শনিবার, ০৫ জুলাই, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৮

সাক্ষাৎকার : আশিক বিন রহিম

কবিতায় মূলত আমি মানুষকে প্রকাশ করি

অনলাইন ডেস্ক
কবিতায় মূলত আমি মানুষকে প্রকাশ করি

আশিক বিন রহিমে জন্ম ১৯৮৬ সালে, চাঁদপুরের পুরাণবাজারে। প্রায় দেড়যুগ ধরে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, অনলাইন জার্নাল ও ছোটকাগজে নিয়মিত লিখছেন। সম্পাদনা করছেন কবিতার কাগজ ‘তরী’। চাঁদপুরের শিল্প-ও সাহিত্যের সংগঠন ‘সাহিত্য মঞ্চ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুরের পরিচালক (গ্রন্থাগার, সেমিনার ও শিশুসাহিত্য)। সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে নিজের ভাবনাগুলো তুলে ধরেন।

আপনার ভেতরে কবিতা কীভাবে আসে? শব্দ কি আগে আসে, না অনুভব? আশিক বিন রহিম : যখন খুব বেশি আনন্দিত, ব্যথিত কিংবা ক্ষুব্ধ হইÑতখন আমার অন্তর আত্মার সাথে দেহ আত্মর কথোপকথন হয়। আমরা ক্ষাণিক নির্জনতা খুঁজি। তখন কল্পনার সেই নির্জন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে উঠে আসে কিছু শব্দ, অনুভূতি, কিছু পঙ্ক্তি। তাদের সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে কিংবা সুঁই-সুতোয় গেঁথে নিতে পারলেই কখনো কখনো একটি কবিতা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শব্দ না কি অনুভবÑকোনটি আগে আসে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।

আপনি যখন লেখেন, তখন লেখার মাধ্যমে আপনি কি নিজেকেই প্রকাশ করেন? আশিক বিন রহিম : আমি সবসময় অন্যের ব্যথা কিংবা আনন্দে নিজেকে উপলব্ধি করি। ধরুনÑ ফিলিস্তিনের যুদ্ধাহত একটি শিশুকে বুকে ধরে তার বাবা চিৎকার করছে; কিংবা সুখী কোন রাষ্ট্রের একজন তরুণ সমুদ্র পাড়ে তাঁবু যাপন করে চাঁদ দেখছে; আমি দুটি চরিত্রই নিজেকে উপলব্ধি করি। ফলে আমার উপলব্ধি থেকে জন্ম নেওয়া কবিতায় মূলত আমি মানুষকে প্রকাশ করি। নিজের ভেতরের সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করি।

আপনার প্রথম বইটি কবে হলো? বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন? আশিক বিন রহিম : আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মপ্রয়াণ’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি, এক কথায় প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার মতো। যে অনুভূতি শব্দে কিংবা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; যে অনুভূতি অনন্য-অন্যরকম। প্রথম বই হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ভিতর প্রবল উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা অনুভব করেছি৷ যা হাতে স্পর্শ করার পর নিজের সন্তানের মত অনাগত প্রতিটা শব্দের প্রতি যত্নশীল এবং দায়িত্বশীল হবার প্রেরণা জুগিয়েছে।

কবিতার জগতে কীভাবে পদার্পণ করলেন? আশিক বিন রহিম : ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আমার প্রগাঢ় প্রেম ছিল। ওই সময়টাতে সাহিত্যের ভালো বই সংগ্রহ করা কঠিন ছিল। হাতের কাছে যা পেতাম, তাই পড়তাম। তবে কবিতা এবং গল্প আমাকে বেশি টানতো। মাধ্যমিকে পড়ার শুরুতে কবিতা পড়া এবং লেখার প্রতি আমার প্রেমটা গাঢ় হতে থাকে। তখন জসীমউদ্দীনের কবর, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের মানুষ কবিতা আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।

এ পর্যন্ত কী কী বিষয়ে লিখেছেন? আশিক বিন রহিম : আমি মূলত গল্প এবং কবিতা লিখতে বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করি। সম্প্রতি লোকগবেষণা নিয়ে কাজ করছি। এ পর্যন্ত আমার একটি করে কবিতা ও ছোটগল্পের বই এবং দুটি লোকগবেষণার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত দুটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি তরী নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করছি।

