প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০
ক’দিন বাদেই টেস্ট পরীক্ষা। সারা বছর ফাঁকি দিয়েছি। তাই ভালোভাবে পড়া হয়নি। সুতরাং এখন একটু ভালোভাবে পড়তেই হবে। তা না হলে যে চলবে না। তাই ক’দিন ধরে রাত জেগে পড়া চালাচ্ছি পড়া কভার করার জন্যে। আজও চলেছে আমার রাত জেগে পড়া। ঘুম এসে বারবার হানা দিচ্ছে। ফলে কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘুমালেতো আমার চলবে না। যে করেই হোক পড়া আমার মুখস্থ করতেই হবে। চলছে বইয়ের সাথে অঘোষিত যুদ্ধ।
ঘুমের ঘোরে কী পড়ছি মাথামু-ু কিছুই মনে নেই। একসময় ঘুমের কাছে আমাকে পরাজয় মানতেই হলো।
কখন তন্দ্রা আমাকে আচ্ছন্ন করেছে জানি না।
এক পশলা শীতল বাতাস আমার ঘুম কেড়ে নিলো। জুন মাসের এই রাতে সমস্ত শরীরের রোমরাজি আমার খাড়া হয়ে গেল শীতল পরশে।
প্রচ- গরম পড়েছিলো তাই জানালা খুলে রেখেছিলাম। জুনের আবহাওয়া তাই হঠাৎ পরিবর্তন হতেই পারে। মেঘলা আকাশ হলে ঝড়ো হাওয়া বইবে এটাই স্বাভবিক। তাহলে কি ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে?
টেবিল ঘড়িতে দেখলাম ২টা বেজে ২১ মিনিট।
চেয়ার ছেড়ে এসে জানালার ধারে দাঁড়ালাম। কোনো ঝড়-বৃষ্টির লক্ষণ নেই। চারিদিক চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। শতকোটি তারার মাঝে চাঁদ যেন সভায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে। আকাশে কোথাও একচিলতে মেঘ নেই। হঠাৎ এ-রকম ঠা-া বাতাস বয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না।
চাঁদের আলোয় প্রকৃতি যেন অপরূপ সাজে সজ্জিত। একটু দূরে নারিকেলের পাতায় চাঁদের আলো পড়ে মনে হচ্ছে মুক্তা ঝিকমিক করছে।
ক্রমাগত ঝিঁঝি পোকা ডাকছে বাইরে। কিন্তু একটা ডাক অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে কার হাত ঘড়িতে ক্রমাগত অ্যালার্ম দিচ্ছে। শব্দটা বেশি দূরে নয়, জানালার বাইরে থেকেই হয়তো আসছে।
অথচ এই অসময় অ্যালার্ম দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
আবার তাকালাম টেবিল ঘড়িটার দিকে। মাত্র দু’মিনিট পেরিয়েছে। অর্থাৎ ২টা বেজে ২৩ মিনিট।
এই অসময়ে বাইরে কে ঘড়ি রাখলো? নাকি কেউ ঘড়ি ফেলে গেছে বাইরে? তাতো হওয়ার কথা নয়। আমার জানালার এপাশে কেউ আসে না। হয়তো চোর এসেছে ঘড়ি পরে। আর তার ঘড়িটা হয় ‘স্লো’ না হয় ‘ফাস্ট’। এ কথা ভাবতেই মনে কেমন জানি একটা ভয়ভয় ভাব এসে গেল।
কেননা রাতের বেলায় চোর-ডাকাতকে মানুষ বলে মনে হয় না আমার কাছে। মনে হয় অন্য কোনো হিং¯্র প্রাণী এবং সেটা খুবই ভয়ঙ্কর।
যাই হোক, ঘুম চলে যাওয়ায় জানালাটা শব্দ করে বন্ধ করে মনে মনে বললাম, ‘চোর থাকলে বাইরে থাকুক। আমি ঘরে বসে আমার পড়া তৈরি করি।’ তাই আবারও পড়তে বসলাম।
কিন্তু সেই অ্যালার্মের শব্দ হয়েই চলেছে। এবার আমার মন থেকে চোরের ভয় কিছুটা দূর হয়ে গেলো। তাছাড়া জানালা বন্ধ করতে গিয়ে যে শব্দ হয়েছে, তাতে চোরতো দূরে থাক ডাকাত হলেও দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। পালিয়ে যাবার কথা।
তাই পড়া বন্ধ করলাম। অজানাকে জানার আকর্ষণে দরজা খুলে আমার মন আমাকে বাইরে নিয়ে এলো।
চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝকমক করছে। শীতল বাতাস আবারও বইতে লাগলো। শীত শীত করতে লাগলো আমার।
শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম এক মিনিট ধরে। পেয়েও গেলাম অবশেষে। জানালার সামনে ফাঁকা জায়গায় একটা ছোট্ট মাকড়সা থেকে আসছে শব্দটা। চাঁদের আলোয় মোটামুটিভাবে ওটা দেখতে পেলাম। শব্দের সাথে সাথে ওটার পিঠে চিকন একটা শুঁড় মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে।
মাকড়সা ঘৃণিত প্রাণীদের একটি। তা ছাড়া অসময়ে ঘুম ভাঙানোর জন্য পা দিয়ে চাপ দিলাম মৃদুভাবে। অমনি মাকড়সা কথা বলে উঠলো, ‘আমাকে মেরো না।’
চমকে উঠে পা সরিয়ে নিলাম আমি। ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেলাম। তাকালাম চারপাশে। না কোথাও কেউ নেই? সমস্ত শরীর আমার ভার হয়ে এলো। ভয় ভয় ভাবটা বেড়ে গেলো কয়েকগুণ।
মাকড়সা আবারও কথা বলে উঠলো, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচাও।’
আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাকড়সা বলে কী? ও ভূত না পেতœী।
মাকড়সা আবারও করুণ সুরে বলতে লাগলো, ‘তোমার প্রভুর দোহায় লাগে আমাকে বাঁচাও।’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি আ...আ...মি কী করবো?’
