৩ রাকাত পড়তে দেখেছি। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}। আর ইমাম ইবনে আবী মালিকাহ [ইন্তেকাল ১১৭ হিজরি] লোকদের মক্কায় বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) [ইন্তেকাল ২০৪ হিজরি] বলেন, আমি স্বীয় শহর মক্কায় লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া অবস্থায়ই পেয়েছি। {তিরমিজী-১/১৬৬}। আর আজ পর্যন্ত মক্কা মুকাররমায় বিশ রাকাত তারাবীহই পড়া হচ্ছে।
মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ : মদিনা তায়্যিবাহর মাঝে হযরত ওমর (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহই পড়া হতো। আজো মদিনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাত তারবীহই পড়া হয়। হযরত আয়শা (রা.) ও মদিনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করতেন। তিনিই রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর এ ফরমান বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের মাঝে বেদআত বের করবে, তার কাজটি পরিত্যাজ্য। যদি বিশ রাকাত তারাবীহের নামাজ বিদআত ও নাজায়েজ হতো, তাহলে হযরত আয়শা (রা.) বছরের পর বছর এর উপর চুপ করে বসে থাকতেন না। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) ও মদিনায় অবস্থান করছিলেন। তিনি ঐ হাদিসের রাবী। যাতে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি বিদআত গোমরাহী আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষেপকারী। অথচ তারই সামনে অর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়া হচ্ছিল, অথচ তিনি এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। এটা হতেই পারে না।
বিশ্ববিখ্যাত চার ইমাম (রহ.)-এর বক্তব্য : শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী (রহ.) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। এ চার ইমামের মাঝে প্রথম ইমাম হলেন ইমাম আবু হানীফা (রহ.) [ইন্তেকাল ১৫০ হিজরি], তিনি ও বিশ রাকাত তারাবীহের প্রবক্তা। [ফাতাওয়া কাজীখান-১/১১২}। ইমাম মালিক (রহ.)-এর একটি বক্তব্য বিশ রাকাতের পক্ষে, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাতের পক্ষে। [যাতে বিশ তারাবীহ আর ১৬ রাকাত নফল]। হেদায়াতুল মুজতাহিদ-১/১৬৭)।
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বিশ রাকাতের প্রবক্তা। {আলমুগনী-২/১৬৭}। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর মুখতার বক্তব্যও বিশ রাকাতের পক্ষে। [আলমুগনী-২/১৬৭}। চার মাযহাবের ফিক্বহের ইবারতের মাঝে কোন একটি ইবারতেও শুধু আট রাকাত তারাবীহকে সুন্নত আর বিশ রাকাততে বিদআত বলা হয়নি। কেউ কেউ বুখারী শরিফের একটি হাদিসকে ভুল বুঝে ৮ রাকাত তারাবির কথা বলে থাকেন। কিন্তু হাদিসটি তাহাজ্জুদের নামাজের, তারাবির নয়।
হযরত আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি আয়েশা (রা.)-এর কাছে জানতে চান নবীজী (দ.)-এর নামাজ রামাদান মাসে কেমন হতো? (উক্ত প্রশ্নকারী এই জন্য এই প্রশ্ন করেছিলেন যে রামাদান এ ২০ রাকাত তারাবি পড়ার পরেও কি রাসুলুল্লাহ (দ.) রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ সম্পূর্ণ পড়তেন নাকি কম?) তিনি বললেন, রাসূল (দ.) রামাদান ও রামাদান ব্যতীত [মা আয়েশা (রা.] এমন নামাজের কথা বলছেন যেটা রমাদান বাদেও পড়া যায়, আর সেটাই হলো তাহাজ্জুদ যেটা ১২ মাসই পড়া যায়) ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেওনা। তারপর পড়তেন ৪ রাকাত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেওনা, তারপর পড়তেন ৩ রাকাত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন, হে আয়েশা! নিশ্চয় আমার দু চোখ ঘুমায় আমার কলব ঘুমায় না। (সহীহ বুখারী-১/১৫৪)। আসল কথা হল এই যে, এই হাদিসটি তাহাজ্জুদ নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। এতে তারাবীহের কথা বর্ণিত নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা হলো।
