প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২১, ০০:০০
প্রকৃতি কখনো প্রতিশোধ নিতে ভুল করে না এ কথাটা আমরা হয়তো মানতে পারি না। কিন্তু অবাক হলেও আজ আমরা সে প্রমাণ পদে পদে পাচ্ছি। দুর্যোগ কখনো এমনি এমনি আসে না। একের পর এক মানুষের প্রকৃতির উপর অত্যাচারে আজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে প্রকৃতি। তাই নানা রকমভাবে আমাদের সংকটের জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই সংকট বা স্তব্ধতা দিন দিন সাধারণ মানুষকে নীরব করে দিচ্ছে। যে নীরবতা আমাদের ভাবনা শক্তিকে একেবারে ধ্বংসের মুখে পতিত করছে। যাই হোক, এরই মধ্যে আমাদের চলার শক্তি গুলো তৈরি করতে হবে। নতুবা সৃষ্টিশীল কাজগুলো আমাদের কাছ থকে এক সময় হারিয়ে যাবে। আজ মানুষে মানুষে সংঘাত, মানুষে মানুষে বিবাদ যেনো লেগেই আছে। আমরা কি পারি না এ সমস্যা থেকে বের হতে? শুনতে খারাপ লাগলেও আমার একটি কথা বলতেই হয়, আমরা পারবো না! কারণ পারার মতো সে কাজ আমরা করছি না। লোভ-লালসা আর মিথ্যার স্তম্ভগুলো আজ বেড়েই চলছে। আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতিগুলোও আজ বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। আর এই বিলুপ্তিকে রোধ করতে হলে আমাদের চলতে হবে সত্যের পথে, সুন্দরের পথে। সমাজে থাকবে প্রগতি, শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, পারস্পরিক আন্তরিকতা এবং কল্যাণকর মানুষের সুন্দর চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানুষ এই প্রথম একটি মহাদুর্যোগের মুখে পতিত হয়েছে। কোনো দুর্যোগ যখন বড় আকার ধারণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই সে দুর্যোগকে অতিমারী বলা হয়। করোনা সংকট এখন অতিমারী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশে-বিদেশে মানুষের মৃত্যুর হার ও সংক্রমণের হার বেড়েই চলছে। বিশ্বজুড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে এই দুর্যোগ। সম্প্রতি আমাদের দেশে করোনাজনিত কারণে ও চরম দারিদ্র্যের সীমা অতিক্রম করে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। নিম্নবিত্ত সংসারে পারিবারিক সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার আশংকা করছেন সমাজবিদরা। প্রায় দেড় বছর ধরে সারা পৃথিবীকে ওলটপালট করে দিচ্ছে এই করোনা। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে বন্ধ। অনলাইন শিক্ষার নামে যা চলছে তা অনেক সময়ই হাস্যকর বলে মনে হয়। ষাট জনের ক্লাসে ১৪ জন ঢুকতেই ভিডিও অফ করে দেয়। এভাবে শিক্ষকরা কতটুকু শিক্ষা প্রদান করতে পারেন তা আমার বোধগম্য নয়।
১৩৪৬-১৩৫৩ সাল পর্যন্ত বয়ে যাওয়া ব্লাক ডেথ বা কালো মৃত্যু মহামারিতে প্রায় ২০কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন এখনকার মতো ছিলো না, তাই মৃত্যু সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেছে। করোনাও বিশ্বব্যাপী যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা মুশকিল। তবে এখন পর্যন্ত সে সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম। এই সংখ্যা নিয়ে পুলকিত হবার কিছু নেই। কারণ একেকটি ঢেউ আসছে আর মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। এই নিত্য নতুন ঢেউ কত বছর ধরে চলবে তা এখনো আমাদের জনা নেই। আমরা অজানা গন্তব্যের পথে ছুটে চলছি, আমরা জানি না কখন আমাদের কী হবে। কীভাবে আমরা জীবন কাটিয়ে যাবো। করোনার করাল গ্রাস প্রায় প্রতিটি দেশেরই সামাজিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। একের পর এক নানা ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হচ্ছে। