প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আব্বু আমার পথ চলার প্রেরণা
ডাঃ দীপু মনি
ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ। আমার বাবা। আব্বু। আমার প্রতিদিনের পথচলার প্রেরণা। আমার ভাবনা চিন্তা, ধ্যান-ধারণার গতি প্রকৃতি গড়ে দিয়েছেন তিনি সেই শৈশব আর কৈশোরে। চেয়েছেন বাঙালির শুদ্ধ জীবনবোধ আর চিরন্তন মূল্যবোধকে আমার চিন্তায়, জীবনবোধে প্রোথিত করে দিতে। চেয়েছেন ‘দেশসেবা আর জনসেবার মহান ব্রতই রাজনীতি’, ‘রাজনীতিকের জীবন ত্যাগের ও সেবার, ভোগের নয়’-এই দীক্ষায় দীক্ষিত করতে। ভালবাসতে শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন ভালোবাসা গ্রহণ করতে। সাহস, ধৈর্য, আদর্শের প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। কতটুকু গ্রহণ করতে, শিখতে, আত্মস্থ করতে পেরেছি জানি না। তবে ‘নয়ন সমুখে’ তিনি না থাকলেও মন আর চিন্তার মধ্যে তাঁর ‘নিত্য আসা যাওয়া’র মধ্য দিয়ে আমাকে পথ দেখান তিনি ধ্রুবতারার মত নিত্যদিন।
|আরো খবর
আব্বুকে যারা চিনতেন চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে, তাঁরা অনেকেই বলেছেন তাঁর ডায়েরি লেখার কথা। আমরাও শুনেছি। তাঁর নিয়মিত লেখা ডায়েরিগুলো রাখা ছিল ইত্তেফাক অফিসে তাঁর কক্ষে। ১৯৭১-এ যখন ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানী বাহিনী তখন সেসব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তিনি আর লেখেননি। আমি অনেকবার অনুরোধ করেছি, প্রশ্ন করেছি ‘আব্বু ডায়েরি না হোক, সেসময়ের কথা কেন লিখবে না?’ উত্তর দিয়েছেন ‘মামণি, ইতিহাস তো অনেক বদলে গেছে। এখন লিখলে শুধু শুধুই বিতর্ক তৈরি হবে।’ কোনোদিন কোনো কাজের স্বীকৃতি চাননি। কাজ করতে পেরেই সন্তুষ্ট থেকেছেন। তৃপ্ত থেকেছেন।
আব্বুর পরমত সহিষ্ণুতা ছিল অসাধারণ। বিপরীত মতের মানুষের কথাও ধৈর্য সহকারে শুনতে পারতেন। উত্তেজনা এড়িয়ে যুক্তি দিয়ে নিজের মত তুলে ধরতে পারতেন। তাঁর এ গুণের কারণেই হয়তো দলের হয়ে অন্যান্য সমমনা দলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, আন্দোলনে অন্যদের শরীক করার দায়িত্ব তাঁর ওপর দেয়া হত। সে কারণে আবার তাঁর ভুগতেও হয়েছে অনেক সময়। একবার কমিউনিস্ট সন্দেহে তাকে দীর্ঘসময় কারাগারে ‘কনডেমড্ সেল’-এ রাখা হয়েছিল।
আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে তখন আন্দোলন চলছে। ভুখা মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে অনেকেই হতাহত হন। পুলিশ মৃতদেহ গুম করে ফেলার চেষ্টা চালায়। শুনেছি আব্বু একজনের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে সরিয়ে নেন এবং নির্মাণাধীন একটি বড় ভবনের নিচে সারারাত সেই লাশ নিয়ে অবস্থান করেন। পরদিন সকালে সেই লাশ নিয়ে প্রতিবাদী মিছিল বের করে জনতা। আবু হোসেন সরকারের পতন ঘটে। দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত ঝুঁকি নেয়া অসীম সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। শুনেছি ১৯৪৮-এর ১১ই মার্চ ধর্মঘট চলার সময় সচিবালয়ের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় শুয়ে পড়ে গাড়ি সচিবালয়ে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ভারী ট্রাক এসে তাদের সরাতে ভয় দেখিয়েছে। পাঁজরে চাপ দিয়েছে ভারী ট্রাকের চাকা দিয়ে। সরাতে পারেনি। শুনেছি পুলিশের লাঠির আঘাত হাত দিয়ে প্রতিহত করতে গিয়ে হাত ভেঙ্গেছে। পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফেটেছে। কোনো অত্যাচার নির্যাতনই তাঁকে তাঁর কর্তব্য থেকে টলাতে পারেনি কখনো। ভয় করেননি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কাউকে।
গোয়েন্দারা লেগে থাকতো পেছনে সবসময়। শুনেছি সারাদিন আব্বু সাইকেল চেপে শহর চষে বেড়াচ্ছেন। পেছনে পেছনে গোয়েন্দাও। রাতে বাসায় ফিরলেন। খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলেন। বাতি নিভেছে, ঘুমিয়েছেন নিশ্চিন্ত হয়ে, গোয়েন্দা বাড়ি গেলো। সকালে হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখলো আব্বু দাঁত মাজছেন। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন যেন। অবাক কা-! তাহলে রাতে সব পোস্টার লাগানো আর লিফলেট বিলির কাজ করলো কে?