‘দয়া করে আগে আমাকে তোমার রুমে নিয়ে চলো।’ বলল মাকড়সা।
‘হ্যাঁ ঘরে নিই আর তুমি আমাকে গলা টিপে মারো।’ সাহস সঞ্চয় করে বললাম।
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসলো মাকড়সা থেকে।
‘আমি তোমাকে বুদ্ধিমান ও সাহসী ভেবে তবেই এসেছি। তাহলে কি আমার ধারণা মিথ্যাই প্রতিপন্ন হবে।’ বলল হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে মাকড়সা।
ওর এই কথায় আমার ভেতর প্রতিক্রিয়া হলো। জেগে উঠলো আমার ভেতরের সাহসী সত্তা।
ঘৃণাভরে বাম হাত দিয়ে তুলে নিলাম ওটা।
মাকড়সা থেকে ভিন্ন কিছু নয়, তবে শব্দটা বাজে। রুমে গিয়ে ওটা রাখলাম টেবিলের ওপর।
ও কথা বলে উঠলো, ‘হে পৃথিবীবাসী, আমি একটা প্রাণী। মাকড়সাটা আমার যানবাহন। দাঁড়াও আমি বের হচ্ছি এর ভেতর থেকে।’
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর মাকড়সা যান এর পাশ থেকে কথা বলে উঠলো ও, ‘আমাকে দেখতে পাচ্ছো?’
আমি বললাম, ‘না।’
‘আসলে দেখার কথা নয়। তোমরা খালি চোখে আমাকে দেখতে পাবে না।’
ঠিক তখন মাকড়সা যান থেকে অদ্ভুত ভাষায় কে যেন কথা বলে উঠলো। সাথে সাথে পাশ থেকে সেই কণ্ঠ বলল, ‘হে মানুষ আমার ফিরে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। দয়া করে আমাকে একটু জ্বালানি দাও।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু আমার কাছেতো কোনো জ্বালানি নেই।’
‘আছে... আছে।’ দৃঢ় প্রত্যয়ে বলল ও।
‘আমি কোথায় পাবো?’ আমি একটু রেগে বললাম।
‘তোমার দেহেই আছে।’
‘আমার দেহে আছে! তার মানে কী?’ আমার মধ্যে ভয়ের বিষয়গুলো আবারও হাজির হতে থাকলো।
‘তোমার রক্ত।’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘তার মানে তুমি রক্ত চোষা ড্রাকুলা?’
‘এখনও তোমরা ভূত-পেতœী, রাক্ষস-খোক্ষস, ড্রাকুলা এইসব বিশ্বাস করো?’
‘কি... ই...ন...তু।’ ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার আগে আমার কথা কেড়ে নিয়ে ও বলল, ‘বেশি না। মাত্র এক ফোঁটা।’
আবারও মাকড়সা যান থেকে সেই অদ্ভুত ভাষায় কে কী যেন বলল। ভাষাটা একদম অপরিচিত আমার কাছে।
সাথে সাথে সেই কণ্ঠ বলল, ‘আমার সময় খুব কম। আমাকে দয়া করো।’ মিনতি ঝরে পড়লো ওর কণ্ঠে। ‘দয়া করে একফোঁটা রক্ত দাও আমাকে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম, ‘আমি নিজের শরীর কেটে রক্ত বের করতে পারবো না।’
‘আচ্ছা আমি নিজে নিয়ে নিচ্ছি।’ যেন স্বস্তি পেল কণ্ঠটা।
‘না...না, আমার শরীর কাটতে দেবো না।’ পিছিয়ে গেলাম দুই কদম আমি।
‘তোমার কোনো ব্যথা লাগবে না। দয়া করো বন্ধু।’ মিনতি ওর কণ্ঠে।
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয় জড়ানো কণ্ঠে বললাম, ‘ঠিক আছে। নাও।’
চোখ দু’টি বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করলাম।
হঠাৎ আমি আমার ডান বাহুতে চিন চিন ভাব অনুভব করলাম। পরক্ষণে মাকড়সা যান থেকে সেই কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘তোমাকে ধন্যবাদ। রক্ত থেকে আমি জ্বালানি তৈরি করে নিতে পারবো। এবার দয়া করে তুমি তোমার ঘরের জানালাটা খুলে দাও, আমি চলে যাবো।’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর অনুরোধ পালন করলাম। জানালা খুলে দিলাম।
মাকড়সা যানটা শূন্যে উঠে শাঁ করে জানালা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি ধপাস করে চেয়ারে বসে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
সকাল ছ’টায় আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার।
চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মনে পড়লো রাতের ঘটনা। তাকিয়ে দেখি জানালা তখনও খোলা।
আমি জানি না ওটা স্বপ্ন, নাকি সত্যি। তবে ডান বাহুতে এখনও একটা চিন চিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।