হাদিসের শব্দ : (নবীজী (দ.) রামাদান ও রামাদান ব্যতীত অন্য সময় বাড়াননি) এটাই বোঝাচ্ছে যে, প্রশ্নটি করা হয়েছিল রামাদান ছাড়া অন্য সময়ে যে নামাজ নবীজী পড়তেন তা রামাদানে বাড়িয়ে দিতেন নাকি কমিয়ে দিতেন? এই প্রশ্নটি এজন্য করা হয়েছে যেহেতু বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে রাসূল (দ.) রামাদানে আগের তুলনায় অনেক নামাজ পড়তেন ও ইবাদত করতেন, তাই এই প্রশ্নটি করাটা ছিল স্বাভাবিক। আর রামদান ছাড়া কি তারাবীহ আছে? নাকি ওটা তাহাজ্জুদ? তাহাজ্জুদ হওয়াটাই কি সঙ্গত নয়? সুতরাং এটাই স্পষ্ট বোঝা যায় তারাবীহ নয় প্রশ্ন করা হয়েছে তাহাজ্জুদ নিয়ে যে, নবীজী তাহাজ্জুদের নামাজ রামাদান ছাড়া যে ক’ রাকাত পড়তেন তা থেকে রামাদানে বাড়িয়ে পড়তেন কিনা? এর জবাবে আয়েশা (রা.) বললেন, ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না তাহাজ্জুদ নামাজ। এই হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত হল নবীজী (দ.) এক সালামে ৪, ৪ রাকাত করে তাহাজ্জুদ আর শেষে এক সালামে ৩ রাকাত বিতর পড়েছেন, অথচ ৮ রাকাতীদের আমল এর বিপরীত। তারা তারাবীহ দুই দুই রাকাত করে পড়ে। আর বিতর এক রাকাত বা তিন রাকাত দুই সালামে পড়ে। সুতরাং যেই হাদিস দলিলদাতাদের কাছেই আমলহীন, তাহলে এর দ্বারা দলিল তারা কিভাবে দিতে পারে?
এই হাদিসের শেষাংশে এই শব্দ আছে যে, (তারপর আয়েশা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার আগে ঘুমান?) এই বিষয়টি তারাবীহ এর ক্ষেত্রে কল্পনাতীত যে নবীজী (দ.) তারাবীহ নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন আর সাহাবীরা বিতর পড়ার জন্য নবীজীর জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন। বরং এটি তাহাজ্জুদ এর ক্ষেত্রে হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয়কি?
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। বরং তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ বিন নসর মারওয়াজী তার কিতাব “কিয়ামুল লাইল”-এর (রামযানে ইমাম কত রাকাত তারাবীহ পড়বে) অধ্যায়ে অনেক হাদিস আনলেও আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এই হাদিসটি সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আনেননি। সাথে এদিকে কোন ইশারাও করেননি।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর রাকাত সংখ্যার অধ্যায়ের পরিবর্তে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম বুখারী (রহ.) তার প্রণিত বুখারী শরীফে এই হাদিসটি নিম্নবর্ণিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন,
(ক) বিতর অধ্যায়-(১/১৩৫)
(খ) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাতে (নামাজের উদ্দেশ্যে)
দাণ্ডয়মানতা রামদানে ও রামদান ছাড়া-(১/১৫৪)
(গ) রামদানে (নামাজের উদ্দেশ্যে) দণ্ডায়মানতার ফজিলত অধ্যায়-(১/২৬৯)। প্রথম অধ্যায়ে বিতরের রাকাত সংখ্যা আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাহাজ্জুদ রামাদানে বেশি পড়তেন কিনা তা জানা আর তৃতীয় অধ্যায়ে রামাদানে বেশি বেশি নামাজের ফজিলত আর বর্ণনা জন্য হাদিস আনা হয়েছে। তারাবীহের রাকাত সংখ্যা বোঝানোর জন্য কোথায় এসেছে এই হাদিস?