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একান্ত আস্থাভাজন ও স্নেহভাজন ছিলেন আব্বু। তিনি ঢাকা এলেই যে ক’টি মুখকে সবসময় দেখতে পেতেন, যাঁদের উপর কোনো দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তার অন্যতম ছিলেন ‘ওয়াদুদ’। একবার ঢাকায় এলেন। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দরে নেমে আশপাশে কোথাও ওয়াদুদকে দেখতে না পেয়ে জানতে চাইলেন ওয়াদুদ কোথায়? শুনলেন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে গেলেন হাসপাতালে আব্বুকে দেখতে। প্রধানমন্ত্রী হয়েও একনিষ্ঠ কর্মীকে ভোলেননি। এই রাজনীতি আওয়ামী লীগের।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। তখন আম্মু-আব্বুর সদ্য বিয়ে হয়েছে। আম্মুর বানানো দুধকদু খেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন। সে কথা নাকি পরেও বলেছেন। আর তাঁদের বিয়ে পরবর্তী সংবর্ধনায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু (তখন শেখ মুজিবুর রহমান), তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সহ আরও বহু বিশিষ্ট জন উপস্থিত ছিলেন। সে অনুষ্ঠানের একটি ঝাপসা হয়ে যাওয়া দুর্লভ ছবি আমাদের সংগ্রহে আছে এখনো।
শুনেছি ইত্তেফাক যখন তৈরি হয় তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব তরুণ কয়েকজন নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ইত্তেফাক চালাতে পারবে কি না? আব্বু নাকি টেবিল চাপড়ে জবাব দিয়েছিলেন অবশ্যই পারবেন। আব্বুসহ ছয়জনের ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বাকি পাঁচজন (নুরুল ইসলাম ভান্ডারী, এম আর আখতার মুকুল, ফয়েজ আহমেদ, আব্দুল কাদের এবং আর একজনের নাম মনে করতে পারছি না)। বিভিন্ন পর্যায়ে ইত্তেফাক ছেড়ে চলে গেলেও আব্বু কখনো ইত্তেফাককে ছেড়ে যাননি। স্বাধীনতার পর ইত্তেফাক প্রকাশনার স্বার্থেই এবং পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলে হক, তোহা, মতিন সাহেবদের সংগঠিত শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমনে দুটি শিল্প কারখানায় প্রশাসক হিসেবে আব্বুকে নিয়োগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে আব্বু বলেছিলেন ‘জীবনে কোনোদিন চাকরি করলাম না। এখন আমাকে চাকরি করতে বলছেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এটা চাকরি না। এটাওতো তোর দলের কাজ। ওখানে শ্রমিক অসন্তোষ তুই ছাড়া আর কেউ সামলাতে পারবে না। আর তুই এই দায়িত্ব নিলে ওখান থেকে ইত্তেফাক ছাপা হতে পারবে’। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অন্য দায়িত্ব পালন করতে হলেও ইত্তেফাককে কখনো ছাড়েন নি। একটু সময়ের জন্য হলেও ইত্তেফাকে যেতে কোনোদিন ভুলতেন না। আমার মনে আছে (২৬ মার্চ, ১৯৭১) কলাবাগানের বাসার বারান্দা থেকে দক্ষিণ দিকের আকাশে কালো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে গভীর বেদনায় আব্বু বলেছিলেন ‘আমার ইত্তেফাক ওরা পুড়িয়ে দিল’। তারপরই খবর এসেছিল সত্যিই ইত্তেফাক পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। জন্মদাত্রী মা যেমন সন্তানের যে কোনো বিপদ বুঝতে পারেন, আব্বুও ইত্তেফাকের বিপদকে জেনে গেছেন তাঁর গভীর মমতায়।
আব্বুর এমনিতেই খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস চিরদিনের। নামাজ পড়ে কোরান তেলাওয়াত করা, তারপর রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা রেডিও স্টেশনের সংবাদ একের পর এক শোনা। তারপর গাছপালা, হাঁস-মুরগীর খোঁজ খবর নিয়ে, খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিয়ে, বিছানা তুলতে সাহায্য করে, আমাদের তৈরি হতে তাগাদা দিয়ে নিজে তৈরি হয়ে নেয়া। আমরা কি নাশতা খাবো আর স্কুলে কলেজে কী টিফিন নিয়ে যাবো তার ব্যবস্থা করে বেরুবার আগে আম্মুকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হতে। আম্মুর ঘুমের সমস্যা দীর্ঘদিনের। তাই সকালে তাঁর ঘুমে যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্যে বাড়ির আর সবার সব কাজ নিঃশব্দে করার চেষ্টা। বাড়িতে সকালের রুটিনটা আমরা বড় হবার সময় এমনই দেখে অভ্যস্ত।
এমনই এক সকাল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এর কথা মনে পড়ে। ভোর থেকেই গোলাগুলির শব্দ। কলাবাগানের বাসা থেকে সবই শোনা গেছে। রেডিওতে মেজর ডালিমের অবিশ্বাস্য ঘোষণা ততক্ষণে হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, যাকে আমরা খালু ডাকতাম, তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন ‘ভাইসাব শুনছেন? বঙ্গবন্ধুকে মাইরা ফেলছে।’ আব্বুকে দেখলাম বাইরে থেকে একেবারে চুপ, চোয়াল শক্ত। রোজকার মত যতœ আর অভ্যস্ততায় মশারী নিখুঁতভাবে ভাঁজ করছেন। খুব শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন ‘অস্থির হবেন না।’ সেদিন সময়মতোই অফিস যেতে তৈরি হলেন। ড্রাইভার এসে বললো, পাড়ার কোনো রাস্তায় কিছু বখাটে ছেলে কটু মন্তব্য করেছে। শুনে তখনই গেলেন সেখানে। বাসায় সবাই উদ্বিগ্ন। একটু বাদেই এলেন। কেউ ছিল না রাস্তায় তিনি যখন গেছেন।
বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে আমাদের পথচলা থামানো যাবে না, হার মানা যাবে না, সাহস হারালে চলবে না, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে সাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে-এটাই ছিলো আব্বুর বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে কেউ এসে ভয় দেখাবে, শাসাবে-তা সহ্য করবার মানুষ তিনি নন। বঙ্গবন্ধু, তাঁর ‘মুজিব ভাই’ নেই। নিহত হয়েছেন সপরিবারে নৃশংসভাবে। তার মানে এই নয় যে, সে আদর্শের এখানেই শেষ। বরং লড়াইটা আরো কঠিন হলো বলে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া আরো জরুরি। যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সবসময়। বলতেন গভীর বিশ্বাস আর অঙ্গীকার নিয়ে। বাধা বিপত্তি যত বড়ই হোক, চাপ যত বেশিই হোক আদর্শের প্রশ্নে মাথা কখনোই নত করবেন না।