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। নতুন করে আসলো ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, ইয়োলো ফাঙ্গাস ও হোয়াইট ফাঙ্গাস, বোনডেথ নামক ফাঙ্গাস। এরপর আরো কত কী আছে কে জানে ! সবাই ভালো নেই। এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যারা সমাজ পরিচালনা করছেন, হয়তো বিভিন্ন ইস্যুতে তারা ভালো আছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ভালো নেই। যারা দিনমুজর তারা কতোটা অসহায়ত্বে দিনযাপন করছেন সেটা হয়তো কারো কাছে মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে বেশি। যারা মানুষকে আনন্দ দিয়ে, বিনোদন দিয়ে নিজের সংসার চালাতো তাদের আজ কী অবস্থা? অনেকেই ভাবতে পারেন তারা ভালো আছে। সত্যি বলতে কি, তারা ভালো থাকার অভিনয় করছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আত্মসম্মানকে হয়তো তারা বিসর্জন দিচ্ছেন না। কিন্তু জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করছেন। আজ আনন্দহীন হয়ে পড়েছে সকল কিছু। সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার কাজ করছে। কী হবে সামনে? কী করবে তারা? হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে যুব সমাজ। নেই চাকরি, নেই কর্মসংস্থান, নেই রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত কর্তাদের মাথাব্যথা। এর শেষ কোথায়? কী হবে আগামী সময়ে? নানা প্রশ্নে আজ জর্জরিত আমাদের সমাজ, আমাদের ব্যক্তি জীবন।
সংস্কৃতি অঙ্গনে করোনার ভয়াল ছোবল পুরো শিল্পী সমাজকেই কুপোকাত করে ফেলেছে। সংস্কৃতির যেই অঙ্গনেই আমরা তাকাই না কেন, চারদিকে শুধু হাহাকার আর হতাশা। যেসব শিল্পী মঞ্চ, টেলিভিশনে সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে সংসার পরিচালনা করতো, তারা আজ মাসের পর মাস চরম বেকারত্বে ভুগছেন। নানা ডিগ্রি অর্জন করে যারা দিনের পর দিন সাধনা করে সংগীত শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন, আজ তারা ভয়াবহ ভাবে দিন অতিক্রম করছেন। সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় যে সকল উপাত্ত ছিলো তা আজ একে একে ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। আশার আলোয় যখনই আলোকিত হচ্ছে বা কোনো কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে তখনই কোনো না কোনো ভাবে আমরা দুর্নীতিকে বা অব্যবস্থাপনাজনিত নানা ত্রুটিকে দেখি বাস্তবায়ন করতে নানা গল্প আর নানা ইতিহাসের তখন রচনা হয়। সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে নানা রকম কারসাজি। মূল শিল্পীদের পরাজয় হয়ে যায় আত্মসম্মানের কাছে। কারণ সারা জীবনের সম্মান কুলাঙ্গারের কাছে বিসর্জন হতে দিতে পারে না। সংগীত প্রতিষ্ঠান বা স্কুলগুলোর বিপর্যয়। লকডাউনে কার্যক্রম নেই, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, নেই শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারছেন না, টিউশনি করতে পারছেন না। বিশেষ করে যন্ত্র শিল্পীদের অবস্থা আরও খারাপ। অনেকে তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার, বেহালা, দোতরা ছেড়ে ছোটখাট ব্যবসা শুরু করেছেন। সেই সুযোগ তো সবার নেই। পরিবার চালাতে কেউ বা নানা কাজে ঢুকে গেছেন। এত গুণ এত বিশেষত্ব সবই যেন আজ হৃদয় বিদারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে জীবন সংগ্রাম নামক যুদ্ধের কাছে। এরই মাঝে শিল্পীদের জন্য সরকারি প্রণোদনা কাদের হাতে পৌঁছেছে তা আমরা জানি না। তবে এতটুকু জানি, সত্যিকারভাবে