মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কচুয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
  •   নির্মাণের এক বছর না যেতেই ফরিদগঞ্জ কেন্দ্রীয় মডেল মসজিদের বেহাল দশা
  •   শেষ হলো পদ্মা-মেঘনায় জাল ফেলার নিষেধাজ্ঞা
  •   ফরিদগঞ্জে প্রবাসীর স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার
  •   মোবাইল ব্যবহারে নিষেধ করায় শিশু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০

আমার একজন কাজী শাহাদাত ভাই আছেন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

জীবনস্রোত সতত প্রবহমান। এই স্রোত কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় তা কেউ আগাম ধারণা করতে পারে না। আপনি বা আমি আজ যে জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে আছি তা হয়তো নিয়তি নির্ধারণ করে রেখেছে আরো অনেক আগেই। কাজেই কার্যকারণবিহীন জগৎ চলে না, যেমন চলে না জীবনস্রোত বা কপাল-কল্লোল। শৈশবের প্রিয় সখা কর্ণফুলির দক্ষিণ তীর হতে কৈশোরে উত্তর তীরে এসে নগরজীবনে অভ্যস্ত হতে শেখা এক বালকের যৌবনপ্রাপ্তি অবধি কেউ ভাবেওনি কোনোদিন লেনিনের শহরে মস্কোভা নদীর ডাক পড়বে। যার সখা হয়ে উঠেছিল শীর্ণকায়া তুষারলগ্ন মস্কোভা নদী, তাকে যে মেঘনাপাড়ের ইলিশ কোনোদিন হৃদয়ের গভীরে ডাক দিয়ে যাবে তাও কোনো আগাম বার্তায় কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু জীবনের স্রোত বিচিত্রগামী। কেন্দ্র থেকে মফস্বলের দিকে যে স্রোত একদিন জীবনকে এনে নোঙর ফেলেছিল মেঘনা পাড়ে আজ সেই যাত্রারই সাতকাহনে ভরে উঠেছে সোনার তরী। জীবনস্রোতের এই প্রবাহ-পথে যে চরিত্রগুলো মুখ্য ভূমিকা পেয়ে নিয়তিকে ঋদ্ধ করে আছে তাদের মধ্যে অগ্রজ একটি অনপনেয় মুখ জনাব কাজী শাহাদাত। আজকের লেখার বিষয়বস্তু সঙ্গত কারণে কেবল তার সাথে আমার পরিচয়ের সূচনালগ্নেই সীমাবদ্ধ। অপরাজিত এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে হয়তো মলাটবদ্ধ হয়ে গ্রন্থের রূপ পাবে কোনো একদিন।

শাহাদাত ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার এবং সান্নিধ্যে আসার অনেক পরেই জেনেছি, আমাদের আলমা ম্যাটার একই। তিনি আমার দশ বছর আগে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন এবং কিছুদিনের জন্যে তিনিও চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন। বলাখাল কাজী বাড়ির নামকে চাঁদপুর ছাপিয়ে যার কারণে দেশজুড়ে ব্যাপ্ত হয়েছে তিনি কাজী শাহাদাত। তার জীবদ্দশাতেই তার নামে বলাখাল কাজী বাড়িমুখি রাস্তাটির নাম রেখেছে হাজীগঞ্জ পৌরসভা। এ এক বিরল স্বীকৃতি তার সামাজিক কর্মকাণ্ডের।

দুহাজার তিন সালের মে মাসে যখন আমার চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিঠাপিঠি অনুজ প্রিয়ভাজন ডাঃ হারুনুর রশীদ সাগরের আহ্বানে মিডল্যান্ড হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে রোগী দেখার পাশাপাশি অলস সময় কাটতো ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ পড়ে, তখন পত্রিকায় তার নাম প্রধান সম্পাদক হিসেবে দেখে তাকে জানার কৌতূহল জেগে উঠতো। মনে মনে বিখ্যাত দেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সাগরময় ঘোষের চেহারা ভেসে উঠতো। মফস্বলের একটা পত্রিকায় যিনি প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি আদৌ কেমন ব্যক্তিত্ব ধারণ করেন তা জানার অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু তার সাথে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ তখনও হয়নি। তবে পত্রিকান্তরে মাঝে মাঝে তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি দেখতে পাই, যাতে মনে হয় তিনি কাজী শাহাদাত যার তিনটি হাত এবং তৃতীয় হাতটি অজুহাতের হাত নয় কিংবা কাজীর হাতও নয়, আসলে কাজের হাত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ সময় আমি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমার নিবীতে অন্য কেউ'-এর পা-ুলিপি তৈরি করি, যা দুহাজার চার সালে অমর একুশে বইমেলায় চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে আমার কবি নাম পীযূষ যীশু ব্যবহৃত হয়।

