সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

এক নজরে কচুয়া উপজেলা

এক নজরে কচুয়া উপজেলা
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ॥

চাঁদপুর জেলার দুটি বৃহৎ উপজেলার একটি হচ্ছে কচুয়া। ২৬০-চাঁদপুর-১ নামে জাতীয় সংসদের আসনটি এ উপজেলাকে ঘিরেই। এ উপজেলার আয়তন ২৩৫.৮১ বর্গ কিলোমিটার (৫৮,২৭১ একর)। এ উপজেলার উত্তরে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলা ও দাউদকান্দি উপজেলা, দক্ষিণে হাজীগঞ্জ উপজেলা ও শাহরাস্তি উপজেলা, পূর্বে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলা ও চান্দিনা উপজেলা, পশ্চিমে মতলব দক্ষিণ উপজেলা ও হাজীগঞ্জ উপজেলা।

ইতিহাস : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কচুয়া থানা দাউদকান্দি থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে কচুয়া থানা ছিল হাজীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ১৯১৮ সনের ২৫জানুয়ারি হাজীগঞ্জ হতে পৃথক হয়ে কচুয়া থানা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে কচুয়া বাজার এক সময়ে ওলিয়ে কামেল হযরত শাহ নেয়ামত শাহের বাজার নামে পরিচিত ছিল। কচুয়া বাজারের তারিনীর দিঘির পাড়ে ছিল হযরত শাহ নেয়ামত শাহের আস্তানা। তারিনীর দিঘির পাড়ে ওলি আল্লার নিকট ছুটে আসতো দূরে দূরান্তের মানুষ। এতে করে গড়ে উঠে তারিনীর দিঘির পাড় এলাকাকে ঘিরে বাজার। এই বাজারের নামকরণ হয় ওলিয়ে কামেলের নামানুসারে হযরত শাহ নেয়ামত শাহের বাজার। পরবর্তীতে এ নাম লোক মুখে পরিবর্তিত হয়ে কচুয়া থানার কচুয়া নামানুসারে কচুয়া বাজার নামে পরিচিতি লাভ করে।

কচুয়া থানার কচুয়া নামকরণের সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও জনশ্রুতি হিসেবে দুটি তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে, সেনিটিক ভাষায় উপশহরকে কাচওয়া বলে। এ কাচওয়া শব্দ কালক্রমে লোকমুখে রূপান্তরিত হয়ে কচুয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

অন্যটি হচ্ছে, ১৯০৫ সালে হাজীগঞ্জ থানাকে দুভাগে বিভক্ত করে ২টি থানায় রূপান্তরিত করার জন্য সীমানা নির্ণয়ের জন্য জরিপ কাজ চালানো হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে এ জরিপ কাজ পরিচালিত হয়। জরিপ কাজ শুরু হয় দাউদকান্দি থানার দক্ষিণ সীমানা থেকে অর্থাৎ কচুয়া থানার উত্তর প্রান্ত থেকে। জরিপ কাজ চলার এক পর্যায়ে কাজে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য লোকজন বর্তমানে কচুয়া বাজার সংলগ্ন উত্তর পাশের গ্রামের দক্ষিণাংশে এসে ক'টি তালগাছের সন্ধান পেয়ে তালগাছ এলাকার উঁচু স্থানে তাঁবু খাটিয়ে কয়েক দিন অবস্থান করেন। এ গ্রামের জনৈক মৌলভী আলী আকমত পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনাদের জরিপ কাজ শেষ হয়েছে কি? উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কুচ হুয়া। উর্দুতে কুচ মানে কিছু এবং হুয়া মানে হয়েছে। অর্থাৎ কিছু অংশ হয়েছে। এ কুচণ্ডহুয়া শব্দ হতে কচুয়া নামের উৎপত্তি হয়।

প্রশাসনিক এলাকা : কচুয়া উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন রয়েছে। একমাত্র

পৌরসভার নাম হচ্ছে কচুয়া।

ইউনিয়নসমূহ : ১নং সাচার, ২নং পাথৈর, ৩নং বিতারা, ৪নং পালাখাল মডেল, ৫নং সহদেবপুর পশ্চিম, ৬নং কচুয়া উত্তর,৭ নং কচুয়া দক্ষিণ, ৮নং কাদলা, ৯নং কড়ইয়া, ১০নং গোহট উত্তর, ১১নং গোহট দক্ষিণ ও ১২নং আশরাফপুর।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী কচুয়া উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৩,৮২,১৩৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১,৮০,৭৩৬ জন এবং মহিলা ২,০১,৪০৩ জন। মোট পরিবার ৭৬,৬৪২টি। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,৬২১ জন। মোট ভোটার সংখ্যা ২,০৯,৪৮৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ৯৯,৮৬৪ জন এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা ১,০৯,৬২২ জন।