আজকাল কিছু নব্য ফিতনাকারী বলে থাকে তাহাজ্জুদ তারাবীহ একই”! তাদের এই দাবিটি সম্পূর্ণরূপে ভুল নিম্নবর্ণিত কারণেÑ
১. মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাহাজ্জুদ ও তারাবীহের অধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন লিখেছেন। তাহাজ্জুদের মাঝে ডাকাডাকি জায়েজ নয় তারাবীহতে জায়েজ।
২. তাহাজ্জুদ নামাজের হুকুম কুরআন দ্বারা প্রমাণিত যথা সূরা ইসরার ৭৯নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑঅর্থাৎ ‘আর রাতে তাহাজ্জুদ পড় এটি তোমার জন্য নফল, অচিরেই তোমাকে তোমার রব প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবে’ ও সুরা মুযাম্মিলের ২নং আয়াতে। আর তারাবীহের ব্যাপারে আল্লাহর নবী (দ.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা রামাদানের রোজা তোমাদের উপর ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের উপর এতে কিয়াম করাকে সুন্নত করেছি (সুনানে নাসায়ী-১/৩০৮,৩৩৯)। সুতরাং বোঝা গেল তাহাজ্জুদ আল্লাহর আয়াত আর তারাবীহ নবীজীর (দ.) বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। তারাবীহের সময় ঘুমানোর আগে কিন্তু তাহাজ্জুদের সময় নির্ধারিত নয় তবে উত্তম ঘুমের পর।
৩. তাহাজ্জুদের হুকুম মক্কায় হয়েছে আর তারাবীহের হুকুম মদিনায় হয়েছে। বুখারী ও মুসলিমের দ্বারা বলা হয় হয় যে, নবী (দ.) শুধুমাত্র মদিনায় তিনদিন জামায়াতে তারাবীহ পড়েছেন, তারপর তিনি এ ভয়ে আর পড়েননি যে তারাবীহ ওয়াজিব হয়ে যেতে পারে। এখানে লক্ষ্য করুন তাহাজ্জুদের বাধ্যতামূলক ইতোমধ্যে মক্কায় রহিত করা হয়েছিল। কেননা মা আয়েশা (রা.) উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তাহাজ্জুদের (সূরা মোজাম্মিল যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে) এই নামাজ ঐচ্ছিক করে দিয়েছেন, প্রারম্ভে এটি বাধ্যতামূলক করেছিলেন। (মুসলিম, ১:২৫৬)। এখন, যদি তাহাজ্জুদ এবং তারাবীহ একই হতো, তাহলে কেনো রাসুলুল্লাহ (দ.) মদিনায় তা বাধ্যতামূলক হওয়ার ভয় পেতেন? যখন এটি অনেক আগেই মক্কায় রহিত হয়ে গেছে? এছাড়া আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি যেই নামাজ আমাদের সাথে পড়তেন না’। বুখারী ১-১০১। এই হাদিসটি আরো স্পষ্ট করে দেয় যে, রাসুলুল্লাহ (দ.) যে নামাজ জামাতে পড়তেন তাহলো তারাবীহ, আর যেটা একাকি নিজ বাসায় পড়তেন তাহলো তাহাজ্জুদ।
৪. ইমাম আহমাদ (রহ.) ও তারাবীহ তাহাজ্জুদ আলাদা বিশ্বাস করতেন (মাকনা-১৮৪)।
৫. ইমাম বুখারী (রহ.)-এর ক্ষেত্রে বর্ণিত তিনি রাতের প্রথমাংশে তার সাগরীদদের নিয়ে তারাবীহ পড়তেন আর শেষ রাতে একাকি তাহাজ্জুদ পড়তেন। (ইমাম বুখারী (রহ.)-এর জীবনী)।
৬. তাহাজ্জুদের নির্দিষ্ট রাকাতসংখ্যা রাসূল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত অর্থাৎ বিতরসহ বেশি থেকে বেশি ১৩ রাকাত আর কমপক্ষে ৭ রাকাত। আর তারাবীহর রাকাতসংখ্যার ক্ষেত্রে খোদ আহলে হাদিস ইমামদের সাক্ষ্য যে এর কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নবীজী (দ.) থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। কিছু মানুষ আপনাকে বলবে যে সৌদিআরবে অধিকাংশ মসজিদে ৮ রাকাত তারাবীহ হয়। তাকে বলুন যে, ইসলাম চলে কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে, সৌদির সংবিধান দিয়ে নয়। এছাড়া এমন একটিও আয়াত বা হাদিস নেই যেখানে আল্লাহ বা তাঁর রাসুল (দ.) সৌদিকে অনুসরণ করতে বলেছেন। ইসলামে সৌদি বা অন্য কোন দেশ অনুসরণযোগ্য নয় শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত। এছাড়াও মক্কা ও মদিনায় এখনোও ২০ রাকাত তারাবীহর প্রচলন আছে। আল্লাহ এই নব্য জন্ম নেয়া পথভ্রষ্ট দল থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের হিফাযত করুন। আমিন।
যে মাসে এক রাকাত নফল নামাজে এক রাকাত ফরজ নামাজের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেই মাসে আমরা সুন্নতে মুয়াক্কাদা পরতে কেনো কাটাকাটি করবো? তাই আমরা সবাই আল্লাহ ও তার রাসুলের (দ.) সন্তুষ্টির জন্য, নিজের গুনাহ মাফ করানোর জন্য সম্পূর্ণ ২০ রাকাত তারাবি পড়ে নিজের গুনাহের মাগফিরাত করিয়ে নিবো।
এলো মাহে রমজান, হিজরি ১৪৪৬
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে এলো পবিত্র মাহে রমজান। শাবান মাসের শেষে দেশের আকাশে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখার মাধ্যমে শুরু হলো বরকতময় এ মাস। রাসূল সা. চাঁদ দেখে রমজান শুরু এবং ঈদুল ফিতর পালন করতে বলেছেন। শনিবার (১ মার্চ) সন্ধ্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে রমজানের চাঁদ দেখার খবর জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ফলে দেশের মসজিদগুলোতে আজ প্রথম তারাবির নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। মুসল্লিরা উৎসবমুখর পরিবেশে তারাবির নামাজে অংশগ্রহণ করবেন।