সে সময় আব্বুকে বারবার শুভাকাক্সক্ষীরা সাবধান করেছেন। সামরিক সরকারের হয়ে তাঁর পূর্ব পরিচিত দুজন রাজনীতিক বারবার বাসায় এসেছেন। সামরিক সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের, জিয়ার নানান নামের দলে অংশ নিতে বলেছেন। আব্বু ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর শুরু হয়েছে অন্যরকম চাপ প্রয়োগ। জেলে ঢোকাবার ভয় দেখানো। আব্বু বলেছেন ‘কাকে দেখাও জেলের ভয়? যা খুশি পারে করুক। আমার পথ থেকে আমি সরবো না।’ এরপর প্রথমে গ্রেফতার, তারপর নানা রকম মামলা দায়ের। দুর্নীতির অপবাদ। জেলে গেছেন। তোয়াক্কা করেননি। আস্থা রেখেছেন আম্মু আমাদের সংসার চালিয়ে নেবেন কোনো রকমে।
জেলখানায় আব্বুকে দেখতে যেতাম। হাসিমুখে তখনো আদর করে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলতেন। কখনো যেন মন ভেঙ্গে না যায় আমাদের, তার চেষ্টা করতেন। সেসময় জেলে দেখা করবার জায়গায় গেলে প্রায়ই কিছু লোককে দেখতাম ডান্ডাবেড়ী লাগানো উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা। ভয় লাগতো। গা ছমছম করতো। আব্বু বলেছিলেন এদের ফাঁসি হবে। তখন নাকি প্রায় রোজ রাতেই ফাঁসি দেয়া হত। মানুষের কান্না শোনা যেত ভোরের ঠিক আগে সুবহে সাদেকের সময়। তখন ১৯৭৮-৭৯ সাল।
আব্বু বিভিন্ন মেয়াদে তিনবার কারাভোগ করলেন। ক্রমশই অসুস্থ হতে থাকলেন, যদিও মনোবল ছিল অটুট। মামলা চালাতে গিয়ে আম্মুর সে কি কষ্ট সে সময়। কোর্টে তাঁর অসম্পূর্ণ অর্ধনিমিত বাড়ির সরকারি ঋণ পাবার আগের কাজ হলো যে টাকায় তার উৎসের কথা বলতে দাাঁড়িয়ে আম্মু তাঁর দীর্ঘ ২৮-২৯ বছরের শিক্ষকতার সকল রোজগারের বিবরণ দিলেন। বিচারক আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনি কি কোনোদিন ¯েœা পাউডারও কেনেননি আপনার নিজের রোজগারের টাকায়?’ আম্মু বলেছিলেন, না, আমার সব প্রয়োজন আমার স্বামী মিটিয়েছেন। আর আমি কোনো কসমেটিকস্ ব্যবহার করি না।’
সত্যিই আম্মু মাসশেষে বেতন পেয়েই সোজা চলে যেতেন নিউ মার্কেটে। কিছু কিনতে নয়। ব্যাংকে বেতনের টাকা জমা রাখতে। আম্মুর জমানো টাকার জোরেই আমাদের থাকার জায়গা কলাবাগানের বাড়িটি তৈরি করা শুরু হয়। পরে নেয়া হয় গৃহ নির্মাণ ঋণ। যা শোধ দেয়া চলে আব্বু মারা যাবার বহুদিন পর পর্যন্তও। আব্বু অফিস থেকে পাওয়া মাস শেষে তার রোজগারের টাকার খামটি মুখবন্ধ অবস্থায়ই আম্মুর হাতে এসে তুলে দিতেন। কোনোদিন জিজ্ঞেস করেননি সে টাকা কোন্ বাবদ কেমন করে খরচ হয়েছে। আম্মুর উপর তাঁর আস্থা ছিল অসাধারণ।
আব্বুর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাগুলো একে একে অসত্য প্রমাণিত হয়ে খারিজ হতে থাকে। মার্শাল ল’ কোর্টেই। সর্বশেষ মামলাটি শেষ হবার পর আব্বু বোধহয় মাত্র কয়েকমাস বেঁচে ছিলেন। আমার মনে হত তাঁর কপালে রাজনৈতিক কারণে মিথ্যে কলঙ্কের যে কালিমা লেপন করেছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার তা’ পুরোপুরি মুছে যাবার জন্যই যেন তিনি জোর করে বেঁচে ছিলেন। যখন চলে গেলেন তখন বড় সান্ত্বনা আমাদের কাছে তা-ই ছিল। মিথ্যে কলঙ্কের বোঝার আশান্তি নিয়ে তাঁকে যেতে হয়নি।
আব্বু যখন জেলে তখন আমি হলিক্রস স্কুলের ছাত্রী। সহপাঠীরা প্রায় কেউই রাজনীতি, রাজনীতিকের জীবনের সাথে পরিচিত নয়। বাবা জেলে কেন, নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করেছেন -এমন ধারণা তাদের হয়তো সবারই। রাজবন্দীদের বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার যারা হন তাদের পরিবারের কত রকমের কষ্ট পোহাতে হয় তা’ শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে।
’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আব্বুকে বশ মানাতে না পেরে তাঁকে প্রথমে ওএসডি করা হলো। তাঁর এক বন্ধু বললেন, এর মানে হলো ‘ওরে শালা দালাল’। অনেক পরে তাঁকে কর্পোরেশন (বিসিআইসি) থেকে সরিয়ে দেয়া হলো স্টার পার্টিকেল বোর্ড মিলস-এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব। যথারীতি শিল্প প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। সরকার যখন এটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিল এবং এটি বিক্রি হয়ে গেল ব্যক্তি মালিকানায়, তখন আব্বু সরকারের চাকরি ছেড়ে দিলেন। ততদিনে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের জোর অনুরোধে প্রতিষ্ঠানটির জন্যে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। তারপরতো চলেই গেলেন।
সেসময় আম্মুর প্রচ- বাধা সত্ত্বেও বাড়ির তিনতলা করার কাজটি করালেন। আম্মুর আপত্তি, অসুস্থ শরীর তার মধ্যে বাড়ি তৈরির ঝক্কি নেয়া কেন? আব্বুর কথা ‘একটা তলায় থাকবে, একটা তলার ভাড়া দিয়ে ঋণ শোধ করবে, অন্য তলার ভাড়া দিয়ে সংসার চালাবে।’ তিনি বুঝে গেছেন তিনি চলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে দ্রুত। তিনতলায় নিজেরা থাকবো বলে খুব বড় বসার ঘর আর খাবার ঘর তৈরি করালেন। বললেন ‘এখানেই বড় অনুষ্ঠান করা যাবে।’ সেই বড় ঘরের প্রথম অনুষ্ঠান হলো আব্বুর কুলখানির মিলাদ।
আমার ঘরে কোথায় খাট, কোথায় আলমারি, কোথায় পড়ার টেবিল বসবে, কোথায় বাতি দিতে হবে, যেন বইয়ের ওপর ছায়া না পড়ে সব চিন্তা করেছেন সোৎসাহে। আমার তো জীবনের সবটুকু জুড়ে শুধুই ছিলেন আব্বু। আম্মুর উপস্থিতি সব কিছুতে হলেও আদর, আবদার, রাগ, অভিমান, চাওয়া, গল্প, আলোচনা, কবিতা শোনানো, বেড়ানো, কেনাকাটা, সবকিছু আব্বুর সাথে। কী খাবো, কখন খাবো, কোথায় যাবো, কী পরবো, কী বই পড়বো সবই আব্বুর সাথে।