যাদের জন্য এই প্রণোদনা পৌঁছানো জরুরি ছিলো তাদের সকলের হাতে সে টাকা পৌঁছায় নি। যাই হোক সে বিষয়ে বিস্তারিত আর নাই বা গেলাম। এ বিষয়ে আরেকটি কথা, দুই, পাঁচ, দশ হাজার টাকা দিয়ে একটি পরিবার কতদিন চলতে পারে! এটা সত্য, প্রণোদনার ক্ষেত্রেও দেখা গেলো সরকারি লোকেরাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানে সাম্যতার আর কীই বা থাকে! সাম্পদ্রায়িতার বিষ দাঁতের ছোবল করোনার গ্রাস থেকেও অনেকটাই বেশি। আমি এমনও অনেক শিল্পী পরিবারকে জানি, যারা দিনের পর দিন এক বেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে কিংবা ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছে। অথচ স্বাভবিক সময়ে তাদের সচ্ছলতার কোনো অভাব ছিলো না। তাই প্রশ্ন জাগে, সরকারি প্রণোদনা গেলো কাদের হাতে? আমাদের সার্বিক সংস্কৃতি অঙ্গনে চলছে অশনি সংকেত। শিল্পীদের দৈনন্দিন জীবন এখন আশঙ্কাগ্রস্ত। কর্মজীবী শিল্পীরাও এখন বেকারত্বে দিনাতিপাত করছে। নাট্যজগত, সংগীতজগত, সিনেমা সব খাতের শিল্পীরাই হুমকির মুখে। এ ক্ষতি আমাদের চলমান ধারাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। করোনা স্বাভাবিক পর্যায়ে আসলেও যা থেকে উঠতে অনেকটা সময় লাগবে। তাছাড়া এ সংকটগুলোর রেশ অনেক দিন বা অনেক কাল বহন করতে হবে আমাদের। হয়তো এক্ষেত্রে আমাদের চলার পথ বা মতের পথের ভিন্নতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই সংকেত কিছুটা হলেও আমরা আজ বুঝতে পারছি। বিকাশের চেয়ে আজ প্রকাশটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটু শিক্ষার মধ্যে অনেক প্রকাশ, যা ভুলে জর্জরিত। কিন্তু এই ভুলগুলো কিছুদিন পর বা কিছু কাল পর অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় এটি অনেক ক্ষতির সম্মুখীন করবে।
সবচে বড় কথা, সংগীত ও নৃত্য অনলাইনে কোনোভাবে সঠিকভাবে শেখানো যায় না। গুরু শিষ্য পরম্পরার প্রথম শর্তই হচ্ছে গুরুর সান্নিধ্য বা গুরুর কাছে সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে তালিম নেওয়া। আমাদের দেশে একে তো নেটওয়ার্ক দুর্বল, উপরন্তু ক’জনেরই ভালো মোবাইল বা ট্যাব বা কম্পিউটার রয়েছে, যা দিয়ে তারা অনলাইন মিউজিক ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে? বাংলাদেশে বড় বড় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করছে অনলাইনে শিক্ষা দেওয়ার। কিন্তু সেটা খুব একটা সফলতা পায় নি। এ দুর্দিনে শিল্পীদের মানসিকভাবে সুস্থ ও চাঙ্গা রাখার জন্য সারা পৃথিবীতেই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে এক কানাকড়ি পাচ্ছে না শিল্পীরা। যে কারণে অনেক শিল্পী এ ধরণের অনুষ্ঠান করা থেকে বিরত আছেন। যারা সুন্দর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন তাদের সাধুবাদ জানাই এবং প্রশংসা করি। তবে এই সুযোগে ফেসবুক ও ইউটিউবের বদৌলতে বহু আনকোরা শিল্পী বড় শিল্পী (!) বনে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব আমাদের সর্বস্তরের সংগীতাঙ্গনেই পড়তে বাধ্য।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিল্পীই হতদরিদ্র এ কথা অস্বীকার করতে বাধা নেই। শিল্পীদের এই হতদরিদ্র অবস্থায় সামর্থ্যবান শিল্পীরা যদি এগিয়ে না আসে, সমাজের উঁচু মহল যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে আমাদের সংস্কৃতির বিরাট ক্ষতি হবে। আমি মনে করি, বর্তমানে সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং কর্পোরেট হাউসগুলোর এগিয়ে আসার সময় এসেছে। এদেশের আপামর শিল্পী সমাজের দিকে তাকিয়ে তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। যদি তারা এই গুরুত্ব বুঝতে না পারেন তাহলে শিল্পীসহ শিল্পীর তালিকা থেকে অসংখ্য নাম হারিয়ে যাবে। সাহায্যের বন্টন হতে হবে খুবই যাচাই বাছাই করে। সেটা অবশ্যই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হলে ভালো হবে। সরকারের সৎ এবং নিষ্ঠাবান কর্মীর হাত দিয়ে অবশ্য এই দায়িত্ব বন্টন করতে হবে। যারা সত্যিকার অর্থে শিল্প সমাজকে ধরে রেখেছে, যারা দিনের পর দিন সমাজের উন্নয়নের জন্যে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে, সংস্কৃতি অঙ্গনে যাদের অবদান অনেক বেশি তাদেরকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে অবশ্যই অনুদানের পরিমাণ একটু বেশি দিয়ে হলেও তাদের মনোবলকে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু সংস্কৃতি কর্মীদের কোনো কথা শোনার মত লোক বাংলাদেশে নেই। যারা অভিভাবক রয়েছেন তাদের আবার উদার মনোভাব নেই। লক্ষ্য করা যায়, কিছু প্রতারক সংস্কৃতিসেবী হয়ে সত্যিকার অর্থে সঠিক শিল্পীকে তারা মূল্যায়ন করে না। তাদের যারা তৈল মর্দন করে তাদের কথাই শুনেন বা তাদের জন্য কিছু কাজ করেন, বাকিরা নিজের আখের গোছাতে থাকেন। এমন সামাজিক অবনতিতে কতটা সংস্কৃতির প্রসার হবে তা হয়তো সবাই বুঝতেই পারছেন। এদেরকে উপেক্ষা করে ভালো পর্যায়ে ভালো কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না। এদিকে উদারপন্থী কিছু মানুষ এদের ভয়ে বা নোংরামিতে না যাওয়ার জন্য সংস্কৃতি অঙ্গনে পা বাড়ান না। এভাবে দিনের পর দিন পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। এছাড়াও আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতি সংস্কৃতি চর্চা করার পেছনে নানা রকম বাধা হিসেবে রয়েছে আগে থেকেই।
কোনো দেশের সংস্কৃতির উন্নয়নের সাথে সেই দেশের উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে দেশের সংস্কৃতি যতো উন্নত সে দেশ ততো বেশি উন্নত। সংস্কৃতি অঙ্গন যদি শিল্পী শূন্য হতে থাকে তাহলে কী বিপর্যয় হবে তা কি আমরা বুঝতে পারছি? আমাদের একটি কথা খেয়াল রাখা উচিত, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভিন্ন। এদেশে সবচেয়ে অসহায় হচ্ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। বাইরে থেকে কে কী ভাবে জানি না, এই দুই ভাগের মধ্যেই বেশির ভাগ শিল্পী ও সহ-শিল্পীরা পড়েন। এদের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই থাকে না, যে কারণে জীবনের শেষ সময়ে এসে তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার হন। আর বাধ্য হন অন্যের কাছে হাত পাততে। করোনাকালে আর শেষ বয়সে নয়, যার যার অবস্থান থেকে কোণঠাসা হয়ে গেছেন আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষগুলো। ছেলে-মেয়েদের ভরণপোষণ কতটুকু চালিয়ে নিতে পারবেন তা বলা বেশ মুশকিল। এদের অনেকেই স্কুল, কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিযুক্ত ছিলেন শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের বেতন বা চাকুরি কোনোটাই নেই। অনেকে শুধুমাত্র টিউশনি করেই তার সংসার চালাতেন। সে জায়গা থেকেও কেউ বিনা ক্লাসে টিউশন ফি প্রদান করছেন না। এ কঠিন পর্যায় থেকে কবে রেহাই পাবেন তা হয়তো জানা নেই আমাদের এই প্রিয় মানুষগুলোর। জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করে নিজের চর্চাকে ধরে রাখা অনেকটাই কষ্ট। আমার জানা মতে, এমনও অনেক শিল্পী রয়েছেন যাদের অভাবে সংসার পর্যন্ত ভেঙ্গে গেছে। দিশেহারা হয়ে কেউবা ধর্ম ত্যাগ কেউবা পরিবার ত্যাগ করেছেন। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি, আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গন আজ কঠিন থেকে কঠিন সময় পার করছে। আর এ সময়ে যারা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাদের প্রতি আমরা শিল্পী সমাজ কৃতজ্ঞ। এরাই সত্যিকারের সংস্কৃতি সেবী। এরাই সমাজের পরম বন্ধু। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এ লড়াইকে ভয় পেয়ে সরে গেছেন তারা কখনোই সংস্কৃতিসেবী নন। তারা ছিলেন সুবিধাভোগী। আজ সময়ের সাথে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। সমাজে এদের মতো কুলাঙ্গারদের বাস্তবধর্মী চিন্তাচেতনার নগ্ন রূপগুলো প্রকাশ পেয়েছে।
আমাদের রয়েছে প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ, নবান্ন উৎসব, নৃত্য দিবস, সংগীত দিবস, কবিদের জন্মজয়ন্তী, নাট্য দিবস ও নানা জনের প্রয়াণ দিবস। কোথা থেকে এ দিবসগুলো হারিয়ে গেলো টেরও পেলাম না। যেখানে হাজার হাজার দর্শক নিয়ে বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানগুলো করা হতো, সেখানে আজ দেড় বছর কোনো অনুষ্ঠান নেই। কিছু বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে হচ্ছে, কিন্তু এভাবে নানারকম প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে শুধু যে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, বিশেষভাবে যারা টেকনিক্যাল সাইডে (স্টুডিও, ভিডিও, সাউন্ড, লাইটিং, পরিবহন, ক্যামেরাম্যান) কাজ করে তাদের এখন দিন চলতে অনেক কষ্ট। লক্ষ, কোটি টাকার সম্পদ এখন গোডাউনে পড়ে আছে, অথচ স্বাভাবিক সময়ে এই কাজ করে অনেকে সংসার চালাতেন। এখন দোকান ভাড়া, কর্মচারী বেতন এবং গোডাউন ভাড়া দিয়ে খুব বিপর্যয়ে আছেন। আজ তাদের পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। যারা লোন করে বাকিতে অনেক জিনিস ক্রয় করেছেন, এখন দোটানায় পড়ছেন সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। এদিকে যতেœর অভাবে কোটি টাকার সম্পদও অচল হয়ে যাচ্ছে।
আমরা প্রত্যাশা করি, সংস্কৃতি অঙ্গনের এই বিপর্যয়ে বা দুর্যোগময় সময়ে সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা যথাযথ হবে এবং অচিরেই করোনা জয় করে আবার মুখরিত হবে আমাদের শিল্পাঙ্গন। নাট্যপাড়া এবং সংগীত মঞ্চগুলো আবারও মুখরিত হবে। শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী, মহিলা সমিতি, জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরী আবার জমজমাট হবে শিল্পী, কলা-কুশলী ও শ্রোতা-দর্শকদের আড্ডায়। করোনার করাল গ্রাসে আমাদের কাছ থেকে অনেক সাহিত্যিক, শিল্পী, সংগঠক, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইলো সমবেদনা।
আমরা চাই না কোনো শিল্পী টাকার অভাবে বা ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যাক, আমরা চাই শিল্পীরা সম্মান আর ভালোবাসা নিয়ে জীবনটা অতিবাহিত করুক। জাতির কল্যাণে শিল্পীদের সঠিক সম্মান দেওয়া উচিত, কারণ শিল্পীর শিল্পত্বটুকু বাগানে ফোটা ফুলের মত। যে ফুল নিজের জন্যে ফুটে না তার সৌন্দর্য এবং গন্ধ সব সময় অন্যের তৈরি। তেমনি শিল্পী কোনো জাতি নয়, কোনো সম্প্রদায় নয়, সে সবার জন্য। সবার মঙ্গল হোক, সুন্দর আগামীতে পথ চলার প্রত্যয়ে আজ এতটুকুই। সবাই ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করুন।
লেখক : সুদীপ কর (তন্ময়), প্রভাষক, কণ্ঠশিল্পী, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; মোবাইল ফোন : ০১৬৪১-৪২০৯৭৬,০১৮৫১-৮৭৭০০৫ ; সাধারণ সম্পাদক, নবজাগরণ সাংস্কৃতিক জোট; অধ্যক্ষ, জয়ধ্বনি সংগীত বিদ্যায়তন।