শিক্ষা : ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী কচুয়া উপজেলার সাক্ষরতার হার ৫৩.৮% হলেও বর্তমানে সেটি অনেক বেড়েছে।

বর্তমানে একটি সরকারি কলেজ বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ, ১ টি সরকারি পলিটেকনিক ইনিস্টিউট (চাঁদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) ও ২টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ৩টি ডিগ্রি কলেজ, ১টি কামিল মাদ্রাসা (নিশ্চিন্তপুর ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা), ৬টি ফাজিল মাদ্রাসা, প্রায় ৩০টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ১৭১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রায় একশ’টি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : জামিয়া ইসলামিয়া আহমাদিয়া কচুয়া, কচুয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, নিন্দপুর ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ, পালাখাল উচ্চ বিদ্যালয়, কহলথুড়ি হামিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, আশরাফপুর উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর এম.এ. খালেক মেমোরিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, নিশ্চিন্তপুর ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা ও ইয়াতিম খানা, কোয়াঁচাদপুর দাখিল মাদরাসা, আল ফাতেহা মাদ্রাসা, দরবেশগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, সাচার উচ্চ বিদ্যালয়, প্রসন্নকাপ উচ্চ বিদ্যালয়, তেতইয়া আদর্শ স্কুল, রহিমানগর বি এ বি উচ্চ বিদ্যালয়, গাউছিয়া ছোবহানিয়া আলিম মাদ্রাসা, (ডুমুরিয়া), আকানিয়া নাছিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও চাপাতলী লতিফিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।

অর্থনীতি : কচুয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর অর্থনীতি । জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৪৫.৪৭%, অকৃষি শ্রমিক ৩.৫৩%, শিল্প ৫.৭৬%, ব্যবসা ১২.৭৪%, পরিবহন ও যোগাযোগ ৩.৯৯%, চাকরি ১৩.৯৫%, নির্মাণ ২.০৭%, ধর্মীয় সেবা ০.৫২%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ৪.৯৬% এবং অন্যান্য ৭.০১%।

কৃষিভুমির মালিকানা ভূমিমালিক ৬৮.৫৯%, ভূমিহীন ৩১.৪১%। শহরে ৫৭.৩৭% এবং গ্রামে ৬৫.০৭% পরিবারের কৃষিজমি রয়েছে।

শিল্প ও কলকারখানার মধ্যে রয়েছে আটা কল, হিমাগার, বরফ কল, ওয়েল্ডিং কারখানা। কুটিরশিল্প হচ্ছে স্বর্ণশিল্প, লৌহশিল্প, বাঁশের কাজ, কাঠের কাজ ও রেশম শিল্প। মৎস্য,গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে অনেক।প্রধান কৃষি ফসল হচ্ছে ধান, গম, আলু, সরিষা ও তিল। বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ফসলাদি হচ্ছে পাট, কাউন ও অড়হর। প্রধান ফল-ফলাদি হচ্ছে আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কুল। এখানে প্রচুর কুল বা বরই হয়। এখানে বিভিন্ন রকমের শাক-সব্জি উৎপাদিত হয়, যা এখানের চাহিদা মিটিয়ে অন্যত্র রপ্তানি করা হয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ , কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা উপজেলার অর্থনীতির প্রধান চাবিকাঠি।

রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য : কুল, কলা ও আলু।

কচুয়া উপজেলার উল্লেখযোগ্য হাট-বাজারের মধ্যে রয়েছে : কচুয়া বাজার, রহিমানগর বাজার, সাচার বাজার, বড়দৈল বাজার, বায়েক বাজার, শুয়ারুল গরু বাজার, মাঝিগাছা বাজার, নন্দনপুর বাজার, আলীয়ারা বাজার, নিন্দপুর বাজার, শিলাস্থান বাজার, মধুপুর বাজার, তুলপাই বাজার, ফতেপুর বাজার, সিংআড্ডা বাজার, বাইছারা বাজার, কাদলা বাজার, রঘুনাথপুর বাজার, চৌমুহনী বাজার, উজানী বাজার, তেতইয়া বাজার, হোসেনপুর বাজার, ডুমুরিয়া বাজার, নলুয়া বাজার, মিয়ার বাজার মাসনীগাছা বাজার।

