প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
বার্তাকক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছি। হঠাৎ প্রধান সম্পাদক তলব করলেন। ওনার কক্ষ থেকে ডাক আসা মানে কিছু একটা ভুল হয়েছে। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। তবে সামনে গিয়ে মনে হলো, আজকে ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। তিনি সহাস্যে বসতে বললেন। একথা-সেকথার পর বললেন, আমরা শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চাই। কী করা যায়? তারপর নিজ থেকেই বললেন, শিশুদের জন্যে একটা পাতা বের করতে চাই, পারবে? ওনার মুখের উপর না করবে এমন কেউ তখন নিউজরুমে ছিলো না। আমিও না করতে পারলাম না।
ইতিমধ্যেই ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। বাড়তি একটা পাতা সম্পাদনা করা কঠিন হবে। কিন্তু ওই যে বললাম ওনার অনুরোধ মানে সবার জন্যে আদেশ। চেয়ারে ফিরে এসে একটা ঘোষণা লিখে ফেললাম। হাতে লেখা সে ঘোষণার লেখা নিয়ে ওনার কাছে গেলাম। লেখাটি ওনার এতই পছন্দ হয়েছে যে, তিনি তাৎক্ষণিক জোরে হাঁক দিয়ে অফিস সহায়ককে বললেন, পলাশকে কী খাওয়াবা, খাওয়াও। ওনার নাম কাজী শাহাদাত। দীর্ঘদিন ধরেই সাংবাদিকতায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছেন, আমরা তাঁর সারথী। আমি যখন সহকারী বার্তা সম্পাদক তখন একটি বানান ভুল হয়েছিলো। সেটা তিনি আমাকে কাগজে ৫০০ বার লিখতে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় তিনি কতোটা সিরিয়াস এই কাজ তার প্রমাণ। আমাদেরকে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে নানারকম পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যারা সেসব পরীক্ষায় উতরে যেতে পারেনি, তারা হয় তলানিতে ছিল, না হয় হারিয়ে গেছে। এমন একজন কঠিন মানুষের কাছে সহাস্য বাহবা পাওয়া তখন অনেকটা স্বপ্ন-ই ছিল।
আমরা যারা তখন তরুণ, আনন্দের সাথে সাংবাদিকতা করছি তারা তখন তাঁকে মারাত্মক ভয় করি। কিন্তু একই সাথে আবার শ্রদ্ধা করি। কারণ তিনি নিউজের ট্রিটমেন্ট দিতে জানতেন। আমার মনে আছে, আমার প্রথম বাইলাইন নিউজ হয়েছিলো একমাস পর। খেটেখুটে ‘ক্রি-চক্রে জাটকা ব্যবসা’ শিরোনামের সংবাদটি একইসাথে লিড হয়েছিলো। এই লেখা দেয়ার পর তিনি মির্জা জাকির ভাইকে বলেছিলেন, ছেলেটা বহুদূর যাবে। তবে তিনি কখনো সামনে প্রশংসা করতেন না।
‘শিশুকণ্ঠে’র ঘোষণা পরদিন প্রকাশ হলো। আর হুড়মুড় করে চিঠি আসতে লাগলো। সেই শিশুকণ্ঠ বহুদূর গিয়েছিল। তিনি কখনো আমার কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। প্রতি সপ্তাহে এক বস্তা চিঠি আসতো। সেগুলো খুলে দেখা কী যে আনন্দের! কষ্ট হতো বাছাই করতে। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না। অনেকেই আসতো দেখা করতে। বর্তমান সময়ে হলে হয়তো ফেসবুক ভেসে যেত!
আমার আরেকটা সাড়াজাগানো সিরিজ ছিলো ‘মাদ্রাসা শিক্ষার অন্তরালে’। ১৩টা পর্ব বের হয়েছিলো। সেটা লিখেছিলাম ছদ্মনামে। অনেক লোক আমাকে খুঁজতো। কিন্তু কাজী শাহাদাত ভাইয়ের (পরে অবশ্য আত্মীয়তার কারণে চাচা) কঠোর গোপনীয়তায় শুধু আমি, তিনি আর আমাদের কম্পিউটার অপারেটর নুরু ভাই ছাড়া কেউ জানত না কে লিখছে এই সিরিজ। প্রতিপক্ষের অবস্থা এমন ছিল যে, আমাকে পেলে তারা গিলে খাবে। চাঁদপুর কণ্ঠ নিয়ে আমার আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা আছে। একবার রমজান মাসে প্রধান সম্পাদক মহোদয় ঢাকা যাবেন, তাই তাঁর বিছানায় রাতে আমি ঘুমাব। রাতে যথারীতি কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছি। সেহেরি খেতে উঠে দেখি আমার শার্ট-প্যান্ট কিছুই নেই। জানালা খোলা। যা বুঝার বুঝে গেলাম। চোর বেটা সব নিয়ে গেছে। রাতেই মাহবুবুর রহমান সুমন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। তখন চাঁদপুর কণ্ঠের অফিস ছিলো গুয়াখোলার মুখে। সুমন ভাইয়ের বাসাও গুয়াখোলায়। তিনি আমাকে শার্ট দিলেন। ওনার বাসায় রাতে সেহেরী খেলাম। ফিরে এসে দেখি জানালার পাশেই বাইরে শার্ট-প্যান্ট, মানিব্যাগ। শুধু টাকা ছাড়া সে আর কিছুই নেয়নি। শুধু গুয়াখোলা না, প্রফেসর পাড়ার বাসায়ও আমি একাধিক রাত থেকেছি ওনার অবর্তমানে।
