প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২১, ০০:০০
একটি দেশে যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক-সংস্কৃতি গড়ে না উঠে তাহলে অসুস্থ ধারা বিকশিত হওয়াটা স্বাভাবিক। গত দু দশকে কিংবা তারও পূর্ব থেকে দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির টুঁটি চেপে হত্যার নীরব কৌশল চলছে। এ কৌশল ও প্রচেষ্টা এখন সাফল্যের প্রায় দ্বারপ্রান্তে। যে কেউ সহজেই স্বীকার করবেন, দেশে রাজনীতি বলে কিছুই নেই। না ক্ষমতাসীন দল, না বিরোধী দলগুলো রাজনীতি করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম ও পুরাতন রাজনৈতিক দল। টানা এক যুগের বেশি ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকার কলাকৌশল রপ্ত করতে গিয়ে দলটি রাজনীতিকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে বললে হয়তো ভুল হবে না। দলটি ক্ষমতায় থাকার জন্যে প্রশাসন তথা আমলাদেরকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অপরদিকে পুলিশ যেনো আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। নির্বাচনে জয়ী হতে আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ী ও আমলাবান্ধব হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এমপি হচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন, মেয়র হচ্ছেন। কালো টাকার মালিক লুটেরা, অর্থ ও মানব পাচারকারী, ঋণ খেলাপীদের কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগে হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। রাজনীতিবিদরা ভয়ে কিংবা লজ্জায় মুখ থুবড়ে আছেন। সুবিধাবাদী লুটেরা ও নব্য আওয়ামী লীগাররা জানেন একটা মনোনয়ন পেলেই হলো, নির্বাচনে জেতা কোনো ব্যাপার নয়। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে যারা আছেন তারাও এখন বুঝতে পেরেছেন এখনই সময়। এ মৌসুমে যদি কিছু টাকা-পয়সার মালিক না হওয়া যায় তাহলে আর কবে সুখের মুখ দেখবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তৃণমূলের দু নেতাই ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, যে ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে সুস্পষ্ট।
আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো নিয়ে যতো কম কথা বলা যায় ততোই ভালো। এরা এখন রাজনীতি ছেড়ে ‘দিবস রাজনীতি’ করে। বিরোধী দলের সঙ্গে আদর্শিক লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই। জনগণের কাছে ভোট চাইবার দরকার নেই, ভোটের বাক্স এমনিতেই ভরে যাবে। পুলিশ-প্রশাসন আছে না। এভাবেই আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতিশূন্যতায় ভুগছে। একদিকে আওয়ামী লীগ যদি রাজনৈতিক-রক্তশূন্যতায় ভোগে তাহলে অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতি আইসিইউতে চলে গেছে। বিএনপি কে চালায়, কীভাবে চলে তা বিএনপির প্রায় অধিকাংশ নেতাই জানেন না। আপোষহীন নেত্রী নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে রেখেছেন এবং মনে হয় পণ করেছেন কিছু বলবেন না। তার নীরবতায় প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংসদে দেয়া সেই আবৃত্তির কথা না বললেই নয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির একটি সংলাপ ধার করে বলেছিলেন, ‘একটা কিছু ক গোলাপী, একটা কিছু ক’। আর বিএনপির সব নেতা-কর্মীর মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা-কলি যেনো বাজে।
বিএনপি নেতারা রাজনীতি ভুলে গেছেন। এ দলটির জন্ম হয়েছিলো ক্ষমতার গর্ভে। তাদের কাছে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা, মন্ত্রিত্ব না হয় এমপি অথবা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি। এসব না হলে নিদেনপক্ষে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে টাকা বানানো। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না তেমনি ক্ষমতা ছাড়া বিএনপিও মৃতপ্রায়। বিএনপি’র নিজের আন্দোলনের ক্ষমতা নেই। তাই অন্যের আন্দোলনে কিছু দৌড়ঝাঁপ করে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তারা উঁকিঝুঁকি দেয়। হেফাজতের আন্দোলনে গলা বাড়িয়ে দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দেয়।
