প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ছানাউল্লাহ খান। চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বালিয়া গ্রামের হাজী গুলজার খান বাড়ির মৃত হাজী তবিবউল্লাহ খান ও মাহফুজা খাতুন দম্পতির সন্তান। তিনি ৩ ছেলে, ৩ মেয়ের জনক। দুই ছেলে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত। আরেকজন বেসরকারি চাকুরিজীবী। মেয়েদের সবাই স্বামীর সংসারে। প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মারা যাওয়ার পর চাঁদপুর সাঁতার পরিষদের প্রশিক্ষক শাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন।
ছানাউল্লাহ খান ১৯৭১ সালে ২নং সেক্টরে চাঁদপুর এবং হাইমচরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) মুজিব বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শহীদ উল্লাহ জাবেদের নেতৃত্বাধীন টিম চাঁদপুর দক্ষিণ এলাকায় আসলে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে তিনিও ভারত থেকে ট্রেনিং নেন। শহীদ জাবেদ ফরিদগঞ্জ টুবগীতে যুদ্ধে মারা গেলে তার দায়িত্বভার তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি সৈয়দ আবেদ মুনছুরের ওপর অর্পিত হয়। তার নেতৃত্বে গাজীপুর বাখরপুর মজুমদার বাড়ির যুদ্ধে শহীদ মেজর নূর মোহাম্মদ গাজীসহ তিনজন শহীদ হন। বলাখাল হরিসভা মন্দির বাড়ি এলাকায় ক্যাপ্টেন জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে এমএফ, বিএলএফ ও এফএফে তিন বাহিনীর যৌথ যুদ্ধ হয়। সেখানেও ছিলেন ছানাউল্লাহ খান। এখান থেকে প্রায় ৪০ জন রাজাকার-আলবদরকে ধরে নিয়ে খোদাই বিলের কাছে এক বাড়িতে রাখা হয় এবং তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। সেখানে বিএলএফ মুনছুর বাহিনীর নেতৃত্বে এমদাদ হোসেন পাটওয়ারী, মোস্তাফিজুর রহমান, শফিকুর রহমান খান, রাজ্জাকুল হায়দার শিমু খানও ছিলেন। সে সময় ছানাউল্লাহ খানের বয়স ১৯-২০ বছর। তিনি চাঁদপুর কলেজের ইন্টারমিডিয়েট বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আয়োজন ‘বিজয়ের মাস ডিসেম্বর : কেমন আছেন মুক্তিযোদ্ধাগণ’ আজকের পর্বে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছানাউল্লাহ খান। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যাবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বছর ঘুরে আবার আসলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আপনার অনুভূতি কেমন?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : এই মাসটি আসলে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি মনে পড়ে। ১৯৭১ সালের এ মাসেই অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যুদ্ধের ময়দানে পাক-হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে অর্জিত এ বিজয় ছিলো আমাদের জন্য আনন্দ ও গৌরবের। একই সঙ্গে ছিলো সহযোদ্ধাদের হারানোর শোক।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সার্বিকভাবে আপনি কেমন আছেন?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ৫২ বছর পূর্বের মুক্তিযুদ্ধের কোন্ স্মৃতি আপনার মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমিও তো মরতে পারতাম। শহীদ জাবেদ পাক-হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে টুবগীতে মারা যান। ৩ এপ্রিল যুদ্ধের জন্যে বোমা বানাতে গিয়ে চাঁদপুরের ৪ জন কালামণ্ডখালেক-সুশীল-শংকর শহিদ হন। নতুনবাজার পোদ্দার বাড়িতে তারা শত্রু মোকাবেলায় বোমা বানাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের নিহত হওয়ার স্মৃতি চোখের সামনে ভাসে। এছাড়া আমার গ্রামের বাড়ি বালিয়া বাজারের পুলের উপরে চাঁদপুর থেকে ধরে আনা ১১ জন রাজাকার-আলবদরকে আবু তাহের, হোসেন ও আমি গ্রেনেড সার্চ করে মেরে ফেলি, যা স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অনেক রক্তে অর্জিত প্রিয় স্বাধীন দেশের বর্তমান অবস্থায় আপনি কতোটুকু সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : দেশ সুন্দরভাবে চলছে, কেউ না খেয়ে থাকে না। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকায় মেট্রোরেলসহ আরো কত উন্নয়ন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সরকার ডিজিটাল স্মার্টকার্ড ও সনদ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বিশ্বে দেশের সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন, যাতে আমরা খুশি এবং সন্তুষ্ট।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই মানুষের জন্ম/মৃত্যু। মাফ করবেন, তবুও জানার ইচ্ছা, আপনি আর কতোদিন বাঁচতে চান?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : আল্লাহ তার মেহেরবানীতে যতোদিন বাঁচিয়ে রাখেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমান বা পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আপনি কী কথা রেখে যেতে চান?
মোঃ ছানাউল্লাহ খান : আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, মোঃ ছানাউল্লাহ খান দেশ স্বাধীনের পৈত্রিকভাবে পুস্তক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। চাঁদপুর শহরের তাজমহল লাইব্রেরি তাদের। দশ বছর প্রবাসে ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি চাঁদপুরের একজন প্রখ্যাত সাঁতারু। বর্তমানে তার বয়স ৭২ বছর। এখন চাঁদপুর অরুণ নন্দী সুইমিংপুলে চাঁদপুর সাঁতার পরিষদের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সময় কেটে যাচ্ছে তার। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়েই চাঁদপুর শহরে বসবাস করছেন।