বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩২

শিক্ষকতার সমান্তরালে একজন সংগীতপ্রিয় মানুষ আলমগীর হোসেন বাহার

কবির হোসেন মিজি
শিক্ষকতার সমান্তরালে একজন সংগীতপ্রিয় মানুষ আলমগীর হোসেন বাহার

চাঁদপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. আলমগীর হোসেন বাহার একাধারে একজন গুণী শিক্ষক, আবার অন্যদিকে একজন সংগীতপ্রেমী মানুষ। তাঁর কণ্ঠে যখন বেজে উঠে লালনের দর্শন কিংবা নদীভাঙ্গা ভাটিয়ালি সুর, তখন শ্রোতা ভুলে যায় তিনি একজন বিজ্ঞানের মানুষ। তিনি গান ভালোবাসেন মনপ্রাণ দিয়ে। সংগীতের টানেই একতারা, দোতরা, তবলা, হারমোনিয়ামের তালে তার বাসার ড্রইং রুমে প্রায়শই বসে যায় সুর ও গানের আসর।

ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী ও সংস্কৃতি অনুরাগীদের কাছে তিনি একজন গায়ক শিক্ষক হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর জীবনে সংগীত কেবল একটি শখ নয়, এটি তাঁর আত্মার অভ্যন্তরীণ ভাষা। শুধু কলেজের পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নন তিনি। বিভিন্ন সময় চাঁদপুর শহরের ছোট-বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন কিংবা কলেজের অভ্যন্তরীণ অনুষ্ঠানে তাঁর কণ্ঠে গান শোনা গেছে বহুবার। এই ব্যস্ত শহরের মাটিতে এখনো কিছু মানুষ আছেন যারা নিয়ম করে আয়োজন করেন গানের আড্ডা। মো. আলমগীর হোসেন বাহার তাঁদেরই একজন। সংগীতের প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসা যে, তিনি প্রায়শই নিজ বাসায় সংগীতের আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন। নিজের বাসায় একতারা, দোতরা, তবলা, হারমোনিয়ামসহ দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী বাদকদের ডেকে বসান গান-বাজনার আসর। সুরের ঐ আড্ডায় কখনো শোনা যায় রবীন্দ্র সঙ্গীত, কখনো নজরুল, আবার কখনো লালন বা মুর্শিদি গানের আধ্যাত্মিকতা। শুধু নিজে গান গাওয়া নয়, বরং সুর ও সাধনার মাধ্যমে তিনি তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে চান শেকড়ের সংগীতকে আপন করে নিতে। গানের মধ্যে যে দর্শন, যে জীবনবোধ, তা ছড়িয়ে দিতে চান চারপাশে।

চাঁদপুরের এই ব্যতিক্রমী শিক্ষক, যিনি একজন শিক্ষক হয়েও মনেপ্রাণে সংস্কৃতির সেবক, তাঁর সঙ্গে বসেছিলো আমাদের এক বিকেলের গল্পসন্ধ্যা। কথা হলো গান, জীবন, শিক্ষকতা, সংস্কৃতির দায় এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে।

দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘সংস্কৃতি অঙ্গন’ পাতার পক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলা হয় সংগীত, জীবনবোধ এবং সংস্কৃতি নিয়ে। পাঠকদের জন্যে রইলো মো. আলমগীর হোসেন বাহারের সংগীত-ভুবনের অন্তরঙ্গ কিছু কথা।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি তো পদার্থবিদ্যার শিক্ষক, সংগীতের প্রতি এতো গভীর টান কীভাবে এলো?

আলমগীর বাহার : প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি এগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, নিয়মিত অনুশীলন ও অনুপ্রেরণায় এই সত্তার বিকাশ ঘটে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের হুমায়ুন আহমেদ স্যার, যিনি রসায়নের ছাত্র ছিলেন। আর পদার্থবিদ্যা কিন্তু সুর, স্বর, উপসুর, মেলোডি, অষ্টক ও সরগামের স্রষ্টা।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : সংগীতের সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় হয়েছিলো কখন?

আলমগীর বাহার : সংগীতের প্রতি অসীম অনুরাগ আমার শিশুকাল থেকেই ছিলো।প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমার সংগীত জীবন শুরু হয়।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি কি কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন?

আলমগীর বাহার : ঢাকায় ললিতকলা একাডেমিতে কিছুদিন সম্পৃক্ত ছিলাম। পড়াশোনার চাপে বেশিদিন কন্টিনিউ করতে পারিনি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি তো একতারা, দোতরা, তবলা, হারমোনিয়াম বাদকদের ডেকে মাঝে মাঝে নিজ বাসাতে গানের আড্ডা জমান। এগুলোর প্রতি আগ্রহ কবে থেকে?

