প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩তম বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডে বহুল প্রচলিত দৈনিক সম্পাদকের অনুরোধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার ৭২ বৎসর বয়সে স্মৃতির পাতার অংশ হতে কিছু অংশ বর্ণনা করছি।
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান, এমআইএস নং-০১১৩০০০৪০৭৮, ভারতীয় তালিকা নম্বর-৩৪৪৫৮, বেসামরিক গেজেট নং-৯২৫, মুক্তিবার্তা নং-০২০৫০৩০৪১৫, পিতা হাফেজ আঃ মতিন, মাতা আনোয়ারা বেগম, গ্রাম : বেলঘর, ডাকঘর বলিয়া, থানা হাজীগঞ্জ, জেলা চাঁদপুর।
আমরা ৭ ভাই ও ৩ বোন, আমি ছিলাম সংসারের সবার বড়। বাবা মসজিদের পেশ ইমাম হিসেবে কর্মরত ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সামান্য ক’টাকা বেতনে ইমামতি করতেন। এতে বাবার পক্ষে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল। সংসারের বিভিন্ন অভাব অনটনের কারণে ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে কাজের সন্ধানে আমি পাড়ি দিই সুদূর রংপুর এলাকা। এটি হল রংপুরের সৈয়দপুর। যেহেতু লেখাপড়া কম ছিল তাই ছোট একটা চাকুরি করতাম সৈয়দপুর পাওয়ার হাউজে মাস্টার রুলে পারমানেন্ট হতে পারিনি। পরে চলে গেলাম রেলওয়েতে। সেখানে আমাদের বাঙালিরা মাস্টার রুলে কাজ করতাম। মোটামুটি কিছু আয় রোজগার করতাম।
২৫ মার্চ ১৯৭১ দেশে যুদ্ধ শুরুর সময় আমি বাঙালি সেনাদের সাথে কয়েকদিন ছিলাম। পরে সবাই ইন্ডিয়ায় চলে যায়। আমি পায়ে হেঁটে চলে গেলাম দিনাজপুরের রানি শংকর বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়ায়। ভারতের আসাম রাজ্যের পকিরা গ্রামে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিলাম। সেখান থেকে এপ্রিল ১৯৭১-এর শেষ দিকে দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে ট্রেনিং নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। সে মোতাবেক মে হতে জুলাই ৭১ পর্যন্ত ৩ মাস ভারতের শিলিগুড়ি ক্যান্টনম্যান্টে ট্রেনিং করি। যুদ্ধকালীন আমার সাথে দেখা হয় আমার এলাকায় যে কজনের নাম মনে পড়ে উল্লেখযোগ্য কজন হলেন-১। আমিন গাজী (বর্তমানে মৃত)- হাটিলা, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর। ২। ইদ্রিস (ইছাপুরা), বর্তমানে শাহরান্তি তাহার স্থায়ী ঠিকানা।
দীর্ঘ ৩ মাস ট্রেনিং শেষে আমাদের কুচকাওয়াজের সালাম নেন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব এবং কর্নেল এম. এ. জি ওসমানী। আমাদের ব্যাচে বঙ্গবন্ধুর ছেলে জামাল (বা) কামাল ট্রেনিং করেছিল। কুচকাওয়াজের দিন আমাদের সাথে পরিচয় হয়। ট্রেনিং-এর পরে আগস্ট ৭১-এর কোনো এক সময় আমাদেরকে পাঠানো হয় রংপুরে লালমনিরহাট সেখানে বড়খাদা ডিফেন্সে আমরা যোগদান করি। আমাদের যুদ্ধের স্থান ছিল কাউনিয়া, হাতিবান্ধা কলেজ, রংপুর, লালমনিরহাট, তিস্তার পাড়সহ অনেক জায়গা।
আমার ৬নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার স্যার, কোম্পানী কমান্ডার- আফতাবউদ্দিন সুবেদার (BDR), প্লাটুন কমান্ডার-তাহের উদ্দিন (Army), সেকশন কমান্ডার-মুখলেছুর রহমান (RRF পুলিশ, হাবিলদার), যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ যোদ্ধা ছিলেন সেনা, বিডিআর, পুলিশ। তার মধ্যে ১ জন সহযোদ্ধা দিলেন Armতে কর্মরত মফিজুর রহমান (তিনি বর্তমানে জীবিত)। তিনি আমার সাথে শিলিগুড়িতে ট্রেনিং এ অবশ্য ছিলেন না। কিন্তু আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছি।
সর্বশেষ আনুমানিক ১ বা ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমরা Advance to Contact from বড়খাদা ডিফেন্স রংপুরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকি। সেখানে আমাদের বহু লোক শহিদ হয়। সেখানে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে শেষ অবধি উক্ত এলাকাকে স্বাধীন করি।
ওই সময় হাতিবান্দা কলেজ attackটা ছিল আমার নিকট অনেক লোমহর্ষক এবং মারাত্মক। ১৭টি কোম্পানীর মধ্যে আমি ছিলাম Habib D কোম্পানীর যোদ্ধা। আমরাই শুধু (৪) কোম্পানী তিন মাসের সেনা ট্রেনিং করেছিলাম। আমাদের এই ৪ কোম্পানী কর্নেল ওসমানি সাহেব সেনা সদস্য হিসাবে যোগদান করেছিলেন তখন এই কথাটা আমরা জানতাম না- যুদ্ধকালীন আমরা কয়েক মাসের বেতনও পাইয়াছি। যুদ্ধ শেষে সবাই রংপুর ক্যান্টনমেন্টে উঠলাম। আমাদের ২০ দিনের ছুটি দিল। ছুটি শেষে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে হাজির হলাম। তখন দেখি আমাদের কিছু যোদ্ধা পুলিশে যোগদান করছে। তখন আমিও যোগদান করলাম। রংপুর পুলিশ লাইনে যোগ দিই। ১৯৭২ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখ থেকে ২০০২ খ্রিঃ তারিখ পর্যন্ত চাকরি করি।
যুদ্ধশেষে ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ হতে ২০০২ সাল পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের সদস্য হিসেবে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করি। বর্তমানে আমার স্ত্রী, তিন পুত্র, তিন কন্যা ও নাতি নাতনিসহ হাজীগঞ্জ থানার বেলঘর গ্রামে বাস করছি। বর্তমানে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করে আসছি। আমার বড় ছেলে কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক, পুত্রবধূও কলেজের একজন প্রভাষক, দ্বিতীয় ছেলে ঢাকাতে পুলিশ সদস্য হিসেবে কর্মরত, আরেক ছেলে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত, দুই মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে মাস্টার্স শেষ করে চাকুরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের অংশ হিসেবে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন উন্নয়নের পাশাপাশি আমার মত স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, মৃত মুক্তিযোদ্ধা ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ারিশগণকে এবং আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে চিরকৃতজ্ঞ করেছেন।
পরিশেষে এদেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল হতে অদ্যাবধি শহিদগণের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি, সকল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের পরিবারের প্রজন্মবৃন্দের সুন্দর ভবিষ্যত কামনায় বিদায় নিচ্ছি। আমার অজান্তে কোনো ভুল হয়ে থাকলে কেউ ভুল বুঝবেন না। বাকি জীবন যেন দেশসেবায় এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতা রক্ষাকারী বীর পুরুষদের কাতারে থাকতে পারি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা।