রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

এমন স্কুল শিক্ষক সত্যিই শ্রদ্ধেয়
অনলাইন ডেস্ক

হালে আমাদের শিক্ষকদের অধিকাংশের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের আদর্শ খুব কমই চোখে পড়ে। শিক্ষক কেনো, যে কোনো পেশার লোকজনই যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক বিষয়। অধিকাংশ শিক্ষকের কর্মস্থলে বাসা থাকে না। তারা দূরবর্তী কিংবা নিকটবর্তী স্থানের ভাড়া-বাসা বা নিজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা তথা চাকুরি করেন। আবার কেউ কর্মস্থলে অবস্থান করলেও ব্যাচে প্রাইভেট পড়ানো কিংবা বাসা-বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করার কারণে পরিবারে সময় দিতে পারেন না, সমাজের জন্যে, নিজের জন্যে ব্যতিক্রম কিছু করতে পারেন না। অনেকে রাজনীতি বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ততা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মগ্নতা কিংবা আড্ডাবাজি বা অন্য ভালো-খারাপ অভ্যাসের কারণে শিক্ষকতার কাজেও যথাযথভাবে মনোযোগী হতে পারেন না। এমন বাস্তবতাতেও অনেক শিক্ষক ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে কিছু করে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং স্বীয় শিক্ষার্থীদের বাইরেও সাধারণ্যে অনেক শ্রদ্ধেয় হয়ে যান। এদের একজন জাকির হোসেন তালুকদার। তাঁকে নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠের ‘কৃষিকণ্ঠে’ প্রতিবেদন লিখা হয়েছে গতকাল রোববার।

‘স্কুল শিক্ষকের বিষমুক্ত সবজি বাগান ॥ প্রতিদিনই বিক্রি করেন ১ হাজার টাকার সবজি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখা হয়েছে, ৩০ শতাংশ জমির ওপর নানান রকমের সবজি বাগান। গাছের ডালে দুলছে বেগুন। ডগায় ডগায় কচি লাউ আর চাল কুমড়া। থরে থরে ডাঁটা, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ নানান সবজি। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, সবজিগুলোর ভারে যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়বে গাছের ডাল। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই উৎপাদন হচ্ছে এসব সবজি। বাজারে নিতে হয় না। বাড়িতে এসে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান কিনে। সুস্বাদু ও বিষমুক্ত হওয়ায় এ সবজির চাহিদাও অনেক। তিনি প্রতিদিনই বিক্রি করেন ১হাজার টাকার সবজি। বলছি একজন শিক্ষকের সবজি বাগানের কথা। যিনি মহান শিক্ষকতার পাশাপাশি ধরে রেখেছেন মাটির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তবে এখনও আগলে রেখেছেন পূর্বপুরুষের পেশাকে। নিজের হাতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করেন। ছাত্রদের তিনি শেখান, নিজের শিকড় ভুলতে নেই, পূর্বপুরুষের পেশাকে অশ্রদ্ধা করতে নেই। মা আর দেশের মাটির চেয়ে খাঁটি কিছু নেই। কৃষিপ্রাণ এই মানুষটির নাম মোঃ জাকির হোসেন তালুকদার। তিনি চাঁদপুর সদর উপজেলার পশ্চিম সকদি দারোগা বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি জানান, তার দাদা, বাবা, জেঠা, চাচারা সবাই নিজ কর্মের পাশাপাশি কৃষিকাজেও জড়িত ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই শিখেছেন, মাটিকে ভালোবাসলে মাটি তার প্রতিদান দেয়। তাই তো মাঠে কাজ করতে কোনো দ্বিধা নেই তার। বরং নিজ হাতে উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি অন্যের ঘরে পৌঁছাতে পারলেই যেন তার তৃপ্তি। আর এতে প্রতিদিন ১০০০ টাকার সবজি বিক্রি না করলে তার মন ভালো লাগে না। তার বাজারে যেতে হয় না। লোকেরা তার বাড়ি থেকেই নিয়ে যায় সবজি।

