রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

খরস্রোতা ডাকাতিয়া যেখানে ক্ষীণকায়া
অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদীর অন্যতম ডাকাতিয়া নদী। এটির দৈর্ঘ্য ১৪১ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৬৭ মিটার। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পশ্চিম ত্রিপুরা থেকে নদীটি উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলাকে বিধৌত করে দুটি ধারায় মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। সর্পিল আকারে প্রবহমান নদীটি তার বিভিন্ন বাঁকে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্যোতনা তৈরি করেছিল, তার সবটুকুন আর এখন পুরোপুরি বিদ্যমান নেই। এর কারণ হচ্ছে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বেড়িবাঁধ। প্রায় সাড়ে চার দশক পূর্বে এই বাঁধ নির্মাণে যথাযথ পরিবেশ প্রতিক্রিয়া যাচাই করা হয়নি। যার অনিবার্য করুণ পরিণতি হচ্ছে এককালের খরস্রোতা ডাকাতিয়া এখন ক্ষীণকায়া এক নদী। চাঁদপুর অংশে নদীটিকে যতোটা রূপে দেখা যায়, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর অংশে নদীটিকে সেইরূপে তো নয়ই, বরং মৃতরূপেই প্রতিভাত হয়। কারণ হচ্ছে, চাঁদপুর বড়ো স্টেশন সংলগ্ন মোহনা ও লক্ষ্মীপুর জেলার হাজীমারার অদূরবর্তী মোহনা থেকে অর্থাৎ দুটি মোহনা থেকে দেশের বিশাল নদী মেঘনার যে প্রবাহ আবহমান কাল থেকে ডাকাতিয়াকে করেছিলো উন্মত্ত, উত্তাল ও খরস্রোতা রূপে ঋদ্ধ, চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের বন্যা নিযন্ত্রণ বাঁধ ও দুটি পাম্প হাউজ এবং প্রকল্প অভ্যন্তরে নদী খনন না হওয়া, কচুরিপানার টেকসই রাজত্বে যথার্থ হানা না দেয়া, অবৈধ দখলদারিত্ব ও কৌশলী ভরাটে বাধা না দেয়ার কারণে ডাকাতিয়ার সেই রূপ হয়েছে মারাত্মক ব্যাহত।

‘ফরিদগঞ্জে কৌশলে ডাকাতিয়া ভরাট’ শিরোনামে চাঁদপুর কণ্ঠে গত সোমবার প্রবীর চক্রবর্তী যে সংবাদ পরিবেশন করেছেন, তাতে তিনি তুলে ধরেছেন ডাকাতিয়া নদীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির একটি খণ্ডিত চিত্র। তিনি লিখেছেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এককালের খরস্রোতা নদী ডাকাতিয়া সিআইপি বাঁধের কারণে নাব্যতা ও স্রোত দুটোই হারিয়েছে। নদীর পানি সেচের মাধ্যমে ইরি-বোরো আবাদ অদ্যাবধি চললেও ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। নদীর ওপর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ করে সেচের পানির প্রবাহকে আটকে দেয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজটি হচ্ছে ফরিদগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ব্রীজের নিচে ও দুই প্রান্তে ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট করার অপচেষ্টায়। বাজারের আবর্জনার সাথে গবাদি পশু জবাই করে রক্ত, মল ও নানা অংশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। এতে নদীর তলদেশ অনেকখানি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধনসহ ফসল উৎপাদনে সেচ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ব্রীজের নিচে নদীর দুই তীরের প্রায় অর্ধেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে।

এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদর ও বাজারের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ডাকাতিয়া নদীর শাখা প্রবাহিত। যা উন্মুক্ত জলাশয়। ফরিদগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ডাকাতিয়ার ওপর নির্মিত কেরোয়া ব্রীজ। এই ব্রীজের নিচে দুই তীরেই ময়লা ও ভারী আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর তলদেশ থেকে ৭/৮ ফুট ভরাট হয়ে গেছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। ব্রীজ ও তার দুই প্রান্তে দাঁড়ালে নিচে শুধু ময়লা-আবর্জনাই দেখা যায়। পানির দেখা মিলে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ব্রীজের পশ্চিমণ্ডউত্তর কোণে ডাকবাংলোর নিকট ১৯৮৯ সালে তৎকালীন এমপির নির্দেশে মাছ চাষের উদ্দেশ্যে নদীর দুই তীর থেকে মাটি ফেলে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর সে প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৬ সালে বদ্ধ জলাশয় উল্লেখ করে আবেদনের মাধ্যমে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে লীজ নিয়ে ফরিদগঞ্জ-কেরোয়া ব্রীজের নিচে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করা হয়। এতে উপজেলার পূর্বাঞ্চলে পানির প্রবাহ প্রায় বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ জীব বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। মৎস্যজীবীদের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে পড়ে। ওই সময়ে বামদলের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর হোসেন দুলালের নেতৃত্বে ‘ফরিদগঞ্জ মৎস্যজীবী সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন আন্দোলনে নামে। তারা উপজেলা, জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তৎকালীন নির্বাহী অফিসার আবদুন নূরের নির্দেশে অভিযোগের তদন্ত করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুনির চৌধুরী। তদন্তে ও রেকর্ডপত্রে জলাশয়টি নদীর প্রবহমান ধারায় যে উন্মুক্ত সেই প্রমাণ মিলে। এতে লীজ বাতিলের সুপারিশসহ রিপোর্ট পেশ করা হয়। রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার সরজমিন তদন্ত করেন এবং তিনি ডাকাতিয়ার শাখা ও ওই উন্মুক্ত জলাশয়ের লীজ বাতিলের সুপারিশ করলে লীজ বাতিল করা হয়। এরপর থেকে কৌশলে শুরু হয় ব্রীজের দুই তীর থেকে আবর্জনা ফেলে নদীর অস্তিত্ব বিলোপ করার কাজ। নদীর এই অংশের নাব্যতা অনেকটা কমে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে পানি প্রবাহ। সর্বশেষ ইরি-বোরো মৌসুমে ফরিদগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে সেচের পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে হয়ে যায় চৌচির। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকদের মাঝে হাহাকার দেখা দেয়ায় জেলা প্রশাসক, ইউএনও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তাদের নির্দেশে সিআইপির স্লুইচ গেইট দিয়ে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু এভাবে নদীতে কৃত্রিম বাঁধ ও কৌশলী ভরাটের অপচেষ্টা অব্যাহত থাকলে পানির প্রবাহ বাড়িয়েও কোনো কাজে আসবে না বলে অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত।

ডাকাতিয়াকে খরস্রোতা থেকে ক্ষীণকায়া ও মৃত করতে ফরিদগঞ্জের অনেক অপরিণামদর্শী মানুষের কাণ্ডে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ হওয়া ছাড়া সচেতন প্রতিটি মানুষের অন্য কোনো গতি আছে বলে আমাদের জানা নেই। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনকে হতে হবে সোচ্চার, হতে হবে নিরাপস এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে ডাকাতিয়াকে বাঁচাতে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণে হতে হবে সর্বোচ্চ তৎপর। এজন্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সহ সরকারের সর্বোচ্চ মহলে ধর্ণা দেয়া, তদবির চালানো, প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে কথা বলার বিষয়টি ভাবতে হবে। অন্যথায় ডাকাতিয়ার করুণ পরিণতিতে ফরিদগঞ্জের মৎস্যচাষ ও অধিক ফসল উৎপাদনের খ্যাতি সহ আরো অনেক খ্যাতিই হবে বিপন্ন। এই বিপন্নতার বিষয়টি যদি সময় থাকতে সচেতন ফরিদগঞ্জবাসীর কপালে ভাঁজ পড়ার মতো উদ্বিগ্নতা তৈরি করতে না পারে, তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে কেবল সেটা চোখ বুঁজে অনুধাবন করার প্রয়াস চালাবার জন্যে আমরা সকলের প্রতি অনুরোধ জানাতে চাই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়