সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০

কবি ও সংগঠক তছলিম হোসেন হাওলাদার প্রসঙ্গ
মনিরুজ্জামান প্রমউখ

২০১০ সাল আমার পত্রিকায় লেখালেখির শুরুর বছর। ডায়েরির লেখালেখি খানিক আগে হালকাণ্ডপাতলা গোছের। বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম লেখা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের বরাতে। সেপ্টেম্বর ছিলো সে মাসের নাম।

সেই থেকে চাঁদপুরের পৌর পাঠাগার আর বর্তমানের নাম জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, চাঁদপুর--এই দুই পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক বনে গেলাম সপ্তাহান্তে একদিনের। একদিনের এই কারণে যে, গ্রামীণ জনপদ হতে শহরের কলকব্জা ধরতে যে জীবাকার হতে হয় তাতে আমার রসদের ঘাটতি ছিলো। লাইব্রেরী-ওয়ার্ক শেষে সন্ধ্যার প্রান্তলগ্নে দরকারি পত্রিকা, বই কেনার জন্যে পা বাড়াতাম জসীম মেহেদীর বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা কাম স্টেশনারির দোকানে। সেই সূত্র ধরে দোকানের কর্ণধার লেখক জসীম মেহেদীর সাথে মোলাকাত।

তারই ধারাবাহিকতায় কিছু সময় অতিবাহিত হতে না হতেই নতুন নতুন পরিচয়ের পালা ক্রমশঃ দিগন্তপ্রসারী হতে লাগলো। চাঁদপুরের সাহিত্য আকাশে এক নবসূচনার উদ্ভব হতে শুরু করলো। এর মানে হলো একটা আড্ডামুখী আবহ সূত্র ঘন হতে আরম্ভ করলো। আর কে না জানে, সাহিত্যের উত্থানাকাশে সাহিত্য আড্ডার ভূমিকা কতোখানি অক্সিজেন ফিল্টারের সমতুল্য।

প্রথম পরিচয় ঘটে রফিকুজ্জামান রণির সাথে। একদিন জসীম মেহেদীর দোকানের বাইরের অংশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর মেহেদী ভেতরে। সাহিত্য ও সমসাময়িক আলোচনার প্রান্তলগ্নে রণি এসে অকপটে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি রফিকুজ্জামান রণি। আমি আপনাকে চিনি। আপনি মনিরুজ্জামান প্রমউখ। বিপরীতে আমিও বললাম, আমিও তোমার নামটাকে চিনি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সৌজন্যে। এবার তোমাকে চিনলাম। এরপর নিয়মিত সাক্ষাৎ শুরু হলো লাইব্রেরী এবং মেহেদীর দোকান মূলতঃ এই দুই জংশনে। আমি লাইব্রেরীতে থাকাবস্থায় রণি গিয়ে হাজির হতো। মাঝেমধ্যে মুহাম্মদ ফরিদ হাসানও ছিলো সে পথের সারথি। অতঃপর আরো কেউ কেউ।

মেহেদীর দোকানের বাইরের অংশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আরো অনেকের সাহচর্য যুক্ত হলো--আড্ডা ঘনীভূত হবার সূচনার পূর্বে ও পরে এবং সাহিত্য সম্পর্কিত উপাদান আদান-প্রদানে। তাদের মধ্যে ছিলেন তছলিম হোসেন হাওলাদার, আশিক বিন রহিম, সাদী শাশ্বত, ম. নূরে আলম পাটোয়ারী, একটু পরে সৌম্য সালেক সহ আরো নাম মনে না থাকা অনেকে।

