প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২১, ১০:৫০
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ দিন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া থেকে আমরা কতটা দূরে?
বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ৫০০দিন পূর্ণ হয়েছে। SARS-CoV-2 (কোভিড-১৯) মহামারীর কারণে সরকার ২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ সকল ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়, যা আজ অবধি পুনরায় চালু হয়নি। ইতিমধ্যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সমস্ত পাবলিক পরীক্ষা- পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি বাতিল করা হয়েছে।
|আরো খবর
এই মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষাখাত। আমাদের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বন্ধের এই সময়কালে শুধুমাত্র প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, বরং উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন এবং গবেষণা কার্যক্রমও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। একজন গবেষণার ছাত্র হিসেবে, অন্যান্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সাথে আমি নিজেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের সান্নিধ্যের অভাব অনুভব করছি।
আমি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডুকেশন-এর একজন এমফিল গবেষক। আমি আমার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার অনুভূতি এখানে উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিশেষ একটা দিন। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামের (অন ক্যাম্পাস) প্রথম ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অন ক্যাম্পাস ও আউটার ক্যাম্পাস- দুই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে ডিগ্রি প্রদান করে আসছিলো, কিন্তু গবেষণা পর্যায়ের ডিগ্রি পরিচালনা ছিল এটাই প্রথম।
আমার সৌভাগ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জ্ঞান সৃষ্টির গবেষকদের মধ্যে আমিও একজন। তবে আমাদের এই পথ ছিল সুদীর্ঘ। বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রথমবারের মতো ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট স্কুল অব এডুকেশন ও স্কুল অব বিজনেস-এর অধীন এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করে, তখন আমাদের অনেকেরই গবেষণা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না। তবে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর যেদিন বিশ্ব¦বিদ্যালয় আমাদের জন্য ‘How to Prepare a Research Proposal’ ওয়ার্কশপ আয়োজন করলো, সেদিন গবেষণা প্রস্তাব কি, সেটা সম্পর্কে আমাদের সবারই প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়েছিল। সেদিন থেকে প্রায় এক বছর দুইমাস পর নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ‘অফার লেটার’ দেওয়া শুরু হয়েছিল।
বাছাইকৃত ১৮জন এমফিল ও ৫ জন পিএইচডি গবেষক নিয়ে বিশ্ব¦বিদ্যালয়ের সেমিনার হলে প্রথম ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওরিয়েন্টেশনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. এম এ মান্নান বলেছিলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব প্রধানত তিনটি- জ্ঞান সংগ্রহ, জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি। এতদিন আমরা জ্ঞান সংগ্রহ ও জ্ঞান বিতরণ করেছি, আজ থেকে আমরা জ্ঞান সৃষ্টির পথে যাত্রা শুরু করলাম।”
ওরিয়েন্টেশনে আমাদের জানানো হলো, কোর্স ওয়ার্কে ৬০% উপস্থিতি না থাকলে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া যাবে না! এই কথা শুনে পিএইচডি গবেষকরা গম্ভীর হয়ে রইলেন, আর এমফিল গবেষকরা হা-হুতাশ করা শুরু করলেন। সবার যুক্তি, ‘আমরা প্রায় সবাই শিক্ষক, ৬০% উপস্থিতি নিশ্চিত করা আমাদের জন্য কঠিন।’ আমরা নানা ধরণের আবেদনপত্র লেখা শুরু করলাম, সাথে সাথে ক্লাস করাও শুরু করলাম। কোর্স ওয়ার্কে স্কুল অব এডুকেশনের দুুই সিনিয়র অধ্যাপক আমাদের ক্লাস নিতেন। ‘Research Methodology’ পড়াতেন অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার, এবং ‘Bangladesh Studies’ পড়াতেন অধ্যাপক ড. এ এস এম গোলাম মরতুজা।
মজার বিষয় হচ্ছে, ক্লাস করতে করতে আমরা আবেদনপত্র লেখার কথা ভুলে গেলাম। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যেদিন আমাদের কোর্স ওয়ার্কের ভাইভা অনুষ্ঠিত হলো, সেদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিভাবে যেন এক বছর চলে গেছে। সবারই উপস্থিতি ৬০%; কারো কারো তারও বেশি। শেষের দিকে এসে আমরা কেমন যেন একটা মায়ায় পরে গেলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে পারব কি’না, অ্যাসাইনমেন্টে কেমন নম্বর পাওয়া যাবে, থিসিস লেখা শেষ করতে পারবো কি’না, ইত্যাদি কিছুই আমাদের মাথায় ছিল না। আমাদের মধ্যে কি যেন একটা শূন্যতা ভর করেছিল। আমার মনে পরে সেদিন আমরা কেউই বিদায় নিতে চাচ্ছিলাম না।
আমাদের জানানো হয়েছিল, কোর্স ওয়ার্কের চূড়ান্ত ফলাফল শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। ইতিমধ্যে, আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রস্তাব উপস্থাপনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কোর্স ওয়ার্কের ফলাফল ২০২০ সালের ১২ জুন ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা থিসিস পার্টে নতুন যাত্রা শুরু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম; কিন্তু নিয়তি খুবই রহস্যময়! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদন করার পর ১৮০৪ দিন কেটে গেছে এবং কোর্স ওয়ার্কের ফলাফল ঘোষণার পর ৪১৩ দিন অতিবাহিত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে আমরা থিসিস অংশের আগে উপস্থাপনা সেশনের জন্য এখনও ডাক পাইনি!