ভাইয়া এসেছিলেন ছুটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। যখন যাবার সময় হলো, আব্বুর অসুস্থতার কারণে ভাইয়া কিছুটা দ্বিধান্বিত। আব্বু বললেন ‘তুমি যাও। আমি আরও পাঁচ বছর বাঁচবো।’ ঠিক পাঁচদিন বেঁচেছিলেন তারপর। জোর করেই ভাইয়াকে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন। না হলে ওর হয়তো আর যাওয়া হবে না। পড়াশুনোর কী হবে -এই ভাবনায় সুস্থতার ভান করেই যেন পাঠালেন।
হাসপাতালে বারবার তাঁর ছাত্রকালের বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহু অধ্যাপকেরা আসছেন। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেখানে। কেমন আছেন কেউ জিজ্ঞেস করলে অনেককেই বললেন ‘খুব ভালো। মেয়ের বাড়িতেই আছি মনে হচ্ছে।’ আমার বন্ধুরা ঢাকা মেডিকেলের সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সন্ধানীর বন্ধুরা, বড় ভাই বোনরা সব বারবার আসছেন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ যেন। অথচ মেডিকেল বোর্ডসহ সবাই আমরা বুঝছি সময় শেষ হতে আর দেরি নেই। তাঁর শরীরে তখন কী প্রচ- কষ্ট কিছুটা সবাই আঁচ করতে পারলেও সবাই অবাক তাঁর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে। একফোঁটা অভিযোগ নেই। হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে নিয়ে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। বলছেন ভালো আছেন।
শেষ তিনদিন আমি সার্বক্ষণিক তাঁর বিছানার পাশে। সন্ধ্যায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার আবৃত্তি করবার কথা ছিল। জোর করেই পাঠালেন। ‘যাও, কথা দিয়েছো। ওদের সমস্যা হবে না গেলে। আমি শুনবো এখান থেকেই’। শেষ দিন সন্ধ্যা থেকেই বারবার ‘মামণি’ বলে ডাকতে থাকলেন। অন্য কিছু বলছেন না। থেকে থেকেই শুধু বলেছেন ‘মামণি’। মাঝে মাঝে চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে। বাকি সমস্ত জীবনের জন্য আদরের ঐ ডাক ডেকে নিলেন যেন একসন্ধ্যায়। রাত একটু গভীর হতেই আস্তে আস্তে সে ডাকটুকুও বন্ধ হয়ে গেলো। ভোর হবার ঠিক আগ মুহূর্তে চলে গেলেন। খুব শান্ত ভাবে। ডাক্তাররা শেষ চেষ্টাটুকু করে চলে গেলেন। আমি আম্মুকে বললাম, ‘আম্মু তুমি খুশি হয়েছো না, আব্বু আর কষ্ট পাবেন না। খুব কষ্ট ছিল গত ক’দিন’। আমার মুখ চেয়ে আম্মু কান্না চেপে পাথর হয়ে রইলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ আমি খুশি। তোমার আব্বুর কষ্ট শেষ হয়ে গেছে।’
হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাসায় এনে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে জানাজার জন্য নেবার আগে ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে সবার কাছে আব্বুর জন্য মাফ চাইলাম। কবরে নামাবার পর মুঠো মুঠো মাটি ছড়িয়ে দিয়ে আব্বুকে রেখে এলাম বনানী কবরস্থানে। কাঁদতে পারলাম না। শুধু মনে হলো কেন কাঁদবো? আমি ঊনিশ বছরে মেয়ে হিসেবে যা পেয়েছি আব্বুর কাছ থেকে তাতো অনেকে হয়তো নব্বইয়েও পায় না।
যেখানে যেখানে আব্বু কাজ করেছেন সব জায়গার মানুষ চাইছিলেন সেখানে যেন তাঁকে সমাহিত করা হয়। আম্মু বললেন, ‘দীপু যেখানে চায়, সেখানেই হবে।’ আম্মুর জমানো টাকায় ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। আম্মুর জমানো টাকায়ই কবরের জায়গা কেনা হলো। জানাজার জন্য মৃতদেহ বহু জায়গায় নেবার দাবি তুললেন তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীরা। কলাবাগানে জানাজার পর শুধু ইত্তেফাকেই নেয়া হলো। অন্য আর কোথাও নয়।
এই ইত্তেফাক ছিল তাঁর প্রাণ। বাঙালির অধিকার আদায় ও স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগের এক বড় হাতিয়ার। তাই ইত্তেফাক চালানোর অর্থ তাঁর কাছে তাঁর রাজনীতিতে দায়িত্ব পালন। সেভাবেই সারা জীবন দেখেছেন তিনি। ইত্তেফাকের কাগজ কিনবার প্রয়োজনে নিজের শরীরের রক্ত হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে বিক্রি করে সে টাকা দিয়ে কাগজ কিনে এনেছেন। ইত্তেফাক ছাপানো হয়েছে। কখনো কাঁধে করে কাগজ টেনেছেন। সাইকেলে চেপে কাগজ বিলি করেছেন। ইত্তেফাকের জন্যে কোনো কাজকেই কখনো তুচ্ছ ভাবেননি। অবশ্য সব কাজের ক্ষেত্রেই তাঁর এই মনোভাব ছিল। কোনো কাজকেই তিনি অমর্যাদাকর ভাবতেন না। বাড়িতে রান্না করা, বাচ্চাদের ময়লা পরিষ্কার করা, বাথরুম পরিষ্কার করার কাজও যখনি প্রয়োজন নিজে করতেন। আমাদেরও করতে শিখিয়েছেন। একই সাথে সকল মানুষকে তাদের সামাজিক বা আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে সম্মানের চোখে দেখতে শিখিয়েছেন।
আব্বু যখন যেখানেই কাজ করেছেন সহকর্মীদের কাছ থেকে পেয়েছেন ঈর্ষণীয় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কারণ তিনি সবসময় তাদের ভালো-মন্দকে দেখভাল করেছেন আন্তরিকভাবে। ঈগল বক্সে যখন যেতেন রোজ সকালে, কারখানায় ঢুকতেন নিজের দপ্তরে যাবার আগে। প্রতিটি মেশিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করতেন তারা কেমন আছেন। সবার নাম সবসময় মনে রাখতেন। কার পরিবারের কোন সদস্য সদস্যা অসুস্থ বা কার ছেলে মেয়ের পরীক্ষা-এহেন নানা তথ্য তার জানা থাকতো। পরম মমতায় যেমন তাদের সমস্যা সমাধানে সবরকমের সহযোগিতা করতেন, সহানুভূতি জানাতেন, তেমনি কোনো অন্যায় দেখলে বা কাজে অবজ্ঞা চোখে পড়লে খুব কঠোর হতেন।