রমজান মাস আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অসীম রহমত ও বরকত নিয়ে আসে। এ মাস আত্মার পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের মাস।
মহান আল্লাহ তায়ালা যতগুলো শরিয়ত নাজিল করেছেন, তার প্রতিটিতেই ছিল সিয়াম সাধনা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ও ফরজ। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরিদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো বা মোত্তাকি হতে পারো।’
এ মাসের অন্যতম প্রধান ইবাদত হলো রোজা রাখা। শরিয়তের ভাষায় রোজা বলা হয়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, যৌনকর্ম এবং আল্লাহ ও তার রসুলের নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।
রমজান মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম পবিত্র মাস। এ মাস সকল মুসলমানকে নিয়ে আসে এক বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায়। এক নাগাড়ে ক্রমাগত ত্রিশটি দিন, সাতশ’ বিশ ঘণ্টার কঠিন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করা হয়।
শেষ রাতে জেগে ‘সেহরি’ খাওয়া, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকা, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা, তারপর রাতের একটি বিশেষ অংশ ‘তারাবি’ নামাজে অতিবাহিত করা।
এভাবে দীর্ঘ ত্রিশটি দিন ধর্মপ্রাণ রোজাদারদের প্রশিক্ষণ চলে। এ প্রশিক্ষণ আর কিছু নয়, এ হলো আল্লাহর প্রতি আশরাফুল মাখলুকাত মানব সন্তানদের পরম আনুগত্য, সংযম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আন্তরিকতার অনুশীলন।
এ মাসে মুমিন বান্দার জন্য বিশেষ পুরস্কার হলো ইবাদতের সহজতার জন্য আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে পুরো মাস বন্দি করে রাখেন।
রাসুলে করিম সা. বলেছেন, মাহে রমজান এলে এর প্রথম রাত থেকে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। জাহান্নামের সব কটি দুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় পবিত্র জান্নাতের সব কটি দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং একজন ফেরেশতা ঘোষণা করতে থাকেন, ‘হে কল্যাণকামী অনুসন্ধানী! তুমি অনুসন্ধান কর ও এগিয়ে চল। আর অকল্যাণকামী পাপাত্মাদের বলতে থাকেন, তুমি থাম।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।
রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করা সুন্নত। এই দশদিনের একদিন মহাপুণ্যময় একটি রাত রয়েছে। রাতটিকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। অনেকের মতে, ২৭ তারিখ রাত লাইলাতুল কদর। কারও কারও মতে শেষ দশদিনের যেকোনো বেজোড় রাত।
রাসুল সা. বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর’ রমজানের শেষ দশদিনে অনুসন্ধান কর। তাই আমাদেরকে ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ এ রাতগুলো মহিমাময় রাত মনে করে এবাদত করা উচিত।
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হাজার রাতের চাইতে শ্রেষ্ঠ এ পবিত্র রাত লাইলাতুল কদরের রাত পেয়েও যে ব্যক্তি তাকে কাজে লাগাতে, পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারল না, বঞ্চিত হলো সে দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণকামী কাজ থেকে। তার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই।’ (ইবনে মাজাহ)। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।
ছবি-১১
রমজানের মাসআলা-মাসায়িল
মাওলানা তোফায়েল গাজালি
এলো মাহে রমজান। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের এ মাসে খোদার করুণায় সিক্ত হবে মুমিনের হৃদয়। গতকাল ১ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে রমজানের চাঁদ দেখা গেছে। আজ ২ মার্চ রোববার থেকে শুরু হলো মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা।
আত্মশুদ্ধির মাস
মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার রমজান। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্ম উন্নয়নের চেতনায় জীবনের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের জন্য করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের অফুরান ভাণ্ডার নিয়ে আসে রমজান। প্রিয় নবি (সা.) এ মাসকে ‘শাহরুন আজিম’ মহান সম্মানিত মাস এবং ‘শাহরুম মোবারক’ বরকতময় মাস নামে আখ্যায়িত করেছেন।