কচুয়ার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বগণ হচ্ছেন : আশেক আলী খান (বাঙালি মুসলিম শিক্ষাবিদ), মুশতাক আহমদ (দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত), মোহাম্মদ আবেদ মিয়া (প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), মেজবাহ উদ্দিন খান (চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পরিচালক ও সাবেক সংসদ সদস্য), ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপি ( সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), ড. মুনতাসির মামুন ( শিক্ষাবিদ, লেখক, ইতিহাসবিদ), গোলাম রহমান (এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (প্রখ্যাত লেখক, চিত্র সমালোচক এবং শিক্ষাবিদ), ড. আ ন ম এহসানুল হক মিলন ( সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী), রফিকুল ইসলাম রনি (সাবেক সংসদ সদস্য),

অ্যাডঃ আবদুল আউয়াল (সাবেক এমপি, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসেনানী, ভাষা সৈনিক, কর্মসংস্থান ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান), অধ্যাপক এ. কে. এস. এম. শহীদুল ইসলাম (জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি), হেলাল উদ্দিন খান শামসুল আরেফিন (নৃবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), বীর উত্তম মোঃ সলিমুল্লাহ প্রধান (নয়াকান্দি), সিরাজুল মওলা বীর উত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমিনুল হক (বি.সি.এস. সাধারণ শিক্ষা), সাবেক উপ-পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা, কুমিল্লা অঞ্চল, কুমিল্লা।

বিবিধ : পোস্ট অফিস : ২৭টি, হাট বাজার: ৩০টি, ব্যাংক : ১২টি (তফসিলভুক্ত)

পর্যটন ও ঐতিহ্য : তুলাতুলী মঠ, পালগিরি মসজিদ (পাঁচশ’ বছরের প্রাচীন)। এখানে রয়েছে বিরাট আকারের অসম্পূর্ণ দিঘি। দিঘির পাড়ে রয়েছে থানা বিবি ও দুলাল রাজার কবর, পাকাঘাট। মসজিদের অদূরে রয়েছে দুটি প্রাচীন পাকা কবর। অনুমান করা হয় এটি নির্মাতার কবরই হবে। দুলাল রাজার দিঘিটি ১৯ একর। মসজিদের পূর্ব পাশে একটি প্রাচীন নৌপথ ছিলো। ক্যাঃ আঃ রব খন্দকারের দাদা জাহনী খন্দকার ১৮০২ সালে মসজিদটি ঝোঁপের মধ্যে দেখতে পেয়ে পুনঃসংস্কার করেন। ক্যাঃ আঃ রব ১৯৯৮ সালে ৮১ বছর বয়সে মারা যান। দুলাল রাজা ও থানা বিবি সম্পর্কে মামা শ্বশুর ও ভাগ্নে বউ ছিলেন। প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তাদের বিয়ে হয়নি বলে জনশ্রুতি আছে।

কচুয়া উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দারাশাহী তুলপাই গ্রামে রয়েছে নাগরাজ কন্যা রামেশ্বরী দেবী ও হযরত দারাশাহের অমর প্রেমের স্মৃতিতে নির্মিত তিন গম্বুজ মসজি দারাশাহী তুলপাই মসজিদ। শেখ দারা রামেশ্বরীর ত্রিতল ভগ্নপ্রাসাদ। ষোড়শ’ শতাব্দীতে সুদূর আরব দেশীয় এক যুবক প্রশাসক দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে বর্তমান কচুয়ার তুলপাই অঞ্চলে আসেন। তিনি নাগরাজ কন্যা রামেশ্বরী দেবীর প্রেমে পড়েন এবং এক যুদ্ধের পর নাগরাজাকে পরাজিত করে রামেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন। বর্তমানে দারাশাহী তুলপাই গ্রামে তার মাজার রয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর মাহ্ফিল হয়। দারাশাহের স্মৃতিতে তার মৃত্যুর দুশ বছর পর নির্মিত মসজিদের শিলালিপিতে আছে, ‘‘মহান আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি। আল্লাহ্ এক। মোহাম্মদ তার রাসূল। নুরুজ্জামান দ্বারা মসজিদটি ১২০২ হিজরী সনে স্থাপিত।’’

