প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
শহীদুল্লাহ মাস্টার, আমার বাবা, আমাদের সবাইকে রেখে চলে গেলেন অনন্তযাত্রায় ২০২০ সালের ঈদের দিন বিকাল চার টায়। সেই সাথে এক বর্ণিল জীবনের সমাপ্তি।
তিনি একাধারে ছিলেন পিতা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং গণ মানুষের নেতা। অনেকের মতে তিনি ছিলেন চাঁদপুরের রাজনীতির কিংবদন্তীদের মধ্যে একজন। চাঁদপুরের শতবর্ষী বাবুরহাট স্কুল থেকে স্কুল শেষ করে চাঁদপুর কলেজ থেকে বিএ করে ১৯৬৬ সালের দিকে বাবুরহাট স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে ওনার কর্মজীবন শুরু। শুরু থেকেই স্কুলে জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেন। সেই সাথে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আর সাম্যের স্বপ্নে বামপন্থী দল ন্যাপ-এর রাজনীতি শুরু করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে চাঁদপুরে জনমত গঠনের কাজ করেন। সেই জন্য পাকিস্তানী সামরিক সরকারের রোষানলের মামলায় জেলে গিয়েছেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সেই রাজনৈতিক মামলা থেকে অব্যাহতি পান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং সমন্বয়ক ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ওনার সম্পর্ক টের পেয়ে যুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানী সেনারা ওনার খোঁজে আমাদের বাড়িতে এসে বলেছিলো ওনাকে আর্মির হাতে তুলে না দিলে আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। কিন্তু কিছুদিন দিন পর দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় ওনাকে আর বেশি দিন আত্মগোপনে থাকতে হয়নি। অনেকেই ওনাকে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেয়ার কথা বললেও তিনি নেননি। পরবর্তীতে মাননীয় হাইকোর্ট ওনাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি সংগঠক হিসেবে যারা কাজ করেছেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সম্মানে ভূষিত হন। কিন্তু এই সার্টিফিকেটের সহযোগিতায় কোনো সুযোগ গ্রহণ করেননি। আমরা ওনার দুই ছেলে মেয়ে কেউই এই সার্টিফিকেটের মাধ্যমে কোনো সরকারি চাকুরি গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করিনি। ওনার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছি। একজন সুযোগ্য ও জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে উনি সারাজীবন আমাদের অঞ্চলের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গেছেন। ওনার অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান মোঃ সবুর খান। একজন শহীদ উল্লাহ থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চাঁদপুরের শহীদুল্লাহ মাস্টার।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাবুরহাটসহ চাঁদপুরে চুরি, ডাকাতি, খুনের প্রবণতা খুব বেড়ে যায়। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পরে ক্রিমিনালদের অত্যাচারে। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে জনমত গঠন শুরু করেন। তার এই উদ্যোগ স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধীরা ভালো চোখে দেখেনি। ১৯৭৯ সালের কোনো একদিন উনি বাবুরহাট স্কুলে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় সেই ক্রিমিনাল দলের একজন স্কুলে ঢুকে ওনাকে হত্যার হুমকি দেয়। কিন্তু এলাকার মানুষের প্রতিরোধের মুখে সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই দিন রাতে হঠাৎ খবর রটে যায় আমাদের বাড়িতে ডাকাতদল হামলা করেছে ওনাকে হত্যার জন্য। এই খবরে এলাকার হাজার হাজার মানুষ দলে দলে ছুটে আসে এবং এক রাতেই সেই চুরি, ডাকাতি আর হত্যার সাথে জড়িত সব সদস্যরা গণপিটুনিতে মারা যান। এরপর থেকে আমাদের এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। এই গণপিটুনির ঘটনায় ওনাকে প্রধান আসামী করে মামলা করা হয়। কিন্তু জনগণের সহায়তায় সেই মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান। এইভাবেই একজন শিক্ষক থেকে তিনি গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেন। কিছুদিন পর নির্বাচিত হন আমাদের কল্যাণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সেই সাথে চলতে থাকে বাম ধারার রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। ১৯৮১ সালের দিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য পার্টির আমন্ত্রণে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরতে যান। তার কিছুদিন পর চাঁদপুর জেলা ন্যাপ-এর সভাপতির আসনে অভিষিক্ত হন। এরশাদের সময় সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অফার ফিরিয়ে দেন শুধুমাত্র নিজের আদর্শের সাথে আপোষ করবেন না বলে। জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। চাঁদপুরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের একজন ছিলেন সেই সময়। সুষম সমাজব্যবস্থা গড়ার স্বপ্নে বিভোর তখন। কিন্তু নব্বই-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের অবসানের পর তার সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রথমে চাঁদপুর জেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও তারপর চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। আর পেশাগত জীবনে বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়কে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ পর্যন্ত উন্নীত করে তার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে পেশাগত জীবন সমাপ্ত করেন। বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ছিলো তাঁর প্রাণ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন। গত ডিসেম্বর ২০১৯-এ উনি বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি উৎসব করেছিলেন। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন ওনার প্রিয় ছাত্র বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী। এত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান চাঁদপুরে খুব কম হয়েছে এবং এই ৭৭ বছর বয়সেও উনি অত্যন্ত সফলতার সাথে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