শিক্ষক জাকির হোসেন তালুকদার প্রতিবছরের মতো এবারও নিজ উদ্যোগে সদর উপজেলার সকদি গ্রামের পূর্ব পল্লীতে সবজি চাষ করেছেন। তিনি এবার ৩০ শতক ফসলি জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকার মতো। ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। পুরো জমিতে সবজি আছে এখনও। খরচের টাকা বাদে লাখ খানেক টাকা আয় হওয়ার আশা তার। সবজি চাষে সঙ্গ দেন ওই এলাকার কৃষক-শ্রমিক। সবজিতে নিজ পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার বাড়িতে এই সবজি পাঠানো হয়। আবার জমিতে এসেও যে যার মতো সবজি কিনে নিয়ে যান। কোনো ধরনের রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার হয় না বলে সবজিগুলো খেতেও অনেক সুস্বাদু। তিনি বলেন, আমি ফজরের নামাজ পড়ে ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এবং বিকেলে আসর নামাজের পর থেকে মাগরিব নামাজের আগ পর্যন্ত জমিতে সময় দেই। জমিতে কী লাগবে, কোন্ গাছের কী অবস্থা, কী করতে হবে, তা করে নেই। পরে স্কুলে চলে যাই। আবার স্কুল থেকে এসে জমিতে কাজ করি। কৃষি কাজের পাশাপাশি মৎস্য চাষ, পশুপাখি পালনেও সময় ব্যয় করি।

চাঁদপুর সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মোঃ খায়রুল বাশার বলেন, চাঁদপুর সদরের বেশ ক'টি ইউনিয়নের কৃষকরা শীতকালীন সবজি চাষে মাঠে প্রান্তরে অনেক সময় ব্যয় করেন। জমির পরিচর্যার পাশাপাশি বীজতলা তৈরি, চারা উৎপাদন, রোপণের বিষয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন তালুকদারের সবজি চাষের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী। বিষমুক্ত সবজি বাগান করে সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর মতো আমাদের সবারই নিজ নিজ আঙ্গিনায় সবজি বাগান করা উচিত। শিক্ষকতার পাশাপাশি জাকির সাহেব কৃষি কাজেও একজন আদর্শ কৃষকের পরিচয় দিয়েছেন।

বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে স্কুল শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন তালুকদার নিজেকে নিয়োজিত রেখে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের দেশ, মাটি, মা ও জীবন সম্পর্কে যে শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটি এই সমাজে শিক্ষক কেনো, অন্য পেশার লোকজনও খুব কম করে। এতে তিনি সমাজের চোখে একজন সাধারণ মানের শিক্ষক নন, নিঃসন্দেহে একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। শুধু চাকুরির পেছনে না ঘুরে কিংবা চাকুরি করেও নিজের/ পৈত্রিক/ইজারাকৃত জমিতে যদি কেউ সদিচ্ছা লালন করে বিষমুক্ত সবজি চাষ করে, ফলদ/অফলদ গাছ লাগায়, জলাশয়ে মাছ চাষ করে, তাহলে তাতে নিজের যেমন লাভ হয়, তেমনি ভোক্তা জনগণেরও অনেক লাভ হয়--এটি জাকির হোসেন তালুকদারের মতো শিক্ষকের কাছ থেকে শেখার রয়েছে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে তাঁর সাফল্যটা আমরা পত্রিকায় ছেপেছি, এটি কিংবা অন্য কারো এমন সাফল্য যদি কৃষি বিভাগ তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় প্রচারের ব্যবস্থা করে, তাহলে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবে, আর শখে কিংবা পেশার প্রয়োজনে আদর্শ কৃষক হবার চেষ্টা করবে। বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজে আদর্শ শিক্ষকের যেমন অভাব, আদর্শ কৃষকেরও কিন্তু কম-বেশি অভাব রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়