আশ্রাফপুর মসজিদ : তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। যেখানে রয়েছে আরবদেশীয় বণিকদের কবর। এখানে রয়েছে নিমাই দিঘি। মসজিদটি বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এখানে রয়েছে অনেক প্রাচীন পাকা কবর। জনশ্রুতি রয়েছে, এগুলো আরবীয় বণিকদের তৈরি।

শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দির : শ্রীগঙ্গাগোবিন্দ সেন এই মন্দির ১২৭৭ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় লোকদের নিকট হতে জানা যায়, গঙ্গা গোবিন্দ সেন রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ দেবকে দর্শন করার জন্যে ভারতের শ্রীক্ষেত্রে যান। অনেক চেষ্টা করার পরেও তিনি জগন্নাথ দেবকে দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে কান্নাকাটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে দেখেন ‘তুমি দুঃখ করিও না, আমি নিজেই তোমার আবাসস্থল সাচারে নিজ বাড়িতে আবির্ভূত হইব’। তখন গঙ্গা গোবিন্দ বাড়িতে আসেন এবং কয়েকদিন পর তার বাড়ির দিঘিতে অলৌকিকভাবে ভেসে আসা নিম কাঠ দেখতে পান, যা’ দ্বারা কচুয়ার বিখ্যাত সাচারের রথ এবং দেব-দেবী নির্মিত হয়।

মনসা মুড়া : এই মুড়া কচুয়া থানায় অবস্থিত। বর্তমানে উক্ত স্থানে বহু বাঁশঝাড় আছে। উক্ত ঝাড়ের চারদিকে অনেক সাপের গর্ত আছে। জানা যায়, হিন্দুদের মনসা দেবীর সেখানে অবস্থান। হিন্দুরা প্রতি বছর চৈত্র মাসে এই মুড়ায় পূজা-অর্চনা করে। এই উপলক্ষে মেলা বসে। হিন্দুরা অনেক মানত করে এবং দুধ-কলা দিয়ে পূজা করে। শুধু তাই নয়, এই বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ কেউ কাটে না।

বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের উপাখ্যান আজও মানুষের মুখে মুখে। কথিত আছে, বেহুলার স্বামী লক্ষ্মীন্দরের দংশনকারী নাগরাণী মনসা দেবীর মনসা মুড়ার অস্তিত্ব রয়েছে কচুয়া উপজেলার ৪নং পূর্ব সহদেবপুর ইউনিয়নের ভূইয়ারা গ্রামে। ভূইয়ারা হাইস্কুল হতে প্রায় ৩০০ মিটার পূর্বে কচুয়া-সাচার সড়ক হতে অর্ধকিলোমিটার পশ্চিমে এবং সুন্দরী খালের উত্তর পাশে খোলা মাঠে অবস্থিত ২১ টি বাঁশ ঝাঁড় নিয়ে গঠিত এই মনসা মুড়াটিকে পরিকল্পিত বাগান বলে মনে হয়। বিকেল গড়িয়ে পড়া সূর্যালোকে প্রায় গোলাকৃতি এ মনসা মুড়াকে দূর থেকে খোলা আকাশের নিচে অপরূপ দেখায়। মানুষ তাদের মঙ্গল কামনায় সাপের গর্ত মুখে নির্মিত বেদীতে নিয়ত করে দুধ ও কলা দিয়ে দেয় পূজা।

জনশ্রুতি রয়েছে, বাসর ঘরে সর্প দংশনের পর মৃত স্বামী লক্ষ্মীন্দকে সাগরে ভেলায় ভাসিয়ে চলার পথে এক পর্যায়ে ভেলাটি ভূঁইয়ারা গ্রামে ভিড়ে ( ভুইয়ারা গ্রাম এককালে উপকূল এলাকা ছিল বলে কথিত রয়েছে)। সেই ভেলায় ব্যবহৃত কাঁচা বাঁশ থেকে শিস বেরিয়ে বর্তমানের এ মনসা মুড়ার সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, এলাকার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সফল করতে এ মনসা মুড়ায় দুধ-কলা দিয়ে থাকে (মানত করে)। এক সময় ভুইয়ারা গ্রামের লোধ বংশীয় লোকেরা মনসা মুড়ায় রক্ষণাবেক্ষণ সহ পূজা-অর্চনা করতো। ১৯৬৮ সালে ওই বংশের লোকজন ভারতে চলে যাওয়ার সময় পাশের মেঘদাইর গ্রামের গোবিন্দ কবিরাজের স্ত্রী যমুনা সুন্দরীকে মনসা মুড়া রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে যান। এরপর যমুনা সুন্দরীর তিরোধানের পর তার পুত্রবধূ নীলা চৌধুরীর পর দেব পরিবারের তত্ত্বাবধানে এ মনসা মুড়ায় পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