ব্যক্তি জীবনে উনি ছিলেন অসম্ভব সৎ। উনি আমাদের কল্যাণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু অবৈধ উপার্জনের অনেক সুযোগ থাকার পরেও সততার প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। রাজনীতি এখন মানুষের টাকা উপার্জনের মাধ্যম হয়ে গেছে, অথচ ওনার এত দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি টাকাও তিনি রাজনীতির মাধ্যমে আয় করেননি, আর অবৈধ উপার্জনের তো প্রশ্নই আসে না। উনি সারাজীবন রাজনীতি করে গেছেন মানুষের উপকার করার জন্য। আমাদের এলাকার অসংখ্য মানুষকে উনি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি দিয়ে দিয়েছেন। নিজের টাকায় ওনার ও আমার মায়ের নামে শহীদুল্লাহ সুরাইয়া ফাউন্ডেশন তৈরি করে গেছেন আমাদের অঞ্চলের গরিব মানুষদের সহযোগিতার জন্য। মানুষের উপকার করার করার জন্য উনি নিজের পয়সা যে খরচ করতেন এটা নিয়ে অনেকসময় আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করতাম। কিন্তু উনি শুনতেন না। ওনার ও আমার মা র শিক্ষকতার স্বল্প আয় দিয়েই আমাদের পরিবার চলতো। যার কারণে আমরা বড় হয়েছি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে। উনি ওনার সন্তানদের অনেক অর্থ বিত্ত দিয়ে বড় করেননি, বড় করেছেন সততা, নিষ্ঠা, মানবিকতা ও নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শিক্ষায়। ওনার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো একজন সৎ শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে যে পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই পরিচয় অটুট রাখতে পেরেছিলেন। চাঁদপুরের বাবুরহাট এলাকার মানুষের কাছে উনি ছিলেন দল, মত নির্বিশেষে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, এই অঞ্চলের মানুষের চোখের মনি হয়েই তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
বই পড়ার প্রতি ওনার অসম্ভব নেশা ছিলো। রাতভর শুধু বই পড়তেন। আমাদের ঘরভর্তি ছিলো ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা আর সাহিত্যের বই। বইয়ের প্রতি ওনার এতটাই ভালোলাগা ছিলো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসার সময় স্ত্রী আর সদ্যজাত সন্তানের জন্য নিয়ে আসেন লাগেজ ভর্তি বই। বই পড়ার প্রতি আমাদের অভ্যাস তৈরি হয়েছিলো ওনার কাছ থেকেই। উনি ছিলেন জ্ঞানের ভা-ার। বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাস ওনার মুখে মুখে শুনে আমরা বড় হয়েছি। ধর্মীয় জ্ঞান ও ছিলো ওনার অনেক গভীর। বিভিন্ন সময়ে কথা বলার সময় কোরান ও হাদিসের সঠিক রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতেন, যা দেখে আমাদের এলাকার অনেক আলেমরাও অবাক হতেন। করোনামুক্ত হয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় আসার পর উনি নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করলেন আর পবিত্র কোরান শরীফের বাংলা অনুবাদ পড়তেন আর তওবা পড়তেন শুধু। করোনায় বয়স্ক মানুষদের ঝুঁকি বেশি থাকায় করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর উনি কিছুটা ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। কিন্তু করোনামুক্ত হয়ে বাসায় আসার পর উনি শারীরিক আর মানসিক ভাবে অনেক সুস্থ ছিলেন। করোনার ভয় কেটে গিয়েছিলো। তাই আবার আগের মত হেঁটে বাজারে যাওয়া শুরু করলেন, সবার সাথে মিশতে শুরু করলেন। মৃত্যুর দুই দিন আগেও তিনি স্কুলের সামনে বাজারে গিয়ে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে আসলেন। একবারের জন্যেও ওনার মনে হয়নি উনি চলে যাবেন বরং অনেক আনন্দ নিয়ে ঈদের বাজারও করে আনলেন। আল্লাহ তায়ালা ওনার প্রিয় বান্দাকে নিয়ে যাবেন, তাই হয়তো ওনাকে তার প্রিয় স্কুলে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন, নামাজ পড়িয়ে ওনাকে দিয়ে তওবা পড়িয়ে নিলেন। ওনাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, কষ্ট না দিয়ে, কোরবানি ঈদের দিন ওনার প্রাণের স্থান চাঁদপুরের বাবুরহাটে, ওনার প্রিয় ঘরের বিছানায় ঘুমের মধ্যে আল্লাহতায়ালা ওনাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন।
বাবা আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ভালো থাকবেন ওপারে।
আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে একটাই অনুরোধ, আপনারা ওনার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহতায়ালা যেন ওনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ জায়গায় স্থান দিয়ে থাকেন।
□ ড. আবু সিনা, ক্যান্সার গবেষক, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া। সাবেক শিক্ষার্থী, বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।