প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:০৯
শ্রী মনোজ আচার্যী : সংস্কৃতি অঙ্গনে ঝরে যাওয়া এক নক্ষত্রের নাম
মনোজ আচার্যী, আমাদের প্রিয় মনোজদার অকাল মৃত্যুতে আমরা হারালাম একজন সুহৃদ বন্ধু, চাঁদপুরবাসী হারালো একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গণসংগীত শিল্পীকে।
দাদা ছিলো আমার বন্ধু, আমার গানের গুরু। ২০০০ কাল থেকেই তাঁর সাথে সখ্যতা বাড়ে। আমি তখন চাঁদপুর কন্ঠে নিয়মিত কবিতা, ছড়া, ফিচার লিখতাম কাজী শাহাদাত ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। দাদা আমার ছন্দময় কবিতা পড়ে আমাকে গান লিখতে উৎসাহিত করলেন এবং গান লিখা শিখালেন। সেই থেকেই দাদা আমার গানের গুরু। দাদার উৎসাহ-প্রেরণায় ও সহযোগিতায় আজ আমি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার হতে পেরেছি।
আমার গুরুকে উৎসর্গ করে আমার লিখা একটা গান বিবৃত করলাম--আমার গানের গুরু নাইরে ভবে
আমার কী হবে
মেঘ জমেছে হৃদয় মাঝে
বৃষ্টি দু চোখে।।গুরুর কথায় গান ধরেছি
কাজের অবসরে পথের মাঝে পথ হারালাম
নিরাশারই তরে
বয়ে চলি সেসব স্মৃতি
ব্যথিত এ বুকে।। ঐনতুন করে নতুন সুরে গান করি শুরু
গানের মাঝে খুঁজে পাই
প্রয়াত সেই গুরু ভবের খেলা সাঙ্গ করে
ঘুমিয়ে আছো সুখে।। ঐকথা ও সুর : বি এম ওমর ফারুক (গীতিকার)
মনোজ আচার্যীর জন্ম ১৯৬০ সালের ১৯ জানুয়ারি পুরাণ বাজার পশ্চিম জাফরাবাদ ঠাকুর বাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত আচার্যী পরিবারে। পিতার নাম স্বর্গীয় বিনোদ লাল আচার্যী, মাতা স্বর্গীয় মনোরমা দেবী। চার ভাই দু বোন। ভাইদের মধ্যে দাদা সবার ছোট।
ভাইগণ হচ্ছেন : নারায়ণ আচার্যী, সত্য রঞ্জন আচার্যী, স্বর্গীয় বাসুদেব আচার্যী ও স্বর্গীয় মনোজ আচার্যী। বোনগণ হচ্ছেন : আবু, আচার্যী, অলকা আচার্যী।
নিজ বাড়ি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় জীবনে নেমে আসে অমানিশা। নিতাইগঞ্জে রসিক চন্দ্রের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
মনোজ আচার্যীর শিক্ষাজীবন : পুরাণবাজার ২ নং সরকারি বালক বিদ্যালয়ে প্রথম হতে পঞ্চম শ্রেণি, মধুসূদন হরিসভা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী। এসএসসি পরীক্ষা দেন ১৯৭৭ সালে। ১৯ ৮৮ সালে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে দাদাকে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। টিউশনি করে আর্থিক সংকট মিটাতে হয়। পড়ার খরচ মেটাতেন একইভাবে।
১৯৭৪ সালে সংগীত নিকেতন থেকে গানের তালিম নেন। ১৯৮০ সালে বঙ্গজ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। মতবিরোধের কারণে ২০০৬ সালে স্বদেশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
মনোজ আচার্যী চাঁদপুরে গণসংগীত শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি কুমিল্লা বেতার কেন্দ্রের আধুনিক গানের তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দীর্ঘদিন অসংখ্য গান গেয়েছেন। তিনি 'দিন বদলের গান' নামে একটি অডিও ক্যাসেট বের করেন।
১৯৭১ সালে মনোজ আচার্যীর পরিবার স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন কলকাতা চলে যান এবং শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করেন। দেখ যখন স্বাধীন হয়, নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৮৩ সালে কৃষি ব্যাংকে যোগদান করেন। সেই সুবাদে বদলি হয়ে বান্দরবানের আলীকদম থানা, কক্সবাজারের টেকনাফ, কুমিল্লার দেবীদ্বার, হবিগঞ্জের নবীনগর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ এবং সর্বশেষ হাজীগঞ্জে কর্মরত থেকে চাকরি থেকে অবসর নেন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন।
মনোজ আচার্যী ডায়াবেটিক ও কিডনিজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর জীবন যুদ্ধে হেরে যান। অবশেষে বিদায়ী ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শনিবার সকাল দশটায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে রুদ্রনীল আচার্যী ও এক মেয়ে মধুরিমা আচার্যী, স্ত্রী মানসী আচার্যী সহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও সাংস্কৃতিক কর্মী রেখে যান।
মাদকের বিরুদ্ধে মনোজ আচার্যীর আন্দোলন ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সংস্কৃতি কর্মীদেরকে নেশাকে না বলতে আমি বহুদিন শুনেছি।সবশেষে মনোজ আচার্যীকে নিবেদন করে আমার একটি গান---
বলবো না গো আর কোনো দিন গান গেও তুমি মোর (২)
বলেছিলে গো গান লিখিতে
আজ কেন গো এমনো হলো?
এমনো হলো (২)গান গাওয়া যদি না হয় অপরাধ
তাই নিয়ে কেন সাজলে গো বাদ
সাজলে গো বাদ (২)