আলমগীর বাহার : তার, যন্ত্র ও বাঁশির সুর আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। এক যুগের মতো সময় থেকে আমি বাঁশি, দোতারা, বেন্জু, মন্দিরা, হারমোনিয়াম ও তবলা দিয়ে গান করতে বেশি ভালোবাসি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনার সবচেয়ে প্রিয় ধারার গান কোনটি?

আলমগীর বাহার : কঠিন প্রশ্ন করেছেন। আমি সাধারণত ছোটবেলা থেকে লোকজ সংগীতকে লালন করে আসছি। ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, লালন, আব্দুল আলীম, শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, রাধারমন ইত্যাদি হারানো আঞ্চলিক ও লোক সংগীত আমার সংগীত জীবনের অনুষঙ্গ।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি কি নিজে গান লেখেন বা সুর করেন?

আলমগীর বাহার : চেষ্টা করছি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনার প্রিয় গায়ক বা সংগীতশিল্পী কে?

আলমগীর বাহার : এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা ও অপরাপর লোকসংগীত শিল্পী।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : কলেজ বা বাইরে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?

আলমগীর বাহার : কলেজ ও কলেজের বাইরে আমার শিক্ষকতা পেশার সাথে সংগতিপূর্ণ পরিবেশে গান করি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : একজন শিক্ষক হয়ে গান গাওয়ার সময় কি কখনো জড়তা অনুভব করেন?

আলমগীর বাহার : সংগীতে জড়তা থাকলে প্রকৃত শিল্পী হওয়া যায় না।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : ছাত্র-ছাত্রীরা আপনার এই গানের প্রতিভা সম্পর্কে কতোটা জানে?

আলমগীর বাহার : আমার শিক্ষার্থীরা আমার গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা ও ভক্ত। এর বাইরে আপনারা তো আছেনই।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি কি মনে করেন, একজন বিজ্ঞানের মানুষও সংস্কৃতি চর্চায় সমানভাবে অবদান রাখতে পারেন?

আলমগীর বাহার : নিশ্চয়ই পারেন। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির সংযোগ থাকলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্েয সুন্দর একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ কতোটা জরুরি বলে মনে করেন?

আলমগীর বাহার : পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে কো কারিকুলাম এক্টিভিটিজে সম্পৃক্ত রাখলে ওরা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি হবে।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনাকে কি পরিবার থেকে সংগীতচর্চার প্রেরণা দেওয়া হয়েছিল?

আলমগীর বাহার : পরিবারই হলো সংস্কৃতিচর্চার আঁতুরঘর।

আমার পরিবারের অনুপ্রেরণায় সংগীতকে ধরে রাখতে পেরেছি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : বর্তমানে যান্ত্রিক জীবনে সংগীত কিভাবে মানসিক প্রশান্তি দেয় বলে আপনি মনে করেন?

আলমগীর বাহার : খেলাধুলার পাশাপাশি সংগীত মানসিক প্রশান্তির অন্যতম উপাদান।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি কীভাবে সময় ম্যানেজ করেন শিক্ষকতা, পরিবার ও সংগীতচর্চার মধ্যে?

আলমগীর বাহার : কথায় আছে যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। ইচ্ছা শক্তি বড় শক্তি।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আলমগীর বাহার : পৃষ্ঠপোষকতার চরম ঘাটতি রয়েছে আমাদের। ফলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : এখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গান বা সংস্কৃতি চর্চা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আলমগীর বাহার : তরুণ প্রজন্ম এখন আমাদের দেশী সংস্কৃতিতে আবার ফিরে আসছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এখন লোকজ গানে ফিরে আসছে। ওদের কণ্ঠে এখন হারানো দিনের গান এবং ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি শোনা যায়।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি কি ভবিষ্যতে সংগীত নিয়ে কোনো বই, অ্যালবাম বা গবেষণা প্রকাশ করতে চান?

আলমগীর বাহার : প্রবল ইচ্ছা আছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : আপনি যদি কোনো জাতীয় মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ পান, কোন্ গান দিয়ে শুরু করতে চাইবেন?

আলমগীর বাহার : আমার বাংলাদেশের একতারা সুর কতোই ভালোবাসি। এটি আমার প্রিয়গানের মধ্েয অন্যতম গান।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : নতুন প্রজন্মকে সংগীতচর্চা বিষয়ে কী পরামর্শ দিতে চান?

আলমগীর বাহার : নতুন প্রজন্মকে আমার একটি পরামর্শ দিতে চাই। পড়ালেখার পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করে সুষ্ঠু ধারার সংস্কৃতি ও লোকজ সংগীতকে ধারণ করতে হবে। আর বিজাতীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য না দেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়