একজন লেখক হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র্যের ছাপ কিভাবে রাখেন? আশিক বিন রহিম : সাহিত্যের বিশাল মহাকাশে নিজেকে ক্ষুদ্র আলোর কণা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলেও স্বতন্ত্র থাকা খুব জরুরি। আমরা বেতফল কিংবা গোবরেপোকা পড়লেই বুঝতে পারি এটা জীবনানন্দের কবিতা। লালসালুর কয়েকটি লাইন পড়লেই বুঝতে পারি, লেখার এই ধরনটা সৈয়দ অলিউল্লার নিজস্ব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আল মাহমুদ, কিংবা সৈয়দ শামসুল হক কিছু শব্দ, কিছু ধরন একান্ত নিজের করে গেছেন। এই স্বতন্ত্রতা না থাকলে সাহিত্যের বিশাল মহাকাশ থেকে কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন।

আমি সবসময় চেষ্টা করি নিজের কবিতা অথবা গল্পে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ থাকুক। এজন্য যতটা সম্ভব প্রচুর পড়বার চেষ্টা করি। এরপর নিজের লেখার ক্ষেত্রে অন্যের প্রভাব মুক্ত থাকা, লেখার বিষয়কে নিজের দৃষ্টিতে দেখা এবং প্রকাশে স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা রাখার চেষ্টা করি।

আপনি কি মনে করেন, সাহিত্য দিয়ে সমাজে কিছু বদলানো সম্ভব? আশিক বিন রহিম : আসলে সাহিত্য দিয়ে সমাজ বদলানো যায় না। বদলানো যায় মানুষের ভেতরকার মনুষ্যত্বকে। মানুষকে সত্য এবং সুন্দরের পথে জাগ্রত করা যায়, প্রভাবিত করা যায়। অসুন্দরগুলো মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরে তাদের নিরুৎসাহিত করা যায়। সমাজ যদি সুন্দর থাকে, তাকে বদদানোর কি প্রয়োজন...?। মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্বকে সুন্দরের পথে জাগ্রত রাখতে পারলে সমাজ সবসময় সুন্দর থাকে। আর এই কাজটি সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে সহজে করা সম্ভব।

লেখক জীবনে আপনার প্রাপ্তি/অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই। আশিক বিন রহিম : আমি সবসময় কম চাহিদাসম্পন্ন একজন মানুষ। এজন্য অপ্রাপ্তি কখনো আমাকে স্পর্শ করে না। আর তাই আমার ক্ষুদ্র লেখক জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ মিছিলটা অনেক দীর্ঘ। তরুণ বয়সে নিজের পাঁচটি বই প্রকাশিত হওয়া, অসংখ্য পুরস্কার অর্জন, একটি সাহিত্য সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগদানÑএ সবকিছুই আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো সমাজের উৎকৃষ্ট মানুষদের সংস্পর্শ পাওয়া। নিজেকে ভালো রাখতে, অসুন্দর মুক্ত থাকতে এবং জীবনকে উপভোগ করতে ভালো মানুষের সংস্পর্শ খুব জরুরি। যাদের দ্বারা সমাজ কিংবা মানুষকে ক্ষতি হয়নি। যাদের কাছে ফুল, পাখি, নদী, পাহাড় নিরাপদÑআমি সেইসব মানুষদের সংস্পর্শে থাকতে পারছি।

বর্তমানে কী নিয়ে লিখছেন? আশিক বিন রহিম : বর্তমানে ছোটগল্প এবং চাঁদপুর জেলার দুটি বিষয়ে লোকগবেষণা নিয়ে কাজ করছি। এর পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কবিতা লিখার চেষ্টা করছি। তবে কবিতা এবং গল্পগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে অনেক সময় নিবো।

ভবিষ্যতে লেখালেখি নিয়ে কী পরিকল্পনা রয়েছে? আশিক বিন রহিম : একটি উপন্যাস এবং কিছু মঞ্চনাটক লিখার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও বিষয় অনেকটাই নির্ধারণ করে ফেলেছি, তবে অনেক সময় নিয়ে গভীরভাবে কাজগুলো করতে চাই। যার জন্য নির্ধারিত বিষয় নিয়ে পড়া এবং জানার পাশাপাশি নিজেকেও ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি।

উল্লেখ্য, আশিক বিন রহিম সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, চতুরঙ্গ ইলিশ উৎসব পুরস্কার, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পুরস্কার, নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা, নতুনকুঁড়ি লেখক সম্মাননা। তিনি ২০১৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ : পদ্মপ্রয়াণ (কাব্য, ২০১৮), জাল ও জলের আখ্যান (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯), চাঁদপুরের চাঁদমুখ (লোকগবেষণা গ্রন্থ, ২০২০), সংগ্রামে অর্জনে চাঁদপুরে নারীগণ (লোকগবেষণা গ্রন্থ, ২০২৪), জলের কলতান (যৌথ কবিতাগ্রন্থ, ২০২৩)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়