প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:৫৮
নববর্ষের শোভাযাত্রার নাম বদল করছি না, পুরোনো নাম–ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি: ঢাবি উপাচার্য

পুরাতন নামেই ফিরে যাওয়া নাকি নতুন প্রভাবের অধীনতা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্প্রতি এক ঘোষণায় জানান, নববর্ষ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তন করে “নববর্ষ শোভাযাত্রা” করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, এটি কোনো নতুন নাম নয়, বরং পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া। তবে এই বক্তব্য ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। কেউ একে সংস্কৃতি-সম্মত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, কেউ আবার বলছেন, এটি মৌলবাদী চাপের সামনে মাথা নোয়ানো।
“নাম বদল নয়, আমরা পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরছি”—ঢাবি উপাচার্য
মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি: প্রতিরোধের প্রতীক
১৯৮৯ সালে সামরিক শাসনের সময়ে চারুকলা অনুষদের কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মিলে শুরু করেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। উদ্দেশ্য ছিল অন্ধকার, কুসংস্কার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো। এতে উঠে আসে মুখোশ, পাখি, গরু, সূর্য, রথ—সবই প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির জাগরণের। পরবর্তীতে এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়—২০১৬ সালে ইউনেস্কো এটিকে ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity’ হিসেবে ঘোষণা করে।
সেই শোভাযাত্রার নাম থেকে “মঙ্গল” শব্দটি বাদ দেওয়া মানে শুধু শব্দ নয়, চেতনার এক অংশ বাদ দেওয়া।
“মঙ্গল” শব্দের তাৎপর্য ও বিতর্ক
কেউ কেউ দাবি করছেন, “মঙ্গল” শব্দটি হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত, তাই এটি ধর্মনিরপেক্ষ নয়। কিন্তু বাস্তবে “মঙ্গল” শব্দটি বাংলা ভাষায় শুভ, কল্যাণ, অন্ধকার দূরীকরণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দের সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা ধর্মীয় নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনারই প্রতীক।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে—এই নাম বদলের মাধ্যমে কি আমরা মৌলবাদী চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি? নাকি প্রশাসন কোনো চাপের মুখে নতি স্বীকার করছে?
ঐতিহ্য কি শুধু নামেই ফেরত যায়?
ঢাবি উপাচার্য বলেছেন, “পুরনো ঐতিহ্যে ফিরছি”। কিন্তু প্রশ্ন হলো—“নববর্ষ শোভাযাত্রা” নামে কি আদৌ কোনো ঐতিহ্য ছিল? ইতিহাস বলে, ১৯৮৯ সালেই প্রথম এই শোভাযাত্রার সূচনা হয় এবং তখন থেকেই এর নাম ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। কাজেই ‘পুরনো ঐতিহ্য’ বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা অস্পষ্ট।
নাম বদল: সময়ের দাবি না রাজনীতির প্রভাব?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বেড়েছে। বাংলা নববর্ষ, পহেলা ফাল্গুন, বসন্ত উৎসবসহ নানা উৎসব নিয়ে প্রতিবাদ ও নিষেধাজ্ঞার ডাক দেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলের পেছনে হয়তো রাজনৈতিক চাপ বা মৌলবাদী হুমকি কাজ করছে।
এটা যদি সত্য হয়, তবে তা শুধুই একটি নাম বদল নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণ।
বাংলা নববর্ষ: আমাদের পরিচয়
বাংলা নববর্ষ কেবল একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষ পহেলা বৈশাখে একত্র হয়। এই দিন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, ঐক্য ও জাতিসত্তার পুনরুজ্জীবন ঘটায়।
কাজেই এই উৎসবের উপাদান, নাম, প্রতীক—সবকিছু নিয়ে কোনো পরিবর্তনের আগে দরকার গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যায়ন।
উপসংহার: দায়িত্বশীলতার দাবি
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র। সেখানে সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি ঐতিহ্য রক্ষার দায়ও রয়েছে। নাম বদল নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিয়ে অ্যাকাডেমিক, সাংস্কৃতিক ও জনমতভিত্তিক পর্যালোচনা জরুরি।
“মঙ্গল” শব্দ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি যদি সত্যিই সংস্কৃতির পক্ষে হয়, তাহলে তার যথেষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আর যদি এটি কোনো চাপ বা ভয় থেকে হয়ে থাকে—তবে সেটি বাংলা নববর্ষ নয়, বাংলাদেশের আত্মার পরাজয়।
ডিসিকে/এমজেডএইচ