জাতীয় পার্টিকে মনে হয় গ্রামের ভাঙ্গা হাটের মতো। হাট ভেঙ্গে যাওয়ার পর যেমন যে যেটা পারে কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। এই দলটি সে অবস্থায় আছে। তবে নেতারা অবশ্য বুদ্ধিমান। তারা জানেন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে হলে একটি গৃহপালিত বিরোধী দল লাগবে। তাই তাদের রাজনীতি হলো আওয়ামী লীগের অনুগত থাকা। একদিকে জাতীয় পার্টি জানে আওয়ামী লীগ থাকতে তাদের মৃত্যু নেই বলা যায়, অপরদিকে জাতীয় পার্টিকে বাঁচায়ে রাখা সরকারের অবশ্য পালনীয়ের মধ্যে একটি।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের সাথে জাসদ সহ অন্যান্য বামপন্থী দল নিয়ে ১৪ দল গঠন ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যের সরকার গঠনে অংশগ্রহণ। যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশের মাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং কর্নেল তাহের হত্যার বিচার সহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে অনেক আশাবাদের জায়গা তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশের সম্ভাবনা। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল অসুস্থ, সংকটাপন্ন, দ্বিধা-বিভক্ত হলেও বাম গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দলগুলো মৃতপ্রায়। আগে মস্কোয় বৃষ্টি হলে এখানকার মস্কোপন্থি বামেরা ছাতা মেলতেন। চীনে যা হতো সেটাই অনুসরণ করতেন চীনপন্থিরা। এখন তারা দিগ্ভ্রান্ত। কী করবেন নিজেরাই জানেন না। এ রকম একটি পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা। ঘুষ-দুর্নীতি এখন কোনো অপরাধ নয়। দুর্নীতিকে অধিকার বানিয়ে কেউ কেউ পরকাল-ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরা ধর্মাসক্ত হয়ে পড়েন, ধর্মভীরু হন না। এরা নিজেদের অপরাধ থেকে পাপমুক্তির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন। এরা মাদ্রাসা তৈরি করেন, হুজুর খোঁজেন, তাবলিগে অর্থায়ন করেন। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যখন রাজনীতির মাঠ নষ্ট, সমাজ দূষিত তখন দেশ ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্যে একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আর কী বাকি থাকে।
প্রশাসনে যখন পদোন্নতির মাপকাঠি যোগ্যতা নয়, তখন পদোন্নতির জন্যে ফন্দিফিকির বের করেন আমলারা। অনেক রাজনীতিবিদের মতো আমলারাও দুর্নীতির টাকা হালাল করতে অনেক সময় ধর্মকে ব্যবহার করেন। কত আমলা, কত রাজনীতিবিদ কত মাদ্রাসা করেছেন তার একটি হিসাব হওয়া দরকার। এভাবেই ধর্ম প্রভাবশালী ফ্যাক্টর হয়ে উঠে এ দেশে। ভারতের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় দেশটির স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক অতীন দাশ এক কলামে লিখেছেন, ‘একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম কিনা, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে।’ (আমাদের নতুন সময়, ৬ এপ্রিল ২০২১)
উল্লেখ্য, রাজনীতিহীনতার রোগে আক্রান্ত সরকার হেফাজতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। অপরদিকে হেফাজতও দেখে বাহ্ বেশতো। তারা পাঠ্যপুস্তক সংশোধন চায়। সরকার বায়না পূরণ করে। আদর্শহীন রাজনীতিবিদ আর অযোগ্য আমলারা হেফাজতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। কারণ এরা জনবিচ্ছিন্ন, তাই হেফাজতের কোমলমতি চিন্তা-চেতনাশূন্য কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সভা-সমিতি, ওয়াজ-মাহফিলে একসঙ্গে দেখে তারা ভয় পায়। নষ্ট রাজনীতিতে হেফাজত এক ভয়ঙ্কর দানব হয়ে উঠে। যে দাবনরূপের একটু দেখা গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৬ ও ২৭ মার্চ। আওয়ামী লীগের এতো নেতা-কর্মী তারা কী করেছিলেন? ক্ষেত্র বিশেষে আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ পুলিশ প্রশাসন কেন হাত-পা গুটিয়ে ছিলেন?