নবি কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবেকদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে তারও পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। (বোখারি শরিফ ১/২৫৫, মুসলিম শরিফ ১/২৫৯, মেশকাত শরিফ ১/১৭৩)।
তাৎপর্য
হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, শাবান মাসের শেষ দিনে নবি কারিম (সা.) মিম্বরে বসে বলেন, হে লোকজন! তোমাদের ওপর এক মহা ও বরকতময় মাস আগত প্রায়। এমন মাস, যার মধ্যে এমন একটি রাত (শবেকদর) আছে যা হাজার মাস থেকে উত্তম। (অর্থাৎ ওই এক রাতের ইবাদতের সওয়াব হাজার মাসের থেকে বেশি) আল্লাহতায়ালা এ মাসে দিনেরবেলা রোজা ফরজ করেছেন আর রাতে ইবাদতকে করেছেন নফল। এ মাসে যে ব্যক্তি নেক আমলের দ্বারা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনে প্রত্যাশী হবে, তার অবস্থা এরূপ যে, কেমন যেন সে অন্য মাসে ফরজ আদায় করেছে। অর্থাৎ নফলের সওয়াব ফরজের সমতুল্য হবে। আর যে ব্যক্তি এ মোবারক মাসে কোনো ফরজ আদায় করবে তার অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব হবে।
অর্থাৎ রমজানে এক ফরজের সওয়াব সত্তর গুণ বেড়ে যায়। রমজান সবরের মাস, আর সবরের সওয়াব ও বদলা হলো জান্নাত। এ মাস মানুষের সঙ্গে সদাচার ও কল্যাণকামিতার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা মিলবে। সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের সওয়াব কম করা ছাড়াই ইফতার করানো ব্যক্তি রোজার অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাদের মধ্যে অনেক মানুষ এমন রয়েছে, যাদের এ সামর্থ্য নেই যে, তারা অন্যকে ইফতার করাবে, আর এমন সওয়াব লাভ করবে। এ প্রশ্ন শুনে নবি কারিম (সা.) এমন জওয়াব দিলেন যা শুনে তাদের হতাশা ও কষ্টগুলো আশা এবং আনন্দে পরিণত হলো। তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা এসব পুরস্কার ওইসব ব্যক্তিদেরও দেবেন, যারা কোনো রোজাদারকে এক ঢোক দুধ, একটি খেজুর, এমনকি এক ঢোক পানি পান করাবে। তবে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহতায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন আমার হাউজে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন যে, তারপর চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশের আগে তার আর পিপাসা লাগবে না। এরপর নবি কারিম (সা.) বলেন, রমজান এমন মাস, যার প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত আর শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির। যে ব্যক্তি এ মাসে তার গোলাম (কর্মচারী, চাকর, এক কথায় অধীনস্থ প্রত্যেক ব্যক্তি) থেকে কাজের বোঝা বা দায়িত্ব হালকা করে দেবে আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। হে লোকজন! এ মাসে চারটি জিনিসের ওপর খুব গুরুত্ব দাও এবং বেশি বেশি করে করো। ১. কালিমা তাইয়্যেবা-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ২. ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা। ৩. জান্নাত চাওয়া। ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করা। (মেশকাত শরিফ : ১/১৭৪, বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান ৩/৩০৫)।
প্রতিদান
মহানবি (সা.) বলেন, ‘রোজার প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই দেবেন এবং বিনা হিসাবে দেবেন।’ [বোখারি শরিফ হাদিস ১৮৯৪]। আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে কিয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। [মুসনাদে বাজজার হাদিস : ১০৩৯]। ‘রোজা হলো জান্নাত লাভের পথ’। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৩৩২৪]। ‘রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ’। [মুসনাদে আহমদ হাদিস, ১৪৬৬৯]। ‘রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত। [বুখারি হাদিস-১৯০৪]। এ ছাড়া আরও অনেক হাদিসে রোজার বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
রোজার নিয়ত
রোজার নিয়তের জন্য মুখ দিয়ে নির্ধারিত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করা জরুরি নয়। বরং অন্তরের ইচ্ছাই যথেষ্ট। এমনকি রোজার জন্য সেহরি খাওয়াটাও নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। কিছু লোক আরবিতে রোজার নিয়ত করাকে আবশ্যকীয় মনে করে থাকেন অথচ তা সঠিক নয় (জাওয়াহিরুল ফিক্হ ১/৩৭৮)। তবে আরবি নিয়ত করলে অসুবিধা নেই।
প্রত্যেক রোজার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিয়ত করা জরুরি (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৯৫)। অর্ধ দিনের আগে নিয়ত করলে রোজা বিশুদ্ধ হয়ে যাবে (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৯৫)।
আরবিতে : নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম।
