শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ক্রীড়াঙ্গনে নারী : বৈষম্য যার মুকুটশোভা

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ক্রীড়াঙ্গনে নারী : বৈষম্য যার মুকুটশোভা

দেশকে এগিয়ে নেওয়ার গল্প যদি কারও করতেই হয়, তবে তা এদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের নিয়ে করাই ভালো। তাদের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের জন্যে সব বড় বড় সাফল্য। অথচ একদিকে ধর্মান্ধতা আর অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে আমাদের প্রতিভাবান নারীরা এগিয়ে যেতে পারছে না কাঙ্ক্ষিত গতিতে। এরই সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য। অপুষ্টিতে ভুগে, একবেলা খেয়ে না খেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে লড়াই করার মত শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য তাদের তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। তারা জানেই না আসছে বেলা খাবার তাদের কপালে আছে কি না। তাদের কারো কারো ভিটা থাকলেও ঘর নাই, ঘর থাকলেও বেড়া না থাকার মতো দুরবস্থাগ্রস্ত। এমনকি কাউকে কাউকে বাবার সাথে মাঠে বদলাও দিতে হয়। অথচ ফুটবল বা ক্রীড়ার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি নির্ভর বহিরাঙ্গনীয় ক্রীড়ায় ভালো করতে হলে দরকার নিরন্তর চর্চা বা অনুশীলন। দৈনিক নিয়মিত ডিমণ্ডকলার পাশাপাশি রোগে-শোকে যে চিকিৎসা দরকার আমাদের সোনার মেয়েদের, সেই চিকিৎসার সামর্থ্যটুকুও নেই। তারপরও তারা মনোবল এবং পরিবারের অদম্য ইচ্ছায় জড়িয়ে গেছে প্রমীলা ক্রীড়ার সাথে এবং এখনও জড়িয়ে আছে। ক্রীড়াকে ভালোবেসে জীবন জড়ানোর কারণে তাদের সহ্য করতে হয়েছে গ্রামবাসী ও এলাকাবাসীর তির্যক মন্তব্য এবং সহ্য করতে হয়েছে সর্ব রকমের অসহযোগিতা। কোনো কোনো স্থানে তাদের হাফপ্যান্ট পরে ফুটবলই খেলতে দেয়া হয়নি। নারীর দেহে তারা কেবল খোঁজে যৌনতা আর ধর্মীয় বিধি-নিষেধ। নারীকে মা আর পত্নী হিসেবে দেখে অন্দরমহলে আটকে রাখাতেই তাদের সুখ। সুকুমারবৃত্তির ক্রীড়া নয়, নারী কেবল তাদের কাছে যৌন ক্রীড়ারই বাহন। যেখানে একটা ফুটবল কিনে দিয়ে কিংবা নিরাপদ মাঠের ব্যবস্থা করে সহযোগিতা করার কথা, সেখানে নারীর পায়ে বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে ক্রীড়ায় তাক লাগানো দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তুখোড় প্রতিভাবান না হলে অসম্ভব। বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা সেটাই প্রমাণ করেছে বারে বারে।

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে কোনোরকম বিদ্যুতের সংযোগহীন, ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন গারো পাহাড়ের পাদদেশ হতেও কীভাবে প্রতিভার জোরে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা যায়। কলসিন্দুরের এই মেয়েদের দেখাদেখি এগিয়ে এসেছে অন্য মেয়েরাও। এ পর্যন্ত ফুটবলে সেরা সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে আমাদের এই নারী ফুটবলাররাই। দুহাজার বাইশের সেপ্টেম্বরে তারা হিমালয়কন্যা নেপালের নারী ফুটবল দলকে তিন-এক গোলের ব্যবধানে হারিয়ে দেশকে ফুটবলে এনে দেয় দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব। অথচ তাদের সংবর্ধনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল কর্মকর্তাদের সে কী গড়িমসি। বিমান বন্দর হতে ছাদখোলা বাসে তাদের নগর প্রদক্ষিণ করাতেও বেগ পেতে হয়েছে শুধু উপেক্ষার কারণে। সংবর্ধনা দিতে গিয়ে বাফুফে কর্মকর্তারা নিজেরাই সংবর্ধনা নিয়ে বসেছিলেন। কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনকে দূরে ঠেলে বাফুফে কর্মকর্তারা নিজেরাই ফটোসেশন থেকে শুরু করে পুষ্পমাল্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন। তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা ছিল না যে, তারা এই মেয়ে ফুটবলারদের জন্যে সময়মত কিছু করেন নি এবং করতে এগিয়েও আসেন নি। অবজ্ঞা আর অবহেলার কারণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এই নারী ফুটবলাররা একে একে ঝরে পড়ছে খেলোয়াড়ি জীবন থেকে। যেখানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নারী ফুটবলার তৈরির জন্যে বিনিয়োগ করছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, সেখানে প্রকৃতির উদারতায় পাওয়া এসব সম্পদ আমরা হেলায় তুচ্ছ করছি নিজেদের অযোগ্যতার কারণে। মাত্র বিশ লাখ টাকা বিমান ভাড়াসহ লাখ পঞ্চাশেক টাকার সংস্থান করে দিতে না পারায় আমাদের সাফ গেমসে স্বর্ণজয়ী নারী ফুটবলাররা মিয়ানমারে যেতে পারেনি প্যারিস অলিম্পিকের বাছাই পর্বে অংশগ্রহণ করে বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের আগমনী জানান দিতে।

নারী ক্রিকেটাররা নারী ফুটবলার থেকে তুলনামূলক অধিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও তাদের ক্ষেত্রে বেতন বৈষম্য প্রকট। পুরুষ ক্রিকেটাররা যে বেতন পান তার চেয়ে অনেক কম বেতনে খেলে নারী ক্রিকেটাররা দেশের জন্যে খেলে সুনাম বয়ে আনছেন। বাংলাদেশের নাহিদা এবং ফারজানা এই দুজন নারী ক্রিকেটার আইসিসি প্লেয়ার অব দ্য মান্থে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে আমাদের জন্যে বয়ে এনেছেন গৌরবের অনন্য উৎস। এশিয়া কাপ ঘরে এনে দেয়ার পরও নারী ক্রিকেটারদের এমন অবহেলা আমাদের জন্যে অগৌরবের। পুরুষ খেলোয়াড়েরা খুব সহজেই বিদেশের লীগে খেলার অনুমতি পেলেও নারী ক্রিকেটাররা ভালো আহ্বান সত্ত্বেও অনাপত্তি না মেলার কারণে যেতে পারেননি মনের মতো বিদেশী লীগে। আমাদের নারীরা আম্পায়ার এবং রেফারি হিসেবেও বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করে দেশকে গর্বিত করেছেন। অথচ তাদের নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

কুষ্টিয়ার সাঁতারু গড়ার সূতিকাগার হলো আমলা গ্রাম। এই গ্রামের গর্ব ‘জলকন্যা’ খ্যাত সবুরা খাতুন একসময় সুইমিং পুলে ঝড় তুলে দেশকে গর্বিত করেছিলেন। নারী ভারোত্তলনকারী মাবিয়া আক্তার সীমান্ত আমাদের জন্যে নিয়ে এসেছেন সাফ গেমসের স্বর্ণ। কমনওয়েলথ ভারোত্তলন চ্যাম্পিয়ানশিপেও তিনি স্বর্ণপদক জয় করে দেশকে গর্বিত করেছিলেন। আর্চারিতেও নারীদের অর্জন উল্লেখযোগ্য। বাইশতম এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ দুহাজার একুশের আসরে রিকার্ভ নারী দলগত ইভেন্টে অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন দিয়া সিদ্দিকী, নাসরিন আখতার ও বিউটি রায়, যা এশিয়ান পর্যায়েও বাংলাদেশের প্রথম পদক। শুটিংয়ে সাবরিনা দেশকে দিয়েছেন গৌরবের ভাগ।

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় শুটিং বিশ্বকাপে মেয়েদের দশ মিটার এয়ার রাইফেলে ষষ্ঠ হয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মেয়ে কামরুন নাহার কলি। আর এতেই প্রথম বাংলাদেশী শুটার হিসেবে বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করেন তিনি। কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে শুটিংয়ে প্রথম স্বর্ণ জয় করেন সাবরিনা। প্যারা অলিম্পিকে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য অনেক।

বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদ নারীদের এতো এতো অর্জন সত্ত্বেও আজও তারা বৈষম্যের শিকার হয়ে চলেছে ক্রীড়াঙ্গনে। অথচ তাদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিলে এবং তাদের যোগ্য পরিচর্যা করা হলে আমরা হয়তোবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে আরও গৌরবের অধিকারী হতে পারতাম। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে নারীর প্রতি বৈষম্য রোধে যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে তা যদি সঠিক বাস্তবায়িত হয়, তবে নারীরা আরো এগিয়ে যেতে পারবে। আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে নারী ক্রীড়াবিদদের স্মার্ট করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামকে কলসুন্দর কিংবা আমলারূপে গড়ে তুলতে হবে। তবেই ক্রীড়ায় আমাদের স্বর্ণফসলের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়