হেফাজতের তা-বে বিএনপি খুশিতে হয় আটখানা। তারা নতুন করে আশায় বুক বাঁধে, তারাও হেফাজতের সঙ্গে গোপন প্রেমের নাটক করে। জাতীয় পার্টি তো কিছুই জানে না। তাছাড়া সরকারের ইশারা ছাড়া কিছু করবেনই বা কেন? বামেরা হেফাজতের এতো লোক দেখে দিশহারা হয়ে যায়।
করোনা তো একটি ব্যাধি। আমাদের সমাজে বীভৎসতা, অমানবিকতা, পৈশাচিকতা এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আর আমাদের সমাজচিত্র রাজনীতিশূন্যতায় করোনার চেয়েও ভয়াবহ। আমাদের চারপাশে যা দেখছি, যা ঘটছে তা আমাদের বৈশিষ্ট্য নয়, আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নয়। কিন্তু আমরা যেন ক্রমে বদলে যাচ্ছি। এ রকম একটা সমাজে আমরা প্রবেশ করেছি যেখানে আমরা জানি না পাশের ফ্ল্যাটে বা বাসায় কে থাকেন। সন্তান জানে না তার পিতার বিপুল অর্থ-বিত্তের উৎস কী? স্বামীর মাসিক বেতন কত জানার পরও স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। আয়ের চেয়ে অসংগতির জীবন নিয়ে কেউ প্রশ্নে তোলে না। কিন্তু সময় এখন পাল্টে গেছে। দুর্নীতিবাজদের উল্লাসনৃত্যে সৎরা কোণঠাসা। দুর্নীতির অভিবাসন ঘটছে। দুর্নীতিবাজদের মধ্যে নিম্নশ্রে.ণীর দুর্নীতিবাজরা দেশে কিছু চুরি-চামারি, মারিং-কাটিং করে আর বড় দুর্নীতিবাজরা তো সব টাকা রপ্তানি করে। বলা হয়, গার্মেন্টস পণ্য নাকি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। হিসাব করলে বুঝা যায় এ তথ্য ভুল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য হলো টাকা। প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় তার তুলনায় গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানি আয় তুচ্ছ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন আবেগে একবার বলে ফেললেন, ‘আমরা আগে মনে করতাম কানাডায় বোধ হয় রাজনীতিবিদের বাড়িঘর বেশি। কিন্তু এখন খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমলাদের বাড়িঘরই বেশির ভাগ।’ কিন্তু কানাডাসহ বিদেশে বাড়ির মালিকদের নামের তালিকা এবং সুইসব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশীদের ব্যাংক হিসাবের তালিকা জাতি জানলো না। হয়তো কোনো দিন জানবেও না।
আমরা যদি রাষ্ট্রে বিশ্বাস ও বসবাস করি তাহলে মানতেই হবে রাজনীতিই হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক শক্তি। রাজনীতিহীন রাষ্ট্রে সমাজ হয় ভারসাম্যহীন। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হবে রাজনীতি দিয়ে। রাজনীতিই হলো একটি দেশ ও সমাজের চালিকা শক্তি। রাজনীতি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় চালকের আসনে না থাকে তাহলে এই রাষ্ট্র ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেই। বিশ্বের দেশে দেশে এটি প্রমাণিত। রাজীতিকে যেখানেই নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে সেখানে রাষ্ট্রই ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অনৎধযধস খরহপড়ষহ-এর মতে, ‘Democracy is a Government of the people, by the people and for the people.’ তাঁর সংজ্ঞার আলোকে বলতে হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণ তার পছন্দের প্রতিনিধিদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্বাচিত করে। সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় এঁরা হলেন সংসদ সদস্য। জনপ্রতিনিধিদের নেতা আবার তার নির্বাহী দায়িত্ব কয়েকজনকে ভাগ করে দেন। এঁরা হলেন মন্ত্রী। আর তাদের কাজের সহযোগিতা করার জন্যে কিছু দক্ষ বেতনভুক্ত কর্মচারী থাকেন, তারা হলেন আমলা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সবচেয়ে খারাপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো স্বৈরাচারী ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম।’ এর প্রমাণ বিশ্বের অনেক দেশের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র চলছে। একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশগ্রহণহীন প্রতিনিধি নির্বাচন, অপরদিকে সেই প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্ভরশীল আমলা-পুলিশতন্ত্রের ওপর। অর্থাৎ এখানে সংসদ সদস্য আছেন, কিন্তু সংসদ সদস্যদের সর্বাত্মক ক্ষমতা নেই। সর্বময় ক্ষমতা যেন ডিসি ও ইউএনওদের হাতে। এখানে মন্ত্রিসভা আছে কিন্তু মন্ত্রীদের কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা আমলাদের হাতে। রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রক নয়। ফলে এ সমাজে অপরাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। তাই প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এ ক্ষেত্রে ভিন্নতার সুরে বললে বলতে হয়, Democracy is a Government of the Bureaucracy, for the people and not by the people.