বাংলায় : হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব, তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোজা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
রোজা ভঙ্গের কারণগুলো
রোজা অবস্থায় অসুস্থতার কারণে ইনহেলার ব্যবহারের দ্বারা রোজা ভেঙে যায় [শামি ৩/৩৬৬]। রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত বমি করা বা মুখে বমি চলে আসার পর তা পরিমাণে অল্প হলেও ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে [মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক ৪/১৯৭]। যদি নাশিকা দিয়ে রক্ত বের হওয়ার পর মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [তাতারখানিয়া ৩/৩৮৩]। রোজাদার যদি মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর এমতাবস্থায় সুবহে সাদিক হয়ে যায় ও পানের কিছু অংশ পেটে চলে যায়, তাহলে তার রোজা হবে না। পরে কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [শামি ৩/৩৭৪]। কুলি করার সময় যদি অনিচ্ছাকৃত পানি গলা দিয়ে পেটে চলে যায় তাহলে রোজা কাজা করতে হবে। কাফফারা ওয়াজিব হবে না। আর যদি রোজার কথা স্মরণই না থাকে, পানি মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে তাহলে রোজা ভাঙবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৮]। নাক অথবা কানের মধ্যে তেল দেওয়ার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না [হেদায়া ১/২২০]। যদি কোনো ব্যক্তি কারও ধমকের কারণে অথবা ভুল করে যেমন রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করে অতঃপর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে পানাহার করল, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৬/১৪৯]। পাথরের কণা, মাটি, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি মোটকথা যা সাধারণ আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না তা খেলেও রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করতে হবে [বাযযাযিয়া, ৪/৯৯]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি থুতুর সঙ্গে ভেতরে চলে যায়। আর রক্তের পরিমাণ যদি থুতুর সমান বা বেশি হয় তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [বোখারি ১/২৬০]। বিড়ি সিগারেট, হুঁকা পান করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [শামি ৩/৩৬৬]।
কঠিন অসুস্থতার ফলে যদি কোনো মানুষ রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৯]। যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত রোজা ভেঙে ফেলে অতঃপর খুব অসুস্থ হয়ে যায় অথবা কোনো নারীর প্রিয়ড হয়, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [হিন্দিয়া ১/২০৬]। রোজা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে তার স্বামী জোর করে সহবাস করলে স্ত্রীকে শুধু কাজা আদায় করতে হবে। কাফফারা নয় [তাতারখানিয়া ৩/৩৯৪]। যদি কোনো ব্যক্তি রোজা অবস্থায় সফর করে তার জন্য কোনো ওজর ছাড়া রোজা ভেঙে ফেলা অনুচিত। যদি ভেঙে ফেলে তাহলে শুধু কাজা জরুরি, কাফফারা নয় [আলমগিরি ১/২০৬]। যদি কোনো পুরুষের প্রস্রাবের রাস্তায় কোনো ওষুধ দেওয়া হয় আর অণ্ডকোষ পর্যন্ত পৌঁছে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে অন্যথায় নয় [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৩]। কোনো নারীর লজ্জাস্থানে ওষুধ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই রোজা ভেঙে যাবে [বাহরুর রায়েক ২/৪৮৮]।
ভঙ্গ হয় না যেসব কারণে
ভুল করে কোনো কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে না [বোখারি শরিফ ১/২৫৯]। মশা-মাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৬/৩৪৯]। অনিচ্ছাকৃত বমি হলে [এমনকি মুখ ভরে হলেও] রোজা ভাঙবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙবে না [তিরমিজি ১/১৫৩]। রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজা স্মরণ হওয়ামাত্র পানাহার ছেড়ে দিতে হবে [মুসলিম ১/২০২]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে পেটের মধ্যে না গেলে রোজা ভাঙবে না [শামি ৩/৩৬৭]। কোনো খাদ্যদ্রব্য বুট বা ছোট ছোলার কম পরিমাণ যদি দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকে ও গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে না [হিন্দিয়া ১/২০২]। হ্যাঁ, দাঁত থেকে বের করে হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় খেয়ে ফেললে রোজা নিশ্চিতভাবে ভেঙে যাবে [হিন্দিয়া ১/২০২]। অতিরিক্ত গরম বা পিপাসার কারণে যদি গোসলের মাধ্যমে শরীরকে ঠান্ডা করে তাহলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কুলি