চাঁদপুর কণ্ঠ ছিলো আমাদের জন্যে একটা আনন্দ ঘর। বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা একসাথে কোরাস গাইতাম। মুড়ি-চানাচুর আর কোরাস ছিলো আমাদের নিত্য সঙ্গী। পাঠক ফোরাম দেখতো শাহাদাত হোসেন শান্ত, ভালো আঁকিয়ে ছিল নাজমুস শাহরিয়ার মিরণ। বন্ধু কাওসার, আলম পলাশ ভাই, পেস্টার দেলোয়ার ভাই সবাইকে নিয়ে আমাদের কত স্মৃতি। সব লিখতে গেলে বিরাট ভলিউমের বই হয়ে যাবে। যখন সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হবে, তখন টানা তিনদিন তিনরাত আমরা চেয়ারে বসা। কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ঘুম আসলে চেয়ারেই ঘুম। গিয়াসউদ্দিন মিলন ভাই আমাদের উজ্জীবিত রাখতেন।
চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার সম্পর্ক আসলে এর গর্ভাবস্থায়-ই। লোগো নির্বাচন থেকে শুরু করে সব কাজে আমি ছিলাম মির্জা জাকির ভাইয়ের সঙ্গী। তিনিই আসলে আমাকে নিয়ে আসেন এই পত্রিকায়। ইকবাল ভাইয়ের বকুলতলার চেম্বার, লন্ডন ঘাটের শাহজালাল প্রিন্টার্স এবং জিলানী প্রিন্টিং প্রেসে আমাদের চলাফেরা ছিলো উন্মুক্ত। ইকবাল ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস ম্যাডাম ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তাঁর ছাত্র হওয়ার সুবাদে সে বাসায় যাতায়াতে আমার কখনো কুণ্ঠা ছিল না। চাঁদপুর কণ্ঠের স্মৃতি লিখলেই জাকির ভাইয়ের কথা আমার সামনে চলে আসে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় বাড়ির পাশের বিদ্যাবতী খালে গোসল করছিলাম। তখন একদল সাংবাদিক আসে কোনো কারণে। আমার শুধু মনে আছে, আশেপাশে অনেক লোক দাঁড়ানো, পুলিশ আছে, সবার চোখ সাংবাদিক সাহেব কী বলে, কী লিখে সেদিকে। তখন মনে মনে সাংবাদিক হওয়ার বাসনা তৈরি হয়।
আমরা খেলাঘরের সভ্য ছিলাম। সে সুবাদে জাকির ভাইকে কাছে পাই। যখন এসএসসির গণ্ডি পেরিয়েছি, একদিন জাকির ভাইকে বললাম, আমি সাংবাদিক হতে চাই। তিনি তখন সম্ভবত বাংলার বাণীর জেলা প্রতিনিধি। জাকির ভাই আমাকে স্নেহ করেন। তিনি এককথায় বলে দিলেন, যাও তোমার দায়িত্ব আমার। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ওনাদের কাচারী ঘরে আমাদের বহু আড্ডা হতো। সে আড্ডার আলোচ্য বিষয় ছিল সাংবাদিকতা বিষয়ক পড়াশোনা। তিনি বিভিন্ন বই এনে পড়তে দিতেন।
চাঁদপুর কণ্ঠে একবার নিউজ করলাম লেডি প্রতিমা স্কুলে বোর্ডের ধার্য টাকার চাইতে বেশি টাকা নিচ্ছে। সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি করলো। তখন ডিসি অফিস বর্তমান জেনারেল হাসপাতাল ভবনে। একজন এডিসি তদন্ত কমিটির প্রধান। আমার সে কী ভয়! টেনশনে কয়েকদিন আমার ঘুম হলো না। যদিও সব ডকুমেন্টস্ দেখে তিনি বললেন, এগুলো সব সংরক্ষণ করেছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। পরে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার ইউএনও ছিলেন মিকাইল শিপার। একবার একটা কাজে গেলাম। তিনি বিশ্বাসই করলেন না, আমি চাঁদপুর কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক। বললেন, চাঁদপুর কণ্ঠের টিএন্ডটি নাম্বার থেকে আমাকে ফোন দিবেন। বহু বছর পর ঢাকায় (তিনি তখন ইআরডির সচিব) এ ঘটনা বললে তিনি হো হো করে হেসে দিলেন।
এখন যখন সচিবদের রুমে ঢুকেও নির্ভার থাকি। মন্ত্রীদের সঙ্গে হাসি-আনন্দ ভাগাভাগি করি, তখন ছিলো এসব কল্পনার বাইরে। আমাদের তখন যারা সঙ্গী ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই পরে সম্পাদক হয়েছেন। আলাদা করে নাম লিখলাম না, তবে সবার নাম হৃদয়ে গেঁথে আছে। এখনও যখন যে অবস্থায় থাকি, চাঁদপুর কণ্ঠ আমার প্রথম ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কখনো মৃত্যু নেই, হতে পারে না। প্রথম খুঁটির শক্তির কখনো মৃত্যু হয় না।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক বাণিজ্য প্রতিদিন; সাধারণ সম্পাদক, ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা সাংবাদিক ফোরাম।