প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম পাটোয়ারী হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব রাজারগাঁও পাটোয়ারী বাড়ির মৃত মোঃ ওয়ারিশ পাটোয়ারীর সন্তান। সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১ কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তেজোদ্দীপ্ত এই যুবক ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে এসে বেশ ক’টি যুদ্ধে অংশ নেন। একাধারে তিনি গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। মহামায়ার জমজমিয়া ব্রীজ আক্রমণ, গোগরার যুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ফুলছোঁয়ার যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশনের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এই বীর। হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ও চাঁদপুর সদর উপজেলার যেখান থেকে খবর এসেছে সেখানেই গেছেন, যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আয়োজন ‘ বিজয়ের মাস ডিসেম্বর : কেমন আছেন মুক্তিযোদ্ধাগণ’ আজকের পর্বে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ফুলছোঁয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন আসিফ নেওয়াজ মুক্তিবাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে মারা যায়। আসিফের দল পরে ফুলছোঁয়ায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদরেকে হাঁটিয়ে চাঁদপুর শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়াও তিনি যা যা বলেছেন, তার একাংশ চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
চাঁদপুর কণ্ঠ : বছর ঘুরে আবার আসলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আপনার অনুভূতি কেমন?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : মহান মুক্তিযুদ্ধের ৭১-এর গৌরবদীপ্ত ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস, বিজয়ী জাতি বাঙালির ইতিহাস। পাকবাহিনীকে হটিয়ে বিজয়ী হওয়া অবশ্যই ভিন্ন এক অনুভূতি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সার্বিকভাবে আপনি কেমন আছেন?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দেশ বাংলাদেশ। এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও তাদের সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে অবজ্ঞার শিকার। ’৭১-এর রণাঙ্গনের যোদ্ধা হিসেবে কি আর ভালো থাকতে পারি?
চাঁদপুর কণ্ঠ : ৫২ বছর পূর্বের মুক্তিযুদ্ধের কোন্ স্মৃতি আপনার মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিট থেকে ৮ডিসেস্বর ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন যুদ্ধে অংশ নেই। তারপরেই ১০ ডিসেম্বর চাঁদপুরে থেকে খবর পাই হাজীগঞ্জের কালচোঁ দক্ষিণ ইউনিয়নের নওহাটা দিয়ে পশ্চিম দিকে পাঞ্জাবী আর্মির দল আসছে। আমরা তাৎক্ষণিক চাঁদপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ফুলছোঁয়া মোল্লা বাড়ি সংলগ্ন নাপিত বাড়ির সামনে এসে অ্যাম্বুস করি। সকাল ৮টা থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এখানে থেমে থেমে পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। এক প্লাটুন মুক্তিবাহিনী নিয়ে কমান্ডার আবুল খায়ের তফদার ও তার সহকারী হিসেবে আমরা আবুল কালাম পাটোয়ারী, শুক্কুরুল আলম, সামছ্লু আলম, শহীদুল্লা বকাউল, জয়নাল আবেদিন, এমদাদ পাটোয়ারী, জাহাঙ্গীর পাটোয়ারী, মুখলেস মুন্সীসহ আরো অনেকে অংশ নেই। এরপরেই মিত্রবাহিনীর দল চাঁদপুর থেকে আসলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ফুলছোঁয়ায় থাকা সকল পাকিস্তানি আর্মি আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদেরকে বাকিলাবাজারে এনে বাকিলা বাজার থেকে হাঁটিয়ে চাঁদপুরের নিয়ে যাওয়া হয়। ফুলছোঁয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাপ্টেন আসিফ নেওয়াজ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। একই ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর ১৩/১৪ জন সৈনিক আহত হয়। ফুলছোঁয়ার যুদ্ধে সুবেদার জহিরুল হক পাঠান মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাঠিয়েছিলেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অনেক রক্তে অর্জিত প্রিয় স্বাধীন দেশের বর্তমান অবস্থায় আপনি কতোটুকু সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে, ৩০ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে চলছেই। তারা এসব করে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে আঘাত হানে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই মানুষের জন্ম/মৃত্যু। মাফ করবেন, তবুও জানার ইচ্ছা, আপনি আর কতোদিন বাঁচতে চান?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : প্রত্যাশা বলা যায়, প্রাপ্তি বলা সুন্দর, তবে বাঙালি কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে বলবো, মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ করেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর মতো আমিও প্রত্যাশা করছি, দক্ষিণ এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা, বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্সে যেভাবে বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক এবং শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ৭১-এর তেজোদ্দীপ্ত বীরত্ব গাঁথা ইতিহাসের অংশীদার হিসেবে আমিও চাইবো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ মানুষরা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সন্তানদের পরবর্তী প্রজন্ম ৭১-এর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলুক। অমর হোক আমার দেশ, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমান বা পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আপনি কী কথা রেখে যেতে চান?
আবুল কালাম পাটোয়ারী : যদি সম্ভব হয়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পরের প্রজন্ম হৃদয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জাগানিয়া স্মৃতির আলোকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় অবশ্যই সম্ভব হবে, প্রত্যাশা করতে পারি।