আজকের আলোচনা কবি ও সংগঠক তছলিম হোসেন হাওলাদারকে নিয়ে। তুলনামূলকভাবে একটু দেরিতে পরিচয় হলেও সময়ের অলিগলি পেরিয়ে হৃদয়ের নৈকট্য লাভ করেছেন অতি দ্রুত। সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন আপাদমস্তক তছলিম হোসেন হাওলাদার। সৃজনশীলতার দুয়ারে আড্ডাভাজন মানুষ ছিলেন নিরন্তর। অবয়বে ছোটোখাটো একজন মানুষ হৃদয়ের পরিসীমায় কতো বিস্তৃত অবকাঠামো ধারণ করলে পুত্রসম সাহিত্য সহযাত্রীদের সাথে অবলীলায় বন্ধুত্বের রোজনামচায় মন ভাসিয়ে দিতে পারতেন। প্রথম সাক্ষাতে পছন্দ হয়ে যাওয়া মানুষ ছিলেন তছলিম হোসেন হাওলাদার। আলোচনার করিৎকর্মায় যুক্তি খণ্ডন হতো। কিন্তু তর্ক হতো না কখনো। রুচিশীল মানুষের প্রতিমূর্তি ছিলেন হাওলাদার সাহেব। আমার দেখা চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গনের উল্লেখযোগ্য একজন হৃদয়বান মহৎ মানুষের চিরবিদায়ের কথা জেনে মর্মাহত হই! বিচলিত হই এই ভেবে যে, মানুষের জীবনায়ু কতো ক্ষুদ্র এই পৃথিবীতে! আরেকটু সময় বেঁচে যেতে পারতেন কবি এই ধরাতে, আরো কিছু অক্ষর বুননের চাষ করার সুযোগ দিতে পারতেন বিধাতা কবিকে। জীবনের সবচেয়ে প্রশান্তিময় সময়টুকু উপভোগ করতে দেননি সৃষ্টিকর্তা কবিকে। এটাই নিয়তি। মেনে নিতেই হয়, মন না চাইলেও; অন্তরকে সান্ত¡নার আচ্ছাদনে স্মৃতিময়তার ভাণ্ডারে প্রবেশ করাতে বাধ্য করতে হয়। তারপর একদিন স্মৃতিনির্ভরের রপ্ত হয়ে পড়ে আমাদের হৃদয়। আমরা স্মরণ করি আমাদের ভালোবাসার মানুষকে, আমাদের শ্রদ্ধার মানুষকে, আমাদের হৃদয়ের একাংশে জুড়ে যাওয়া মানুষকে।

তছলিম হোসেন হাওলাদার এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি দুই জনের দ্বন্দ্বের ভেতরে আগ্নেয়গিরির লাভা ঢেলে দিতেন না। বরং মীমাংসার দরজা খুলে দেয়ার পথোৎস খুঁজে বেড়াতেন। এ রকম দিলের মনোভাব দেখা মেলা ভার। কবি তছলিম হোসেন হাওলাদারের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিলো এ বছরেরই ফ্রেব্রুয়ারির ১১ ও ১২ তারিখ জেলা সাহিত্য মেলাতে। একসাথে পাশাপাশি বসা, খাওয়া-দাওয়া, আলাপচারিতায় এক সুখকর স্মৃতিধন্য ইতিহাসের বুনন। বরাবরই সাক্ষাতে ওনার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। শেষবারেও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। হায়! আন্তরিক হৃদয়বান মানুষ কেনো যে দ্রুত অন্তরালে হারিয়ে যায়!

দুঃখিত সর্বান্তরে, হাওলাদার সাহেব আপনার জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করতে না পারার অক্ষমতার জন্যে। আরো দুঃখিত এই জন্য যে, চাঁদপুর সাহিত্য সমাজ আয়োজিত আপনার শোকসভায়ও অংশগ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে। সাফাই দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা আমার নেই, ভাই। গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস, সময়ের সীমাবদ্ধতা আর পরিবেশ আবহের জটিলতার কারণে আন্তরিকতার দায়বদ্ধতায় কখনো কখনো ভাটা পড়ে যায়, ভাই। ক্ষমা করবেন। ওপারে উপরিসুখে ভালো থাকবেন। জানবেন ........

চলে যাওয়া মানে চলে যাওয়া নয়।

বরং আরো বেশি রয়ে যাওয়া,

অসীমের কাছে জড়িয়ে যাওয়া,

হৃদয়ের বাঁ পাশে আরও বেশি খনন হওয়া,

সমুদ্রের কাছে নিজেকে আপামর সঁপে যাওয়া,

মহত্ত্বের কাছে এক পৃথিবীর সমান বরাদ্দ রাখা,

পাহাড়ের কাছে এক আরোহনের অমৃত

উড়ান রেখে যাওয়া।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়