আব্বুর পরিচালনায় কারখানাগুলো দ্রুত লাভজনক কারখানায় পরিণত হয়েছিলো। কর্পোরেশনের অধীন অন্যান্য কারখানায় লোকসান হতে থাকায় আব্বু যখন তাঁর কারখানার শ্রমিকদের বোনাস দেবার প্রস্তাব করেছিলেন এবং কর্পোরেশন তা’ প্রত্যাখ্যান করেছিল তখন আব্বু খুব ক্ষুব্ধ হন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অন্য কারখানার ব্যর্থতার দায়ে তাঁর কারখানার শ্রমিকেরা কেন বঞ্চিত হবে? শেষমেষ তাঁর যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিয়েছিল কর্পোরেশন। ’৭৩ বা ’৭৪ সালে দেশে কাগজের খুব বড় সংকট দেখা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আব্বুকে ডেকে বলেছিলেন, এই সংকট দূর করতে বাংলাদেশ কাগজ ও বোর্ড মিলস সংস্থার বিপণন পরিচালকের দায়িত্ব নিতে হবে। আব্বু একটি শর্ত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আপনি বা আপনার সরকারের কোনো মন্ত্রী আমার নেয়া সিদ্ধান্তে কারও লাইসেন্স বাতিল হলে তার জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না। তাহলে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেবো।’ কারণ বঙ্গবন্ধুর কাছে কেউ গিয়ে পায়ে পড়লে, কাঁদলে তাঁর মন গলে যেত প্রায়শই। সে ভয় করেছিলেন আব্বু। বঙ্গবন্ধু হেসে কথা দিয়েছিলেন। তিনমাসের মধ্যে সারা দেশে কাগজের সংকট দূর হয়েছিলো। অনেক ঝুঁকি নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স পারমিট বাতিল করেছিলেন। তার কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চালের সংকট দেখা দিচ্ছে। তোকে দায়িত্ব দিতে চাই।’ আব্বু সবিনয়ে বলেছিলেন ‘এ দায়িত্বটা বঙ্গবন্ধু অন্য কাউকে দিন।’ আব্বুর উপর বঙ্গবন্ধুর ছিলো অগাধ আস্থা। সে আস্থা তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর সততা, তাঁর দেশপ্রেম, দলের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে অকুতোভয় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সারাজীবনের ত্যাগের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি আব্বুর সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ‘একমাত্র ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সম্পাদক ওয়াদুদের জন্য প্রতিষ্ঠানের সমূহ ক্ষতি হতে পারে নাই।’ আব্বু সস্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর সহকর্মীরা বলেছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে তাঁর দক্ষতার কথা। সকল আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করতে তাঁর অসাধারণ সাহস, মনোবল, ত্যাগ স্বীকার, সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত, অমানুষিক পরিশ্রমের কথা। বলেছেন ছাত্রলীগের স্কুল শাখা গঠনে তাঁর সাফল্যের কথা। বলেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে সকল বড় মিছিল, সভার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাঁর অসাধারণ সাফল্যের কথা। বলেছেন তাঁর যুক্তিপূর্ণ সম্মোহনী ক্ষমতার বক্তৃতার কথা যা সবাইকে মুগ্ধ করতো, আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতো।
আব্বুর প্রখর ব্যক্তিত্বের কথা লিখেছেন কেউ কেউ। আমরা ছোট বেলা থেকেই তা-ই দেখেছি। অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা কোনোদিন বলতে শুনিনি। সর্বক্ষণ হাসিমুখ সবার সাথে। কোনো চটুল স্থূল রসিকতা করতে কোনোদিন কেউ শোনেনি। সবার ভরসার স্থল ছিলেন। যে কোনো বিপদে আপদে, সমস্যা সংকটে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, সহকর্মী, পরিচিতজন সবাইকে দেখেছি আব্বুর কাছে পরামর্শের জন্য আসতে। আব্বুও সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন। পরামর্শ দিতেন। যখনই পারতেন সহায়তা করতেন। সাহস যোগাতেন। নিজের জীবনে আদর্শচ্যুত হননি কখনো। না কোনো প্রলোভন, না কোনো ভয় ভীতি। কোনো কিছুই তাঁকে পরাভূত করতে পারেনি। তাঁর নিজের প্রয়োজন ছিল খুবই সামান্য। অত্যন্ত সাদা সিধে জীবন যাপন। সাধারণ পাজামা পাঞ্জাবী, মুজিব কোট আর শাল। সঙ্গে পাম্প স্যু অথবা স্যান্ডেল স্যু। হাতে একটি বহুদিনের পুরানো ঋধাৎব খবঁনধ ঘড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। লিখবার একটি সাধারণ ঝর্ণা কলম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকতে ভালবাসতেন। নিজের কাজ নিজেই করতেন বেশির ভাগ। ধর্মপালনে ছিলেন নিষ্ঠাবান। নামাজ রোজায় ফাঁকি দেয়া নেই। দেখানোও নেই। নামাজ শেষে ফজরের পর দীর্ঘক্ষণ মোনাজাত করতেন। তখন তাঁর দু’চোখে বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতো। জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘মামণি কিছু চাইলে সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়ার মত করে চাইতে হয়।’ আমার বিশ্বাস আব্বুর সে চাওয়ায় বেশির ভাগটুকুই থাকতো তাঁর ছেলে মেয়েকে নিয়ে। তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সম্ভবত তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়ার মত করে চাইতেন বলেই।
চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। পেশাগত উৎকর্ষতা দিয়ে শুধু রোজগার করা নয়, দেশের স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মানুষের দুঃখকে লাঘবে কাজ করবে। ভাইয়ার নাম রেখেছিলেন টিপু সুলতান। যে বীর বুকে সাঁইত্রিশটি বুলেটের আঘাত নিয়েছিল, পিঠে একটিও নয়। আত্মীয় স্বজনের পীড়াপীড়িতে আরবী নাম রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ।
আব্বু তুমি নিশ্চয়ই দেখছো আর খুশি হচ্ছো, শান্তি পাচ্ছো, কারণ তোমার ছেলে তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। রোগীদের প্রতি ভাইয়ার আচরণ, ওর সেবা দেবার মানসিকতা ঠিক তেমন যেমন তুমি চাইতে। চাঁদপুরের মানুষের প্রতি ওর ভালোবাসা, দায়িত্ববোধও তোমার খুব ভালো লাগতো। তুমি নিশ্চয়ই খুব গর্ব বোধ করতে। দেশ আর রাজনীতি নিয়ে ভাইয়া যেমন করে নিঃস্বার্থ ভাবে সময় আর শ্রম দেয় তা’ তুমি নিশ্চয়ই যেমন আশা করতে ঠিক তেমনই আব্বু।