এলাকাবাসী জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শিক্ষা সফরের অংশ হিসাবে লোকজন মনসা মুড়া দেখতে আসে। সরকারি ১৯ শতক খাস ভূমির উপর গড়ে ওঠা কিছু সংস্কার কাজ করে এ মনসা মুড়াটিকে একটি চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা যেতে পারে। তাদের মতে, মনসামুড়ায় যেতে ভুইয়ারা স্কুল হতে মনসামুড়া পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা পাকা করা হলে দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য যানবাহনে সরাসরি যাতায়াত খুবই সহজ হবে।

মুড়ার অন্যতম সেবক কচুয়া উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি প্রাণধন দেব, মনসা মন্দির কমিটির সভাপতি ডাঃ হারাধন চন্দ্র দে ও নিত্য পূজারী মেঘদাইর গ্রামের অধিবাসী শংকর দাস জানান, মনসা মুড়ার নিত্য পূজা-অর্চনা ছাড়াও ১ বৈশাখে স্থানীয়দের আয়োজনে মেলা বসে। মনসামুড়াটি গত ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুস সবুর মন্ডল জেলার ব্র্র্র্র্যান্ডিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেন।

সাহার পাড়ের দিঘি : কচুয়া উপজেলার রহিমানগর বাজার হতে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে কচুয়া-কালিয়াপাড়া সড়কের পূর্ব পাশে এই দিঘি অবস্থিত। ৬১ একর আয়তন বিশিষ্ট এই দিঘির সুউচ্চ পাড় এবং পাড়ের ওপর সুবৃহৎ বৃক্ষরাজির চমৎকার দৃশ্য, যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানা যায়, বহুকাল পূর্বে এই এলাকায় ছিলো কড়িয়া রাজা নামে এক প্রতাপশালী রাজা। তার আমলে কড়ির মুদ্রা প্রচলিত ছিলো। একদা কড়িয়া রাজা ব্যাপক আয়োজনভিত্তিক এক পূজা অনুষ্ঠান উপলক্ষে পানীয় জলের সঙ্কট নিরসনকল্পে এবং নিজের নামকে কালজয়ী রাখার মানসে কড়ির বিনিময়ে একটি দিঘি খনন করেন এবং দিঘির নাম কড়িয়া রাজার দিঘি নামকরণ করেন। তার ইচ্ছা পূরণার্থে তার মন্ত্রী সাহাকে এই দিঘি খনন করার নির্দেশ প্রদান করেন। মন্ত্রী সাহা নির্দেশ পেয়ে দিঘি খনন করান। দিঘি খনন কাজে অংশ নেয় বহু নর-নারী। যারা খনন কাজে অংশ নেয় তাদেরকে প্রতি খাঞ্চি মাটি কাটার বিনিময়ে এক খাঞ্চি করে কড়িমুদ্রা দেয়া হয়। দিঘি খনন শেষে মন্ত্রী সাহা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার নামে দিঘির নাম প্রচার করেন। দিঘি নামকরণে মন্ত্রীর চাতুরিপনার খবর পেয়ে কড়িয়া রাজা ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। মন্ত্রীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হলেও এই দিঘির নাম মন্ত্রীর নামে অর্থাৎ সাহার পাড়ের দিঘিই লোকমুখে থেকে যায়।

উজানী বখতিয়ার খাঁ মসজিদ :