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কলকারখানা যেমন বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বেসরকারিকরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তেমনি রাজনীতিকে রাজনীতিকরণের পরিবর্তে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ রাজনীতিবিদ টিকটকের চরিত্র হয়ে গেছেন। দেশে এখন রাজনীতি বলতে কী আছে? রাজনীতির নামে যা হচ্ছে মাঝে মাঝে তাকে বলতে হয় টিকটক। টিকটক নিয়ে বিশ্বে হুলুস্থুল। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন শটকার্ট পদ্ধতিতে ধাবমান। রাজনীতি এখন মাঠেও পুরোপুরি নেই, জণগণের কাছেও নেই। এখন রাজনীতি প্রধানত চলে গেছে টকশো, ফেসবুকে। ফেসবুকে লাইভে এসে নেতারা ঘোষণা দেন, হুমকি দেন। ফলে নেতৃত্বের চেইন অব কমান্ড নেই। ফেসবুকে যার যত ফলোয়ার, লাইক-শেয়ারে তিনি তত বড় নেতা। ত্যাগী, পরীক্ষিত ইত্যাদি শব্দ কেবল বক্তৃতার জন্যে প্রযোজ্য। রাজনীতিতে টিকটক ফর্মুলাই এখন শক্তিশালী। আর রাজনীতির এমন দৈন্যদশা সমাজকে লক্ষ্যহীন ও আদর্শহীন করেছে।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা ও সর্বময় কর্তৃত্বের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডি-লোলমী (De-Lolme) বলেছিলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নারীকে পুরুষে এবং পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করা ছাড়া সবকিছুই করতে পারে।’ বাংলাদেশে এখন এ উক্তির ভিন্ন ও সংস্করণ দেয়া গেলে হয়তো ভুল হবে না-এ দেশের আমলাতন্ত্র নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করা ছাড়া সবকিছুই করতে পারে। ব্রিটেনের আদলেই বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত। কিন্তু সংসদের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা কতটুকু তা সবাই জানি। সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে বাংলাদেশে এখন আমলাতন্ত্রের শাসন দৃশ্যমান বললে অত্যুক্তি হবে না। মুজিববর্ষ উদ্যাপন থেকে করোনা মোকাবিলার নির্দেশনা সবই পরিচালিত হচ্ছে আমলাতন্ত্রের হাতে।
গত ৪ এপ্রিল রোববার বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম একটি অসাধারণ লেখায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন, ‘প্রশাসনের কাজ মিছিল নয়, মানুষের জানমাল রক্ষা।’ লেখার মধ্যে অনেক ইঙ্গিত আছে। কিন্তু একটা স্পষ্ট সংকেত পেয়েছি এই লেখাটিতে, তা হলো, যার যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালন করা দরকার।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন চমৎকারভাবে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমলারা সবকিছু কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে রেখে বাইরে ফিটফাট দেখানোর চেষ্টা করে। এরা কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে চায় না। সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে চায়। আর রাজনীতিবিদরা বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করে। সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজে।’ অতএব আমরা আশা করতে পারি কি যে, সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির যোগসূত্র পরিহার করবে এবং সবকিছুতে আমলানির্ভরতার পথ থেকে সরে এসে জনগণের সরকার হবে। তবে সুস্থ রাজনীতির গতিময় আদর্শিক ধারাই এ নষ্ট রাজনীতিকে কাক্সিক্ষত জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; বাকশিস নেতা, চাঁদপুর জেলা।