করার পর পানির অবশিষ্ট আর্দ্রতা থুতুর সঙ্গে গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। ঘাম অথবা চোখের অশ্রুর দু-এক ফোঁটা যদি অনিচ্ছায় মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কানের ময়লা বের করার দ্বারাও রোজা ভাঙবে না [মারাকিল ফালাহ ৩৪২]। যদি পান খাওয়ার পর খুব ভালোভাবে কুলি করার পরও রোজা অবস্থায় থুতুর সঙ্গে লাল রং বের হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই [হিন্দিয়া ১/২০৩]। নাক এত জোরে সাফ করা, যার ফলে কফ গলার মধ্যে চলে যায়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই [দুররে মুখতার ৩/৩৭৩]। রোজা অবস্থায় আতর বা ফুলের ঘ্রাণ নিলেও কোনো সমস্যা নেই [মারাকিল ফালাহ, ৩৬১]। শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না, বরং তা বৈধ [মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক ৪/৩১৩]। রোজা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত মুখের মধ্যে ধুলাবালি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না [দুররে মুখতার ৩/৩৬৬]। যদি রোজাদারের গোসল করার সময় অথবা বৃষ্টিতে ভেজার সময় কানের মধ্যে অনিচ্ছায় পানি চলে যায়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা নষ্ট হবে না [ফাতহুল কাদির ২/৩৪৭]। সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [সুনানে কুবরা বায়হাকি ৪/২৩৫]।
বরকতময় সেহরি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নবি (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিনের রোজা পূর্ণ করার জন্য সাহায্য নাও এবং দুপুরে ঘুমের মাধ্যমে রাতের নামাজের জন্য সাহায্য নাও।’ (ইবনে মাজাহ : ১৬৯৩)। পেটে ক্ষুধা না থাকলেও সেহরি খাওয়া উচিত।
হজরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত-হাদিসে নবি (সা.) বলেছেন, ‘সেহরি খাওয়া বরকত। একে পরিত্যাগ করো না, যদিও এক ঢোক পানির মাধ্যমে হয়। আল্লাহ ও ফেরেশতা সেহরি ভক্ষণকারীদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল : ১১১০১)।
যদি কোনো ব্যক্তি সেহরি খাওয়া ছাড়াই রোজার নিয়ত করে নেয়, তথাপিও তার রোজা হয়ে যাবে। তবে সে সেহরির বরকত পাবে না। [শামী ৩/৪০০]।
ইফতারের ফজিলত
ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। ইফতারের আগেই ইফতারি সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নাত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রোজাদারের দোয়া আল্লাহর কাছে এতই আকর্ষণীয় যে আল্লাহতায়ালা রমজানের সময় ফেরেশতাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘রমজানে তোমাদের পূর্বের দায়িত্ব মওকুফ করা হলো এবং নতুন দায়িত্বের আদেশ করা হলো, তা হলো আমার রোজাদার বান্দারা যখন কোনো দোয়া মোনাজাত করবে, তখন তোমরা আমিন! আমিন!! বলতে থাকবে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)।
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি; একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (মুসলিম)। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে।’ (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬০, পৃষ্ঠা : ১৩১)।
কী দিয়ে ইফতার করব
খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত; যে কোনো ফল দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত আদায় হবে। মিষ্টান্ন দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত পালন হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দ্বারা; নিশ্চয়ই পানি পবিত্র।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ; আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬২, পৃষ্ঠা : ১৩১-১৩২)।
ইফতার করানোর সওয়াব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পানিমিশ্রিত এক পেয়ালা দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সে পরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
ইফতারের দোয়া
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেওয়া রিজিকের মাধ্যমে ইফতার করছি।
তারাবিহের নামাজ
রমজানে এশার নামাজের পর বিশ রাকাত তারাবিহ দশ সালামের সঙ্গে আদায় করা পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ [দুররে মুখতার ২/৪২৯]।
তারাবিহের নিয়ত
তারাবিহের নামাজ এবং সব সুন্নাত ও নফল নামাজের জন্য সাধারণভাবে নামাজের নিয়ত করলেও যথেষ্ট। এতদসত্ত্বেও সতর্কতাবশত তারাবিহ নামাজের জন্য অন্তরে ইচ্ছা পোষণ করে নেওয়া উত্তম [দুররে মুখতার২/৮৬]। তারাবিহের মধ্যে কমপক্ষে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাত। আর একবারের অধিকবার পড়া মুস্তাহাব [দুররে মুখতার ২/৪৩৩, আলমগিরী ১/১৭৭]।