মেয়ের নাম ছেলের নামের সাথে মিলিয়ে দীপু মনি রেখেছিলেন। মনে পড়ে ১৯৭৮-এর জানুয়ারিতে আমার স্কুল শিক্ষকেরা বেশ কয়েকজন এসেছিলেন আব্বুর কাছে অনুরোধ করতে, আমার নাম যেন বদলে দিয়ে একটু পোশাকী নাম দেয়া হয়। আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’ তাঁদের যুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গেলে আমাকে এই নামটি নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে। ছেলেরা খেপাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বু ধৈর্য ধরে তাঁদের কথা শুনলেন। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ দৃঢ়তায় শান্তভাবে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস আছে, আমার মেয়ে যে কোনো ঝামেলা সামলাতে পারবে। তাছাড়া ও বড় হয়ে ডাক্তার হবে। দীপু মনি যদি আর কারও নাম থেকেও থাকে ডাক্তার দীপু মনি শুধু একজনই হবে। ও রাজনীতি করবে। সবাই ওকে এক নামে চিনবে।’ আমার বয়স তখন সবে তেরো! আমার বিশ্বাস আব্বুর সে চাওয়া এতোটাই গভীর, এতোটাই প্রবল ছিল যে সৃষ্টিকর্তা তাঁর সে চাওয়া পূরণ করেছেন।
ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব সচেতন ছিলেন আব্বু। শব্দচয়ন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গির ক্ষেত্রে সচেতনতা, যুক্তিনির্ভর বাহুল্যবর্জিত কথাবার্তা একই সাথে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল। পছন্দ করতেন এই গুণগুলো অন্যদের মধ্যেও। তাঁর প্রভাবেই আমিও ভাষা ব্যবহারে সচেতন থাকতে সবসময় সচেষ্ট থাকি। মনে পড়ে একবার কোরান শরীফ পড়তে বসেছি আব্বুর সাথে। আব্বু খুব শুদ্ধ উচ্চারণে কোরান তেলাওয়াত করতেন। আমাকে অনেক ধৈর্য ধরে আরবী উচ্চারণ সঠিকভাবে শেখাবার চেষ্টা করছেন। শব্দগুলো একেকটা মুখের, গলার মধ্যে নানা জায়গা থেকে উচ্চারণ করাবার চেষ্টা করছেন। আমি পারছি না এবং কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠছি। আব্বু খুব আদর করে বললেন, ‘মামণি আরবীটাও একটি ভাষা। বাংলা বা ইংরেজি উচ্চারণের ক্ষেত্রে যেমন শুদ্ধ না হলে তা নিয়ে হাসি ঠাট্টা কর, আরবী উচ্চারণের ক্ষেত্রেও একই সচেতনতা থাকা উচিত শুদ্ধতার প্রতি।’ বলা বাহুল্য সে বয়সে সেই উপদেশ পালনে যতœবান হইনি। আজ মনে হয় কী অসাধারণ সুযোগ হেলায় হারিয়েছি নিরর্থক উন্নাসিকতায়। খুব সংক্ষেপে অনেক বড় কিছুও বলতে পারতেন। জিয়াউর রহমানের শাসনকালকে বর্ণনা করতে যেয়ে এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘কার্ফিউ দিয়ে দেশ চালানোর রাজনীতি, খালকাটার অর্থনীতি আর প্রিন্সেসদের নাচের সংস্কৃতি।’
আমি এইচএসসি পাস করেছি। এরপর কী পড়বো তা-ই নিয়ে বাসায় কথাবার্তা চলছে। আমার ইচ্ছে সাহিত্য বা পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়বো। শিক্ষকতা করবো আর রাজনীতি করবো। আম্মু মহা খেপে আছেন। আইনজীবী পিতার কন্যা তিনি। চান তাঁর মেয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা আইনজীবী হবে। আব্বু আমাকে বললেন, ‘মামণি, জীবনটা তোমার। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাও তোমার। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যদি চিকিৎসক হও তাহলে সহজে মানুষের কাছে যেতে পারবে। স্বাধীনভাবে, কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে। তোমার রাজনীতিতে সহায়ক হবে।’ -আর কিছু বলতে হয়নি। রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। পড়ার বেশি চাপ ও ধরণ নিয়ে যেটুকু ভাবনা ছিল তাও উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে। তোমার ভালো লাগবে।’
বই পড়ার অভ্যেসটা তৈরি হবার পেছনে আব্বুর পড়ার অভ্যাস এবং স্কুলের প্রায় সব পুরস্কার হিসেবেই বই পাওয়ার একটা ভূমিকা ছিল। হলিক্রস কলেজের মূল ফটকের ঠিক উল্টোদিকে ছিল পূর্বাচল প্রকাশনী বলে একটি বইয়ের দোকান। সেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি বই কেনা ছিল একেবারে বাঁধা। সে বই নিয়ে বাড়ি ফিরে অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বু বাড়ি আসবেন। এলেই পড়ে শোনাবো নূতন বই থেকে। কখনো বলেননি-আমি ক্লান্ত বা এখন থাক।
সমাজ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বিশ্বাস করতেন নিজ যোগ্যতায় মানুষ সমাজে নিজের স্থান করে নেবে। চাইতেন আমরাও সচেতন হই আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ নিয়ে। চলতে শিখি। মোকাবেলা করতে শিখি সব বাধা বিঘ্ন। হলিক্রস স্কুলে ভর্তি করে দিলেন নবম শ্রেণীতে। স্কুলে যেতে শুরু করার কিছুদিন পর বললেন, ‘কাল থেকে মামণি তুমি আর গাড়িতে চড়ে স্কুলে যাবে না। রিক্সা আসবে একটা বাসায়। তোমাকে ঐ রিক্সা স্কুলে পৌঁছে দেবে আবার নিয়ে আসবে।’ আম্মু খুবই উৎকন্ঠিত। কেন শুধু শুধু মেয়ে গাড়ি ফেলে রিক্সায় কলাবাগান থেকে তেজগাঁ যাবে আসবে! আব্বু বললেন, ‘শিখতে হবে!’ কিছুদিন পর বললেন নির্ধারিত রিক্সায় নয়। বাসা থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে নিজে রিক্সা ঠিক করে যেতে হবে। একই পদ্ধতিতে ফিরতেও হবে। তারও কিছুদিন পর বললেন, ‘এখন থেকে রিক্সা নিয়ে স্কুল পর্যন্ত যাবে না। আনন্দ সিনেমা হলের সামনে নামবে, ওভারব্রীজ হেঁটে পার হয়ে উল্টো দিকে স্কুলে যাবে। আসার সময়ও ব্রীজ পেরিয়ে সিনেমা হলের সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরবে।’ আম্মুর উৎকণ্ঠা বাড়তেই থাকলো। তেরো বছরের মেয়েকে কেন এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসতে হবে? আব্বু বললেন, ‘সব রকম পরিস্থিতিতে আমার মেয়ের চলতে শিখতে হবে।’ -আজ মনে হয় আব্বুর সেই চলতে শেখানো কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাজনৈতিক কাজে চলতে হয় হরহামেশাই প্রচ- ভিড়ে। আর এ চলাতো শুধু ঝক্কি ঝামেলার ভিড়ে, অনেক বাধার মধ্যে এক কিশোরীর পথে চলার অভ্যাস নয়। জীবনের সব বিপদ সংকুল, বৈরী পথে এক নারীর পথ চলতে শেখা। আব্বু আমি বুঝি, জানি, তুমি সে পথ চলাই শিখিয়েছিলে।
