প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২২, ০০:০০
অদম্য প্রয়াসে এরশাদ কাজীর সফল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প
চাঁদপুর সদর উপজেলার তরপুরচণ্ডী গ্রামের খামারি মোঃ এরশাদ কাজী। পড়ালেখার পাশাপাশি শুরু করেন ব্রয়লারের খামার। আর সেই খামার থেকেই লাভ-লসের হিসাব কষে শুরু করেন লেয়ার, সোনালি মুরগির চাষ ও কাজী মানিক পোল্ট্রি ফিড। আর এভাবেই ভাগ্য বদল হয় এরশাদের।
|আরো খবর
এক যুগে তার ব্যবসার পরিধি কয়েক রকমের হয়েছে। সেখানে কাজ করছেন ১০ জন শ্রমিক। তার প্রচেষ্টায় তিনি ছোট থেকে বড় একজন সফল ব্যবসায়ী হবার দ্বারপ্রান্তে। তার প্রতিষ্ঠানে ৩৫ হাজার মুরগি পালনের ব্যবস্থাসহ ৫০টি গরু পালনের সুযোগ রয়েছে। মূলধনের সাথে ব্যাংকিং ব্যবস্থা পেলে তার এ কার্যক্রম আরো বেগবান হবে।
কৃষিকণ্ঠের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে মোঃ এরশাদ কাজীর ভাগ্য বদলের গল্প।
‘পড়ালেখার পাশাপাশি কেনো খামার শুরু করলেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ কৃষিকণ্ঠকে জানান, চাকরি না করার নেশা থেকেই মূলত আমার খামার করা। আমার ইচ্ছা হলো চাকরি করবো না। তবে, মানুষকে চাকরি দিবো। আর সেই নেশা থেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছি এ খামারকে। আল্লাহর রহমতে দেখেছিও আলোর মুখ। বর্তমানে আমার খামারে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের সর্বোচ্চ বেতন ১২ হাজার টাকা, আর সর্বনিম্ন বেতন ৯০০০ টাকা।
আমি এখন একদিনের মুরগির বাচ্চা এবং বিভিন্ন জায়গায় মুরগির খাবার সরবরাহ করি। আমার খামারে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগী রয়েছে। এছাড়া আমার ডেইরি ফার্ম আছে। সে সুবাদে কোরবানি ঈদের জন্যে ১০টি ষাঁড় বিক্রি করা হবে। আমার এ খামারের পাশেই আমি মাছচাষ করি।
‘কীভাবে শুরু করলেন এই খামার’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি নিজ থেকেই কিছু করবো-এমন ভাবনা থেকেই পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেছি। আমি চাঁদপুর কলেজে বিএসএস-এ পড়াবস্থায় জমি বিক্রির টাকা দিয়ে এ ব্যবসা শুরু করি। ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। বরং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়ে আর টাকা দেয়নি। আমার ব্যবসার পরিধি বড় করতে জমির দলিলাদি মর্টগেজ রেখে লোন চেয়েছিলাম, তারপরও তারা আমাকে দেয়নি। আমি হতাশ হইনি। আমার মূলধনের সাথে ব্যাংকিং ব্যবস্থা পেলে আমার এ কার্যক্রম আরো বেগবান হবে। ৩৫-৪০ হাজার মুরগি পালনের ব্যবস্থাসহ ৫০-৮০টি গরু পালনের সুযোগ রয়েছে।
তিনি জানান, ২০১০ সালে আমি ৫শ’ মুরগী দিয়ে শুরু করি। তখন আমার খরচ হয়েছিলো ২৯ হাজার ৬৭০ টাকা। শুরুতে আমার অভিজ্ঞতা না থাকায় লাভ-লসের হিসাবে আমার লসের পাল্লাটা ভারি ছিলো। প্রথমদিকে বাজারে সঠিক দাম পাওয়াতে লাভ হয়েছিলো কিছুটা। তাতে করে আমি ৫শ’ থেকে মুরগির খামার বড় করে মুরগির সংখ্যা করি ৩৫ হাজার। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ সালে আমার লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিলো প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো।
