প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বাঙালির সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সোনালি দিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দিনটি ছিল বাঙালির বাঁধনহারা উল্লাসের দিন। ’৭১-এর ২৬ মার্চ ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে, ১৬ ডিসেম্বর ‘এক নদী রক্তের বিনিময়ে’ দেশকে হানাদারমুক্ত করে অর্জিত হয়েছিল এক যুগান্তকারী বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল জাতির জীবনে। মনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের আশায় উদ্বেলিত হয়েছিল দেশবাসী। স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর থাকা সত্ত্বেও সমগ্র জাতি হয়ে উঠেছিল বিজয় আনন্দে আত্মহারা।
আজ সেই বিজয় দিবস। জাতির ইতিহাসে সে দিন অর্জন হিসেবে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। শুধু এটুকুই নয়, সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির ভিত্তিতে জাতির নবযাত্রার বাস্তব সম্ভাবনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু ইতিহাসকে এই এক কথায় বেঁধে দিলে সত্যের কার্পণ্য প্রকাশ পায়। এই লড়াইতে বিভিন্ন সময়ে ও মাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিব ছাড়াও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বামপন্থী কতিপয় নেতা। তারও আগে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য আত্মবলিদান করেছেন মাস্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুদিরামসহ অগণিত বীর। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বামপন্থী দলসহ অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ও সময়ে তাদের মধ্যে কারও কারও একটি মূল, নেতৃত্বমূলক ও অগ্রগণ্য ভূমিকাও ছিল। এসব হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমোচনীয় অংশ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল নয় মাসের একটি সামরিক অভিযান ছিল না, তা ছিল শতাব্দীকাল ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং দুই যুগ ধরে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের সামগ্রিক ইতিবাচক উপাদানসমূহের লব্দি বা নির্যাস, তার শীর্ষ অধ্যায়। তাই এই সমগ্র কালপর্বের গণসংগ্রাম হলো আমাদের মুক্তিসংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধের এই সার্বিক বিস্তৃিতকালের সূচনালগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত এ দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি নানাভাবে অবদান রেখেছে।
‘মুক্তিযুদ্ধ’ যে প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল তার নিরিখে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব করলে রাজনৈতিক সচেতন মহলের কথায় বলতে হয়, ৫১ বছর আগে জাতির সামনে যে স্বপ্ন-সুযোগ-সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছিল সেই তুলনায় আমরা কী পেলাম? তা হিসাব করলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেই সময়কার অর্জনগুলোকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। সেগুলোর সিংহভাগই আজ হাতছাড়া হয়ে গেছে। বস্তুত একাত্তরে আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে বিজয় ধরে রাখতে পারিনি।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কেবল ভৌগোলিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ‘ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয়’ এই মতবাদকে ভিত্তি করে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত পৃথক দুটি অঞ্চল নিয়ে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের অনুরূপে একটি স্বাধীন ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করা মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল না। পাকিস্তানকে দুটুকরো করার কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন করাটা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের ‘মানচিত্র ও মতবাদ’কে নেতিকরণের একটি আন্দোলন-লড়াই। তা ছিল পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদ পরিচালিত জাতিগত শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’-এর ধারায় পরিচালিত একটি লড়াই। পাশাপাশি লড়াইটা ছিল শ্রেণীগত-শোষণ ও শ্রেণি-বৈষম্যের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য গণমানুষের লড়াই। বলতে গেলে এটি ছিল একটি জনযুদ্ধ।
স্বাধীন দেশ সম্পর্কে জনগণের প্রত্যাশা ও স্বপ্নগুলো হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিলে তিলে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে সেসব স্বপ্ন সুস্পষ্ট অবয়ব পেয়েছিল। ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের ১১-দফাসহ ধারাবাহিক গণসংগ্রামকে উচ্চকিত গণদাবির ভিতর দিয়ে তা নির্দিষ্ট মূর্ত-রূপ পেয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম পাকিস্তানের সব প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে আমাদের নতুন এই দেশটি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। ধর্মণ্ডবর্ণ-জেন্ডার-বংশ, ধনী-গরীব ইত্যাদি নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে। মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকবে না। শ্রেণি-বৈষম্য থাকবে না। দেশ পরিচালিত হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন ধারায়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর হবে। প্রতিটি মানুষের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তাসহ মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এসবই ছিল আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার স্বপ্ন।
আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণের পথে গোড়াতেই আসে বাধা। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার পরাজিত দুশমনদের অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগের শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতার কারণেও সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা। এ সমস্যা দূরীকরণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীচরিত্র সম্পন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল অক্ষম। এদিকে সা¤্রাজ্যবাদ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীরা সেই সুযোগে তৎপর হয়ে উঠে। এরকম একটি দুর্বল বা ঘোলাটে পরিস্থিতিতে ’৭৫ সালে ঘটে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। দেশের চরিত্রকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিচ্যুত করে আনা হয় পাকিস্তানি ধারায়। দেশকে আটকে ফেলা হয় সা¤্রাজ্যবাদ নির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দুষ্টচক্রে। গড়ে উঠে একটি নব্য লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী। অপরদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদদ দিয়ে রাজনৈতিক মাঠে নামার সুযোগ করে দেয়া হয়।
প্রখর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ’৯০-এ অবসান হয় অসাংবিধানিক সামরিক শাসনের পর্যায়ক্রমিক পর্ব। দেশ আবার নির্বাচিত সরকারের ধারায় ফিরে আসে। কিন্তু এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত তিন জোটের রূপরেখায় স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা ফিরিয়ে আনা হয়নি। দেশে অব্যাহত থেকেছে পঁচাত্তর-পরবর্তী মুশতাক-জিয়া-এরশাদ প্রবর্তিত ধারা। খালেদা জিয়ার শাসনামলে তো বটেই, এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসন পর্বেও মৌলিকভাবে একই ধারা বজায় রাখা হয়েছে। ফলে আদৌ আমরা মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার ধারা বিরোধী শক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারি। আর পারি বলেই ‘বাজার অর্থনীতি’ ‘বাজার রাজনীতির’ জন্ম দিয়েছে। রাজনীতিতে বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়ন প্রবল হয়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় মানুষ অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়েছে। ফলে আয়-বৈষম্য বেড়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে। শোষণ ও শাসন বেড়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে স্বপ্ন বা আশা ’৭১ সালে ছিল, সেটা ক্রমাগত কমেছে। আমাদের আশা ছিল দেশ সমাজতান্ত্রিক পথে এগোবে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে উল্টো পথে এগোচ্ছে।
‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’ অর্থাৎ আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বাঙালির বাঁধনহারা উল্লাসের দিন হলেও এ কথা ঠিক, আমাদের অনেক অর্জনই আমরা আজ হারিয়ে বসে আছি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রবাহ শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আজও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে না। নতুন প্রজন্মের মাঝেও সেই চেতনার স্ফূরণ দেখা যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নিয়ে আমরা আশাবাদী। সেটা কেবল ব্যক্তিগত আদর্শিক স্বভাবের কারণে নয়, এ কারণেও যে সমাজ পরিবর্তনের বস্তুগত শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে, মানুষ কেবল যে শোষিত ও অসন্তুষ্ট তা নয়, অধিকাংশ মানুষই বিদ্যমান রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থার বিপক্ষে, নতুন ব্যবস্থার পক্ষে।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা, সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।