কচুয়া উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে উজানী গ্রাম। বর্তমানে এ গ্রামে আছে একটি বিখ্যাত মাদ্রাসা। মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশে আছে একটি দিঘি। তার পশ্চিম পাড়ে আছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি সুদৃশ্য মসজিদ। এটি বক্তার খাঁ শাহী মসজিদ নামে খ্যাত। এক সময় উজানী গ্রামটি বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত ছিলো। ক্বারী ইব্রাহিম সাহেব বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত কামেল পুরুষ। তিনি এ মসজিদটিকে ব্যবহার্য করে তোলেন। মসজিদে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে আছে, ‘‘পরম দয়ালু আল্লাহ্তায়ালার নামে আরম্ভ করিতেছি। আল্লাহ্ এক, তাহার কোনো শরীক নাই। মোহাম্মদ তাহার রাসূল। বাদশাহ বাহাদুর শাহ্ গাজীর শাসনামলে খাদেম আবুল হোসেন খাঁর পুত্র ইলিয়াস খাঁর পৌত্র’’।উল্লেখ্য যে, এই উজানী গ্রামেই আছে হযরত নেয়ামত শাহের দরগাহ। যিনি হযরত শাহজালাল-এর একজন সঙ্গী ছিলেন। উজানী গ্রামে একজন বিখ্যাত ফৌজদার ছিলেন। তার নাম ছিলো বখতিয়ার খাঁ। তিনি মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণ সাল ১৭৭২। উজানী একটি প্রাচীন গ্রাম। এ গ্রামের নাম পাওয়া যায় মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যে ‘উজানী নগর’ হিসেবে। শোনা যায়, বেহুলা লখিন্দরের লোহার তৈরি বাসরঘর এ গ্রামে ছিলো। যা মাটির নিচে দেবে গেছে। বেহুলার শীল নোড়ার কথিত অংশবিশেষ এখনো এ গ্রামে রয়ে গেছে। লোকজন এখনো এগুলো দেখতে আসে।

মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস : বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণে সর্বস্তরের মানুষ যখন মুক্তির উন্মাদনায় আর স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত, কচুয়ার মুক্তি পাগল ছাত্র-জনতা তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগ্রাম বাস্তবায়নে প্রতিরোধের আগুনে হয় প্রজ্জ¦লিত। ১১ মার্চ স্বাধীন বাংলা কচুয়া থানা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধকালীন কচুয়া উপজেলা সম্মিলিত বাহিনীর অধিনায়ক সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান। ১৫ মার্চ কচুয়া থানা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কচুয়া ও বরুড়া নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচিত এমএনএ অ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুল আউয়াল। আঃ রশিদ প্রধান (রশিদ কন্ট্রাক্টর) উপজেলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোবারক সহ তড়িৎ গতিতে ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। তখন চলছে অসহযোগ আন্দোলন সহ বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন। মোঃ আনোয়ার হোসেন সিকদারের নেতৃত্বে ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে নামিয়ে পুড়িয়ে দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সর্ব প্রথম কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ, পরে অফিস-আদালত সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স¦াধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে মহান ২৬ মার্চ-এর প্রথম প্রহরে কচুয়া ডাকবাংলোয় অ্যাডভোকেট আব্দুল আউয়ালের সাথে সংগ্রাম পরিষদের শলা পরামর্শমূলক মিটিং চলাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে আসে বিশেষ দূত। আউয়াল সাহেব ও রশিদ প্রধান বঙ্গবন্ধুর আদেশ মেনে চলার পরামর্শ দিলেন। তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের (ব্যারিকেড) ব্যবস্থার নির্দেশে সালাউদ্দিন মানিক, তরিকুল ইসলাম, তাহের হাবিব, মজিব, শহিদ সহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে কচুয়া-কালিয়াপাড়া একমাত্র পাকা রাস্তায় ডাকবাংলোর পূর্ব পাশের্^ ব্রীজ ভাঙ্গাসহ (বর্তমানে ব্রীজটি নাই) লুন্তি গ্রাম পয়েন্টসহ উল্লেখিত পাকা রাস্তা কাটা ও বিভিন্ন ভাবে ব্যারিকেড তৈরি করে কচুয়ায় সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করা হয়। পরবর্তীতে উল্লেখিত রাস্তায় হোসেনপুর বাজারের উত্তর পাশের ব্রিজটি গুঁড়িয়ে দিলেন যুদ্ধকালীন বিএলএফ ডেপুটি কমান্ডার মোঃ জাবের মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট কমান্ডার (দপ্তর) ইয়াকুব আলী মাস্টার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক সালাউদ্দিন মানিক, প্লাটুন কমান্ডার হেদায়েত উল্লা, কচুয়া আঞ্চলিক কমান্ডার সৈয়দ আহম্মেদ সহ অনেকে। অগ্নিঝরা মার্চের ২৭ তারিখে কচুয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ পাইলট ফজলুল করিম ও দেওয়ান আঃ গফুর প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের মাধমে থানার রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে কচুয়া সাচার রহিমানগরসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে ডেপুটি কমান্ডার জাবের মিয়া মুক্তাঞ্চলে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন।

তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন ২০১৪)। 'এক নজরে কচুয়া'। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুন ২০১৫। এছাড়া বিভিন্নজনের নিকট থেকে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গৃহীত তথ্য।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়