‘লস হওয়ার পেছনে কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রাথমিক অবস্থায় অনভিজ্ঞ ছিলাম। সিজনালি বাচ্চাও পাইনি। তারপর যখন বাচ্চা পেলাম তখন একটি বাচ্চার দাম ছিলো ৬৯ টাকা করে। আর সেই মুরগি আমি বিক্রি করেছি কেজি প্রতি মাত্র ৯৫ টাকা করে। সবমিলিয়ে অনভিজ্ঞতা আর বাজার হিসাব না বুঝাতে আমাকে লসের ভার বহন করতে হয়েছে।
‘তারপরে কীভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখলেন’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে এসে আমি লেয়ার পোল্ট্রি খামারের পাশাপাশি শুরু করি সোনালি মুরগি পালন। আর তাতেই আসে আমার সোনালি দিন। সাথে আছে অভিজ্ঞতাও। আর সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগিতে ভাগ্য বদল করতে সামর্থ্য হই।
তিনি বলেন, প্রথমে আমি ১ হাজার বাচ্চা দিয়ে শুরু করে প্রায় ২৪ হাজার টাকা লস করি। তারপর ২০১৮-এর শেষের দিকে লস কাটিয়ে ২৬শ’ বাচ্চায় লাভ করি ৮০ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে এসে শেড আরো বড় করি। তখন আমার খামারে বাচ্চার সংখ্যা ৪ হাজার। ২০২০ সালে এসে ৪ হাজার ৮শ’ বাচ্চার এক চালানে আমার লাভ হয় প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো। করোনার পরে ৪ হাজার বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজারে। মোটকথা, করোনার আগে-পরে আমার লাভ হয় প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো। ২০২১ সালে এসে আবার আল্লাহর রহমতে আমার লাভ দিয়ে শুরু হয়। তখন আমি ৪ হাজার বাচ্চায় লাভ করি প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। আর এভাবেই চলছে। আল্লাহর রহমতে খামারের ভালো অবস্থা। বর্তমানে মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম বেশি হওয়ায় ভালো যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, এই ব্যবসায় কখনও হতাশ হওয়া ঠিক নয়। লেগে থেকে কাজ করতে হবে। আমি প্রথমে অনভিজ্ঞ ছিলাম। পরবর্তীতে অভিজ্ঞতা আর বাজার পলিসি জানার কারণে লসের ভার বহন করতে হচ্ছে না। এখন আমি বাচ্চা কখন কীভাবে কিনতে হবে তা বুঝি। এমনকি খামারের বাচ্চার প্রাথমিক চিকিৎসাও আমি দিয়ে থাকি। একান্ত মারাত্মক কোনো সমস্যা না হলে আমি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই না।
‘সরকার থেকে কেমন সহযোগিতা আশা করছেন’ এমন প্রশ্নে তিনি জানান, গেলো বছর সরকারের প্রণোদনা হিসেবে ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। বাংলাদেশে খামারিদের জন্যে এখনও সহজভাবে কোনো ঋণ দেয়া হচ্ছে না। আমরা চাই খামারিদের জন্যে কম সুদে সরকার ঋণের ব্যবস্থা করুক। তাতে করে আমরা যারা উদ্যোক্তা আছি তারা আরো ভালো করে কাজ করার সুযোগ পাবো।
তরপুরচণ্ডী কাজী বাড়ির মৃত মোঃ রফিকুল ইসলাম কাজীর ২য় ছেলে মোঃ এরশাদ কাজী। এরশাদ দুই সন্তানের জনক। তার ছেলে আব্দুল আজিজ তাসকিন আহমেদ কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আর কন্যা তাসমিন খানম (৩)। তার স্ত্রী রুনা আক্তার একজন আদর্শ গৃহিণী। এরশাদ কাজীর মা আমিনা বেগম। তার দুই ভাই দুই বোন রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মোঃ এরশাদ কাজী একজন সফল ব্যবসায়ী। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত স্থানীয় তরপুরচণ্ডী ইউনিয়ন পরিষদের সফল সদস্য হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন।