গত ১৩ অক্টোবর হাজীগঞ্জে বিভিন্ন পূজাম-পে হামলার সময়ের বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ পুলিশের হাতে এসেছে। একই সাথে গুজব ছড়ানো বেশ ক’টি ফেসবুক পেজ পুলিশের তদন্তে মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগছে। মূলত পুলিশ এসব ভিডিও ক্লিপ দেখে আসামী সনাক্ত ও আটক করছে। আবার গুজব ছড়ানো, মিছিলের ডাক দেয়া ফেসবুক পেজগুলো সনাক্ত করা হয়েছে। তবে গুজব ছড়ানো বেশিরভাগ পেজ দেশের বাইরে থেকে চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। মিছিল ও হামলায় অংশ নেয়া এক মাদ্রাসা শিক্ষককে ভিডিও দেখে আটক করার পর আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ওই শিক্ষক। যাদেরকে ভিডিও ক্লিপে দেখা যাবে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে এবং সাধারণ মানুষ কাউকে হয়রানি করা হবে না বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) সোহেল মাহমুদ, বিপিএম।

গত ১৩ অক্টোবর ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গা পূজার সপ্তমী। সেদিন কুমিল্লায় একটি ম-পে হনুমানের কোলে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে বিকেলে হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার হৃদয় নামের এক যুবকসহ বেশ কয়েকজন তাদের ফেসবুক পেজে মিছিলের ডাক দেয়। সেই পোস্টের কয়েক ঘন্টা পর সন্ধ্যায় পৌর এলাকার রান্ধুনীমুড়া থেকে একদল কিশোর মিছিল নিয়ে হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারে আসে। সেই মিছিলটি হাজীগঞ্জ বাজারস্থ শ্রীশ্রী রাজালক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়ার গেটের সামনে দিয়ে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের শেষ প্রদক্ষিণকালে মন্দিরের গেট অতিক্রম করার সময় মন্দির গেট লক্ষ্য করে পাথর ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে মিছিলকারীরা। এ সময় মন্দিরের গেটের বাইরে কয়েকজন পুলিশসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হামলাকারীদের নিবৃত করার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। মিছিলকারীরা মারমুখী হয়ে উঠলে পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি চালায়। এ ঘটনার পর পর বাজারের ৪টি পূজা ম-প ভাংচুর করে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা।

এদিকে আখড়ার সামনে মিছিলকারীরা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা জানাজানি হলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পূজা ম-পসহ বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ি ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা। এতে করে মোট ১৪টি মন্দির ভাংচুরের শিকার হয় ও ৬টি মন্দির বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে পুলিশ দাবি করে।

রাতের বেলা মন্দির ভাংচুরের ঘটনা ঘটার পর থেকে পুলিশ মিছিলকারীসহ পূজাম-প ভাংচুরে অংশগ্রহণকারীদের খুঁজতে বিভিন্ন সূত্রের সন্ধানে নামে।

মন্দিরে মন্দিরে হামলাকারী ও মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সনাক্ত করতে পুলিশ প্রথম লিংক পায় ভিডিও ফুটেজের। ভিডিও ফুটেজের মধ্যে বিভিন্ন জনের মোবাইলে ধারণ করা মিছিলের ও মিছিল শেষে হামলার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এছাড়া হাজীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নিজস্ব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও পূজা ম-পগুলোতে স্থাপনকৃত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ।

ঘটনার দিন বিকেল থেকে যারা নামে বেনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজব ও উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে তাদের পরিচিতি বের করার তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। এছাড়াও ফুটেজের বাইরেও ফেসবুক পোস্টের বাইরে উস্কানিদাতা একটি চক্রকে সনাক্তের কাজ এগিয়ে চলছে বলে পুলিশ জানায়।

সংগৃহকৃত ভিডিও ফুটেজ দেখে এখন পুলিশ আসামী সনাক্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আসামী সনাক্তের সূত্র ধরে পুলিশ সোমবার সকাল পর্যন্ত ৫৪ জনকে আটক করেছে। আবার আটককৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনেকের নাম প্রকাশ্যে আসছে। আটককৃতদের মধ্যে শাহরাস্তি উপজেলার ভোলদিঘি কামিল মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক কামাল উদ্দিন আব্বাসীকে আটক করা হয়। কামাল উদ্দিন আব্বাসী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ছাড়া বেশ কজনকে ইতিমধ্যে রিমান্ডে এনেছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১৩ অক্টোবর হামলার ঘটনায় ১৪টি মন্দির ভাংচুরসহ ৫ জন নিহত হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা দুটি ও ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা ৮টি মিলিয়ে মোট ১০টি মামলায় আসামী করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জনকে। এর মধ্যে সোমবার সকাল পর্যন্ত ৫৪ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের কয়েকজনের রিমান্ড চলছে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) সোহেল মাহমুদ জানান, আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনছি। আবার আটককৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে নতুন নতুন নাম সামনে চলে আসছে। ফেসবুক পোস্ট দেয়াকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি আইডি সনাক্ত করেছি যেগুলো দেশের বাইরে থেকে প্রচার করা হচ্ছে। ফেসবুকে অপপ্রচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

উল্লেখ্য, ১৩ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে হাজীগঞ্জ বাজারে একটি মন্দিরে হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। ওই ঘটনায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করলে হামলাকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে ৫ জন মারা গেছে।