ইতিকাফ
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত শবেকদর। প্রত্যেক মুমিনের উচিত এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করে খোদার সন্তুষ্টি অর্জন করা। হজরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন-নবি কারিম (সা.) রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন (বুখারি, মুসলিম)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন-আল্লাহর রাসূল (সা.) রমজানের মধ্যের দশকে ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ করছিলেন যখন একুশের রাত এলো, যে রাতের সকালে তিনি তার ইতিকাফ থেকে বের হবেন, তখন তিনি বললেন, যারা আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, তারা যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এ রাত (শবেকদর) দেখানো হয়েছিল, পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ) ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ওই রাতের সকালে আমি কাদাপানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বিজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এ রাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কপালে কাদাপানির চিহ্ন আমার এ দুচোখ দেখতে পায় [বোখারি শরিফ]। এ জন্য প্রত্যেক শবেকদর সন্ধানকারীর উচিত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা।
ইতিকাফের পরিচয়
শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়-ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের এমন মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় এবং কোনো মহিলার নিজ গৃহে নামাজের স্থানে অথবা ঘরের এক কোণে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।
মহিলাদের ইতিকাফ
কোনো মহিলা ইতিকাফ করতে চাইলে সে বাড়ির কোনো একটি কামরায় ইতিকাফ করতে পারে। আর ওই কামরা তার জন্য মসজিদের মতো। অর্থাৎ ওই কামরা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হতে পারবে না। যদি বের হয়, তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে [আলমগিরী ১/২১১]।
আধুনিক মাসআলা
চোখে ওষুধ, ড্রপ বা সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। [আবু দাউদ-১/৩৩২]। রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করে টেস্ট বা পরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হয় না। [আলমগিরি ১/১৯৯]। হৃৎপিণ্ডের অসুস্থতার ফলে যে ওষুধ জিহ্বার নিচে রাখা হয় তার দ্বারা রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তা বিগলিত হয়ে থুতুর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গলা বা পেটের মধ্যে ঢুকে গেলে রোজা ভেঙে যাবে [শামি ৩/৩৬৭]। যদি রোজা অবস্থায় এমন ইঞ্জেকশন গ্রহণ করে যা পেটের মধ্যে অথবা মস্তিষ্কের মধ্যে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৩৭৯]। শরীরে স্যালাইন লাগানোর দ্বারা রোজা নষ্ট হবে না। তবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেওয়া অনুচিত [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। ডায়ালাইসিস করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। রোজা অবস্থায় অক্সিজেন নেওয়ার দ্বারা রোজা নষ্ট হয় না [আয়েনায়ে রমজান ৬৫]। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ঘ্রাণ নেওয়ার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয় না [মারাকিল ফালাহ ৫৪৩]। যদি পেট পরীক্ষা বা টেস্টের জন্য পেটের মধ্যে নাক বা গলা দিয়ে কোনো নল প্রবেশ করানো হয় আর তার মধ্যে কোনো ওষুধ মিশ্রিত করা হয়, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে [মুফতিরাতিস সিয়ামুল মুআ’সারাহ ৪৫-৫২]।
মাকরুহ হয়ে যায়
রোজা অবস্থায় মুখের মধ্যে থুতু জমা করা [হিন্দিয়া ১/১৯১]। বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা চিবানো (শামি ৩/৩৯৫)। টুথপেস্ট অথবা কোনো মাজন দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা (শামি ৩/৩৯৫)। প্রত্যেক ভারী কাজ যার ফলে রোজা ভেঙে ফেলার উপক্রম হয় [দুররে মুখতার ৩/৪০০]। রোজা অবস্থায় গুনাহের কাজ করা [তিরমিজি ১/১৫০]। কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় অতিরঞ্জন করা [হিন্দিয়া ১/১৯৯]। সন্দেহযুক্ত সময়ে সেহরি করা [হিন্দিয়া ১/২০০]। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোজা রাখা [হিন্দিয়া ১/২০১]। রোজা অবস্থায় লিপস্টিক দেওয়া মাকরুহ। কেননা তা মুখের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তবে মাথায় মেহেদি লাগানোতে কোনো সমস্যা নেই (তাতারখানিয়া ৩/৩৯৫)।