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষার্থীদের মনের অবস্থা আমার মতোই। এমনিতেই, আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তক পড়তে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে; এবং এই সত্য জানতে আলাদা করে গবেষণা করতে হবে না। গুগল সার্চ করলেই এই সম্পর্কে অনেক প্রতিবেদন/আর্টিকেল পাওয়া যাবে। যদিও এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, কিন্তু সবাই একমত হবেন যে এগুলো তেমন কার্যকর হচ্ছে না। বরং আমাদের শিক্ষার্থীরা এই অনলাইন ক্লাসের কারণে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এবং ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
১২ জুলাই ২০২১ তারিখ উনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে উদ্বেক প্রকাশ করেন। এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, “কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে এবং লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা এখনও ব্যাহত হচ্ছে। আজ অবধি, ১৯টি দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, যা ১৫ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে; এটা চলতে পারে না। বন্ধের ক্ষেত্রে স্কুলগুলো সবার শেষে এবং পুনরায় খোলার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকা উচিত।”
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর মার্কিন তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক নোম চম্স্কি বলেছিলেন, “আমরা করোনভাইরাস সংকট কাটিয়ে উঠব, তবে আমাদের সামনে আরও মারাত্মক সংকট রয়েছে।” এখন আমরা যদি সেই সংকটগুলো মোকাবেলা করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রয়োজন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং একটি বিজ্ঞানমুখী তরুণ প্রজন্ম; ৫০০ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে তা সম্ভব নয়!
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জিম্বাবুয়ে সফর করে সিরিজ জয় করলো। আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রিকেট দল এবং ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানালাম কিন্তু আমরা কী ভেবেছি, ক্রিকেট খেলাসহ প্রায় সকল কার্যক্রম খোলা আছে, কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ! আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর দিকে না তাকিয়ে একটা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকয়ে তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে ফেলছে! আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, আমাদের শিক্ষার্থীরা এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার (অনলাইন ক্লাস) বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে কি অর্জন করছে?
এই পরিস্থিতিতে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করতে হবে। বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হবে; আমাদের এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। কোভিড-১৯ মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অতীতে বহু প্রতিকূলতা কাটিয়ে মানুষ সামনে এগিয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি করোনভাইরাসকে পরাস্ত করতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা এবং জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষা এবং জ্ঞান সৃষ্টি করা যাবে না।
আশার কথা, সরকার আঠারো বছরের বেশি বয়সি যে কোন নাগরিককে টিকা দিতে শুরু করতে যাচ্ছে। আগামী ৭ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কোনো নাগরিক যদি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে কেন্দ্রে যান তাহলে তাকে টিকা দেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে, এটি সরকারের একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবার জন্য সরকারের কাছে দৃশ্যমান পরিকল্পনা প্রত্যাশা করছি।
নজরুল ইসলাম: গবেষণা সমন্বয়কারী, আইপিডিই ফাউন্ডেশন, লেখক ও এমফিল গবেষক (শিক্ষা), স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল : [email protected] Mobile: 01711 985 843, 01511 985 843 WhatsApp: 01611 985 843, Writing page: https://www.facebook.com/WriterNazrulIslam/