দুহাজার ছয় সালের দিকে সেনাসমর্থিত উদ্দীন ও ডক্টরদের সরকারের আমলে আমরা কয়েকজন মিলে ‘দীর্ঘায়ু’ নামে একটা প্রকল্প চালু করি, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া। এর যে হেলথ কার্ড তার লোগো আমি তৈরি করি এবং নামটাও আমার দেয়া। চেয়ারম্যান ঘাট গুচ্ছগ্রামে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের পর জামতলা বস্তিতে এরকম ক্যাম্পে আমি চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রয়াত মাসুদুর রহমান শিপু ভাইয়ের ছোটভাই বাবুর আমন্ত্রণে কাজী শাহাদাত ভাই প্রধান অতিথি হিসেবে সেই কার্যকম উদ্বোধন করে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু তখনও তার সাথে আমার সরাসরি কথাবার্তা হয়নি। চিকিৎসা প্রার্থী অসহিষ্ণু রোগীরা আমাকে ঘিরে থাকায় তার বক্তব্যে আমি মনোযোগী হতে পারিনি তখন।

দুহাজার নয় সালে চাঁদপুরে জাতীয় বিতর্ক উৎসব হয়। সে সময় আমি সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সাথে যুক্ত ছিলাম। ক্লিনিক ম্যানেজার শাহেদ রিয়াজ খুব মিশুক মানুষ। তাকে আমি কথায় কথায় বললাম, আপনার শহরে জাতীয় বিতর্ক উৎসব অথচ বিতর্কের ওস্তাদ আপনার সূর্যের হাসি ক্লিনিকে বসে আছে। আমার কথা শুনে রিয়াজ ভাই হেসে দিয়ে বললেন, তাই নাকি! তিনি সিরিয়াসলি জানতে চান আমার বিতর্ক বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। সবিশেষ অবহিত হয়ে তিনি বললেন, শাহাদাত ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দেখা হলে আপনার কথা আমি তাকে জানাবো। এরপর একদিন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতার জন্যে লেখা আহ্বান করা হলো। লেখার বিষয় : কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন। এসময় সাহিত্য পাতার দায়িত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান রানা। তিনিও লেখালেখি করতেন। যেহেতু কবি জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি এবং বনলতা সেন একদিকে প্রিয় কবিতা এবং অন্যদিকে প্রিয় চরিত্রও বটে, কাজেই বিষয়টি আমাকে টেনে নিলো চুম্বকের মতো। আমিও 'কবিতার মোনালিসা' শিরোনামে আহুত বিষয় নিয়ে একটা গদ্য লিখে পাঠালাম। এই প্রথম আমি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে কোনো লেখা পাঠালাম। সম্পাদক হিসেবে এসব লেখা প্রুফ দেখা ও সম্পাদনার জন্যে শাহাদাত ভাইয়ের টেবিলে যেত। ফলে লেখার মাধ্যমে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হয়। কিন্তু তখনও সরাসরি তার সাথে আমার আলাপ-পরিচয় বলতে যা বুঝায় তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

দুহাজার দশ সালের মে মাসে বিশ্ব মা দিবসে আজাদ প্রোডাক্টসের পক্ষ থেকে আমার মাকে রত্নগর্ভা মা সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। তৎকালীন বিএমএ'র নেতা ও চাঁদপুরের সুবিদিত চিকিৎসক ডাঃ সহিদউল্যা ভাই কাজী শাহাদাত ভাইকে এ তথ্য জানালে তিনি চেনাজানা না থাকার কারণে এ সংবাদের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেননি।

দুহাজার নয়-দশ সালে ইভটিজিং বিষয়টি দেশজুড়ে কর্কটরোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। লেখক হিসেবে সে সংবেদন কলমে ধরে রেখে আমি দুহাজার দশ সালে রচনা করি ইভটিজিংবিরোধী কবিতাপত্র 'আমার মায়ের সুচিকিৎসা চাই'। কবিতাপত্রের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে বিজয়মেলা মঞ্চে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আমি নিজেই কাজী শাহাদাত ভাইয়ের 'দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ' অফিসে যাই। এই প্রথম তার সাথে আমার সরাসরি বাক্য বিনিময় হলো। তাও সংক্ষিপ্ত। তিনি বললেন, 'আপনি নিজে এলেন কেন? কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো।' আমি জবাবে বলেছিলাম, আপনাকে থাকতে হবে। তাই নিজেই এসেছি আমন্ত্রণ জানাতে। এ কবিতাপত্রের অনেকগুলো কবিতা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। অবশ্য এর আগে দুহাজার দশ সালের নভেম্বরে তার পত্রিকায় আমার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, যা গোলাম মোস্তফা তার নির্দেশে নিয়েছিলো।