মানুষের সাথে তাঁর আচরণ ছিল অসাধারণ। সবসময় ইতিবাচক। উৎসাহব্যঞ্জক। যেকোনো ভাল কাজকে প্রশংসা করতে ভুলতেন না। ছোট-বড় সবাইকে গুরুত্ব দিতেন। সববয়সী মানুষের সাথেই মিশতে পারতেন। শিশুদের প্রতি ছিল অসীম মমত্ববোধ। বাচ্চাদের যেখানেই দেখতেন তাদের সাথে খেলতে, তাদেরকে সময় দিতে, কথা বলতে, আদর করতে পারতেন। বাচ্চারাও দারুণ আকৃষ্ট হতো তাঁর প্রতি। কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠায় ও এর প্রসারে তাই তাঁর অংশগ্রহণ ছিল স্বাভাবিক। দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ, সুশৃঙ্খল, মেধাবী, দেশপ্রেমিক, নাগরিক গড়ে তুলতে শুরু করতে হবে শিশু কিশোরদের নিয়ে। ছোটবেলায় কচিকাঁচার মেলার নানা অনুষ্ঠান, ক্যাম্পিং, ব্রতচারী গান, নাচ শেখার কথা এখনো মনে পড়ে। মহিলারাও আব্বুকে খুব পছন্দ করতেন। ছাত্র জীবনেও, পরেও। বুঝতে পারি তাঁর ব্যক্তিত্ব, আচরণ, মানুষের প্রতি সম্মানবোধ, ভালবাসা মানুষকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতো।
আব্বু দারুণ মেহমানদারি করতে পারতেন। সবাইকে পাতে তুলে খাওয়ানো যত্ন করায় তাঁর জুড়ি ছিল না! যে কোনো বিয়ে বাড়িতে গেলে বা বড় কোনো খাওয়া দাওয়ার জায়গায় নিজে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে নিতেন সব খাওয়া দাওয়ার দেখভাল করবার। পরিবেশন যেন সুশৃঙ্খলভাবে হয়, অতিথিরা যেন ঠিকভাবে খেতে পারেন, সবাই যেন খুশি হন। লোককে বেড়ে খাওয়াবার খ্যাতি ছিল তাঁর। নিজে ভালো খাওয়া পছন্দ করতেন, তবে পেট ভর্তি করে নয়। দাদাবাড়ির খাওয়ার ও খাওয়ানোর খ্যাতি থাকলেও শুনেছি ছাত্র রাজনীতি করার সময় যেখানে জায়গীর থাকতেন সেখানে তাঁর সাথে অনেক সময়ই তাঁর সহকর্মীরা কেউ কেউ থাকতেন। তিনি কখনো বাড়তি খাবারের কথা বলতেন না। নিজের খাবারটুকু সহকর্মীর সাথে ভাগ করে খেতেন। বড় মাছের প্রতি আর্কষণ ছিল। সেটি পিতৃসূত্রে পাওয়া। ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে তাঁদের বাড়ি, বড় মাছ ছাড়া দাদা খুশি হতেন না। নানা গল্পও আছে এ নিয়ে! বলতেন মাছ যদি থালার এপাশ ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে থাকার মত বড় না হল তাহলে খেয়ে মজা নেই। অসম্ভব মিষ্টি প্রীতি ছিল। খাবারের শেষে প্রতিবেলায় মিষ্টি খেতেই হবে। দুয়েকবার মিষ্টি হয়তো ছিল না বাড়িতে (যেটি আমাদের বাড়ির জন্য বেশ অস্বাভাবিক ছিল), আব্বু বলেছেন একটু চিনি নিয়ে আসতে! অর্থাৎ মিষ্টি কিছু চাইই চাই। এই আব্বুকেই দেখেছি যখন একবার ডাক্তার বললেন মিষ্টি না খেতে এবং সবাই ভাবলেন সেটা কখনোই সম্ভব নয়, তিনি বরাবরের মতই রোজ মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরতেন, কিন্তু নিজে মুখেও দিতেন না। কী প্রবল ইচ্ছে শক্তি ছিল তাঁর!
প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। মানিক মিয়া চাচার স্ত্রী মাজেদা চাচীর এক বড় অসুস্থতার সময় তাঁর রক্তের প্রয়োজন পড়ে। আব্বু দিয়েছিলেন সে রক্ত। চাচী আব্বুকে তাই তাঁর ‘ভাই’ ডাকতেন। আব্বুর ওপর তাঁরও ছিল অগাধ আস্থা। বাড়িতে তাঁর ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি বড় আকারে হলেই আব্বুকে অনুরোধ করতেন তার ‘ভাবী’ সেই ঝগড়া মেটানোর জন্য ধানমন্ডীতে তাঁর বাড়িতে যেতে। বহুবার এরকম গেছেন আব্বু।
কলাবাগানে বাড়ি তৈরির সময় নিজের জায়গা ছেড়েছেন রাস্তা চওড়া করাবার জন্য। তারপর আশ পাশের বাড়ির মালিকদেরও অনুরোধ করেছেন। যুক্তি দিয়েছেন বিপদে আপদে অ্যাম্বুলেন্স বা দমকলের গাড়ি ঢোকার সুযোগ থাকা দরকার, প্রয়োজনে ছেলেমেয়েরা যেন খেলাধুলাও করতে পারে। সবাই মেনে নিয়েছেন। পাড়ার রাস্তাটি প্রশস্ত, সুন্দর হয়েছে। সবার চলাচলের সুবিধে হয়েছে।
আব্বুর চারিত্রিক দৃঢ়তা মানবিক গুণাবলি আর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে তিনি প্রিয় ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। প্রিয় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। ’৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে যখন আব্বুকে তাঁর বাসা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তখন তাঁর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আব্বুর শারীরিক অবস্থা নিয়ে এ সময় উদ্বেগ জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি লিখেছিলেন মানিক মিয়া সাহেবকে। পত্রটির যে অনুলিপি গোয়েন্দারা রিপোর্টে সংযুক্ত করেছিল তা’ এই গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে।
সেসময় রাজনীতি করা, দলকে সংগঠিত করা দুরূহ কাজ ছিল। যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র। আব্বু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সব জেলায় মহকুমায় চিঠিপত্র পাঠাতেন বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে। তাঁর লেখা পাবনা সদর মহকুমার যুগ্ম সম্পাদক এএম আজিজুল হককে পাঠানো একটি প্রত্যয়ন পত্র গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। হয়তো তাঁর লেখা বহু চিঠিপত্র অনেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা জানি না। চল্লিশ, পঞ্চাশের দশকের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সফল করতে আব্বু ও তাঁর সাইকেলই যথেষ্ট ছিল বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। ’৬৪-র দাঙ্গা দমনে আব্বুর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে দক্ষ ছিলেন। আব্বু একই সঙ্গে ছিলেন দারুণ কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও সংবেদনশীল। নাটক সিনেমা দেখলে যেমন কান্না সামলাতে পারতেন না, তেমনি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কন্যা বিদায়ের সময় এমনকি বর পক্ষের অতিথি হয়েও কান্না সামলাতে পারতেন না। নিজের কষ্ট সব নিঃশব্দে সহ্য করতে পারতেন, প্রচণ্ড কষ্টেও হাসিমুখ বজায় রাখতে পারতেন অথচ অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রতি, মানিক চাচার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। মনে পড়ে, যেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন ১৯৮১-র ১৭ই মে তারিখে, সেদিনের কথা। আব্বু তখন খুব অসুস্থ। সেদিন প্রচ- জ্বর। শরীর খুব দুর্বল। কিন্তু আব্বু বিমানবন্দরে যাবেনই। গাড়ি কলাবাগানের বাসা থেকে বনানীর কবরস্থান রোডের কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়ে আর সামনে এগুতে পারলো না ভিড়ের চাপে। অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। শেখ হাসিনাকে নিয়ে ট্রাক যখন আমাদের গাড়ির কাছাকাছি এলো আপা ট্রাকের উপর থেকে আব্বুকে দেখে ‘কাকা!’ বলে কেঁদে ফেললেন। আব্বুও দুহাত বাড়িয়ে কাঁদছেন। ট্রাকের পাশে পাশে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত এলাম। নেত্রী প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রকৃতির কান্নাকে ছাপিয়ে তার কান্না ভেজা বক্তব্য রাখলেন। সারা বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবী যেন কাঁদছিল অঝোর ধারায়। আব্বুকে কিছুতেই গাড়ির ভেতরে বসিয়ে রাখা গেল না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে অঝোর ধারায় তিনি কাঁদলেন তাঁর মুজিব ভাইর মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে। মুজিব ভাইকে হারিয়ে সেদিন যে কান্না তিনি কাঁদতে পারেননি, শক্ত হয়েছেন, সবাইকে শক্ত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নির্যাতন-নিপীড়নের, কারাভোগের তোয়াক্কা করেননি, সেই সব জমানো চেপে রাখা কান্না যেন সেদিন আব্বু কেদেঁছিলেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষ কেদেঁছিল। সেই কান্নার মধ্যে মিশে ছিল ’৭৫-এ পিতাকে হারানোর বেদনা, আদর্শচ্যুত হয়ে দেশের ভ্রান্ত পথচলার হতাশা, নেত্রীর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সে আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, ’৭১-এর চেতনাকে ফিরে পাবার আশা, আর বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা গড়বার প্রত্যয়।
আব্বু মৃত্যুর আগেই দেখেছেন জিয়ার পর এরশাদের সামরিক শাসনের শুরু। কিন্তু সংগ্রামী এই মানুষটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছেন সব দুঃশাসনের, অপশাসনের তিমির ভেদ করে গণতন্ত্র ফিরবেই। বাঙালি তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বেই। তাই ’৮৩-র এপ্রিলের ৬ তারিখ ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমাদের ব্যাচের ‘ওরিয়েন্টেশনে’ অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বলবার জন্য যখন তাঁকে সব অধ্যাপক অনুরোধ করলেন তখন অত্যন্ত দুর্বল শরীরে অসুস্থ অবস্থায়ও তার বক্তব্যে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়াশোনায় মনোনিবেশের সাথে সাথে সামরিক শাসনের বুটের তলায় যেন দেশ পিষ্ট না হয় তার জন্য সবাইকে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জোরালো আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আব্বু, লড়াইটা আমাদের এই গণতন্ত্রের কালেও চালাতেই হচ্ছে। কারণ অপশক্তি বারবার ছোবল হানে। হানছে। দেশকে অপশক্তির হাত থেকে মুক্ত রাখতে, গণতন্ত্রকে নিষ্কন্টক করতে আমাদের যে সংগ্রাম সে সংগ্রামে তুমি, তোমরা, পথ দেখিয়েছো, ত্যাগ স্বীকার করেছো। তোমাদের দেখানো পথেই যেন আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারি। তোমার, তোমাদের অনুপ্রেরণাতো আছেই আমাদের সাথে অণুক্ষণ।
ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বলে আব্বুর আস্থা, বিশ্বাস আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল বহু শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে। রাজনীতিকদের পাশাপাশি, দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরাও ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন। বাবার সূত্রেই সেইসব বরেণ্য ব্যক্তিদের আদর, ভালোবাসা পেয়েছি আমি। এখনও পাই। বাবার ত্যাগ, সংগ্রামী জীবন, কখনও কোনো প্রতিদান কারও কাছে না চাওয়া, দেশের জন্য নিবেদিত তাঁর জীবনে যত নির্যাতন ভোগ-সবকিছু আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছে। আর বাবার কারণেই আমি পেয়েছি অনেক। আমার নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমার দল, আমার এলাকার মানুষ সবার কাছ থেকেই। সন্তানদের সুশিক্ষিত ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়াও বাবা-মা’দের ইচ্ছে এবং চেষ্টা থাকে সন্তানদের ভবিষ্যতের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য, নিরাপত্তার জন্য সম্পদ রেখে যাবার। আমার আর আমার ভাইয়ের জন্যে থাকবার জায়গা রেখে গেছেন আব্বু বহু কষ্টে। সে কৃতিত্বের সিংহভাগ আমাদের আম্মুর। তবে আব্বু তাঁর জীবনের সম্পদ ও সঞ্চয় তাঁর সততা, উদারতা, দেশপ্রেম, বিশ্বস্ততা, ত্যাগ, পরিশ্রম, দক্ষতা আর আদর্শের প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের যে সুনাম রেখে গেছেন আমাদের জন্যে, একজন পিতা হিসেবে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোনো সম্পদ সন্তানের জন্য বোধকরি রেখে যেতে পারেন না কেউ। এ আমাদের গর্ব।
লেখক : ডাঃ দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।