দুহাজার এগার সালে চাঁদপুর হার্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড হার্ট ডে উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সত্যিকার অর্থে শাহাদাত ভাইকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাই। পুরু ভ্রমর কৃষ্ণ গুম্ফে সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবি। তার বক্তব্যের সূচনা ছিল শ্বশুরবাড়ি হতে স্নেহাশিস স্বরূপ পাওয়া সিলিং ফ্যান খুলে পড়া প্রসঙ্গ নিয়ে। বক্তব্য শুনতে শুনতে বুঝলাম, তিনি অবিরাম বলতে পারেন এবং বক্তব্য শোনানোর মতো গল্প বলতেও পারঙ্গম। শ্রোতার কানকে অধিকার করে নেওয়ার মতো স্বরের প্রাবল্য তার আছে।

এরপর দুহাজার বার সালের পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইতোমধ্যেই শাহাদাত ভাইকে শাহেদ রিয়াজ বলেছেন আমার বিতর্ক সংশ্লিষ্টতার কথা। পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতাটি তৃণমূল থেকে বিতার্কিককে তুলে আনার একটা ভালো উদ্যোগ। প্রতিটা উপজেলায় আলাদা করে প্রান্তিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। তারপর অভিযাত্রা, অগ্রযাত্রা, জয়যাত্রা, জয়ধ্বনি ও উল্লাস পর্বের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাটি সমাপ্তি অর্জন করে। কাজেই প্রচুর মানসম্পন্ন বিচারকের দরকার হয়। অতএব, বিচারক হিসেবে ডাক পড়লো আমারও। এভাবেই শাহাদাত ভাইয়ের সাথে আমাকে নিয়তি বেঁধে দিলো অগ্রজ-অনুজের বন্ধনে। নিয়তির বেঁধে দেওয়া সেই গ্রন্থি আরও শক্ত ও দৃঢ় হয়, যখন জানতে পারলাম, তিনি আমার স্কুলের এবং আমার কলেজের অগ্রজ বিদ্যার্থী। তখন সম্পর্কটা আর একজন পত্রিকা সম্পাদক কিংবা একজন বিতর্ক সংগঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সম্পর্কটা তখন হয়ে গেছে বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের। তিনি এরপর থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সংগঠনে আমার নাম অন্তর্ভুক্তিতে সচেষ্ট হলেন। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে চাঁদপুর কণ্ঠে যেমন বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করেছি, তেমনি বিভিন্ন সংগঠনে সংযুক্তও হয়েছি। চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনায় দুজনের আত্মমগ্ন সংশ্লিষ্টতা সে সম্পর্কেরই ইতিবাচক প্রবহমানতা। দুজনের পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধুনিতেও এই সৃজনশীল সম্পর্কের রসায়ন গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের সূচনা কোনো স্বার্থবাদিতায় নয় বরং সৃজনশীলতায়। পত্রিকা সম্পাদনা বিষয়ে তার জ্ঞান মফস্বলে থেকেও অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ের। অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকের মান তার সম্পাদিত পত্রিকার ধারে-কাছেও নেই। নিজ পত্রিকার মানসম্পন্নতার বিষয়ে আপোষহীনতার কারণে তার গ্রহণযোগ্যতা গুণগ্রাহী মহলে ঈর্ষণীয়। সেই ঈর্ষার ইতিবাচকতা নিয়েই তিনি জেলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন অপরিহার্য ব্যক্তিরূপে। শুরুতে যে পরিচয় ছিল অতি ধীরস্থির, সে সম্পর্কই একসময় গতি পায় আদরে-আব্দারে, আস্থায়-আন্তরিকতায়। মেধা ও সৃজনশীলতাভিত্তিক কোনো কাজে তিনি যেমন অবলীলায় ডাক পাড়েন আমাকে, তেমনি আমিও মনে মনে শক্তিমান হই এই ভেবে যে, এ শহরে আমার একজন কাজী শাহাদাত ভাই আছেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়