রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

চিন্তার সংকীর্ণতা
অনলাইন ডেস্ক

পাড়ার সবচেয়ে শক্তিমান কুকুরটিকে ঘিরে বসে আছে একদল কুকুর। অলস গল্প হচ্ছে। একটি কুকুর বললো, ‘আচ্ছা, আপনার গায়ে এতো শক্তি; আমরা কোনোমতেই আপনার সঙ্গে দৌড়ে পারি না। কিন্তু একটা বিষয় বরাবর আমাকে অবাক করে!’

‘সেটা আবার কী?’

‘যখন মরা টাইপের কোনো শেয়াল এসে আমাদের গৃহস্থের মুরগি নিয়ে যায়, আপনি শত চেষ্টা করেও ওই মরা শেয়ালটাকে ধরতে পারেন না!’

‘শোনো, শেয়াল যখন মুরগি নিয়ে পালায় সে দৌড়ায় নিজেকে বাঁচাবার জন্যে; আর আমি দৌড়াই গৃহস্থের জন্যে। তাই দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তাকে ধরতে পারি না।’

লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন তার ‘বড় যদি হতে চাও’ গ্রন্থে তরুণ শিক্ষার্থীদের নিজেদের জীবনের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে বিখ্যাত লোকগল্পটি উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি আরও বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী চায় আমার পুত্র আমার মতো হোক। বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখি এর ব্যতিক্রম চিত্র। কেনো? খ্যাতিমান গুণিজন ও প্রতিষ্ঠিতদের মানিক পুত্রগণ দৌড়ায় বাবার জন্যে। আর শূন্য থেকে যারা উঠে আসে তারা দৌড়ায় নিজের জন্যে। সফলতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের পায়ে পড়েই চুমু খায়!’

আমরা বাস্তবে দেখি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা গ্রহণ করতে পারে না। যখন তারা নিজেদের জন্যে কোনো সিদ্ধান্তকে ভালো মনে করে গ্রহণ করে তখন সবার আগে পরিবার থেকে বাধা আসে। আর এই বাধা এতোটাই প্রবল, শেষপর্যন্ত পরিবার কিংবা মা-বাবার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিতে হয়। ছোটকাল থেকে শেখানো হয় না কীভাবে বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ফলে একটা সময় তারা চিন্তার দিক দিয়ে সংকীর্ণমনা হয়ে পড়ে। আবার বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত জোর করে নিজের ওপর প্রয়োগ করতে গিয়ে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আজীবন এই সমস্যাকে নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়াতে হয়।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা কেউই চায় না আমরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করি। তারা সবাই আমাদের ওপর একটা সুনির্দিষ্ট চিন্তাধারা চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের ধারণা, এতেই বোধহয় সার্বিক কল্যাণ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছোটবেলা থেকে চিন্তা না করতে করতে একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলি। ফলে যা দেখানো হয় তাই দেখি, যা বোঝানো হয় তাই বুঝেই সন্তুষ্ট চিত্তে দিন অতিবাহিত করি। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চার জায়গা। এখানে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং বিশ্বসভ্যতার প্রভূত উপকার সাধন সম্ভব। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। নতুন করে কোনো চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সৃষ্টিশীল মানুষ সেখান থেকে বের হতে পারছে না। কেউ যদি গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু করতে চায় তাহলে তার চিন্তাশক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়।

সাধারণ মানুষের ধারণা, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি তারা বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী এবং সৃজনশীল মানুষ। কিন্তু একথা বলতে আমার আপত্তি নেই, আমাদের জ্ঞান একজন কৃষক, শ্রমিক কিংবা জেলের চেয়েও কম। ধরে নিলাম, তাদের কাজ এবং আমাদের কাজ দুটো ভিন্ন বিষয়। তাহলে এবার আমাকে বলুন, তারা তো তাদের কাজটা ঠিকমতোই করছে এবং এই কাজ দ্বারা জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছে। জাতি গঠনে একজন কৃষকের অবদানের কথা তো কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের প্রতিটি শ্রমজীবী সম্প্রদায় তাদের কাজটা ঠিকমতো করছেন। কিন্তু আমরা যারা শিক্ষার্থী; নিজেদের সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলতে চাই, তারা কী কাজটা করছি? আমরা কি আদৌ অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি? আমার উত্তর হলো-একদমই না।

এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে। ফলে আমাদের কাছে তাদের কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। আমরা যদি দেশবাসীর সামনে নতুন কোনো তত্ত্ব কিংবা তথ্য উপস্থাপন করতে পারি, তাদের উপকারে লাগে এমন কিছু উদ্ভাবন করতে পারি তাহলে স্বভাবতই তারা খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা তাদের কী দিতে পেরেছি? চিন্তার জগতে এই যে বিরাট একটা শূন্যতা বিরাজ করছে এর ফলাফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে প্রথমেই আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তোমাকে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হতে হবে, তোমাকে শিক্ষক হতে হবে। আর ভালো রেজাল্ট করার সহজ তরিকা হল-শিক্ষকের দেওয়া নোট ফটোকপি করো এবং সেগুলো হুবহু পরীক্ষার খাতায় উগরে দাও। এখানে একজন শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা কোথায়? দু-একটি ডিপার্টমেন্টে হয়ত ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ জায়গাতেই একই চিত্র। আপনার সামনে একটা লক্ষ্য দিয়ে রেখে বলা হবে- তুমি দৌড়াও এবং ওই লক্ষ্যে পৌঁছাও। এভাবে আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হই।

সমাজে দ্রুত রূপান্তর ঘটে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ শতগুণে গতিশীল করে তুলেছে। যে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক সময় মনে হয়, একটার পর একটা লাগাতার ঘটনা ঘটে চলেছে। এভাবে যেমন নিত্যনতুন জ্ঞানের দরজা খুলে যাচ্ছে তেমনি অনেক সময় বুঝে উঠতে পারছি না কোন বিষয়টা বেশি দরকারি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের আজ জয়জয়কার। কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা খেয়াল করে দেখেছি, কোথাও যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে যায় এবং নতুন কোনো ঘটনা ঘটার আগপর্যন্ত আমরা সেটা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত থাকি। সংশ্লিষ্ট ঘটনাটা আমাদের জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয় কিংবা সেখান থেকে শিক্ষাটাই বা কী এটা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করি না। আবার একটি দল ঘটনার পক্ষে অপরটি বিপক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। ভার্চুয়াল জগতের এই আক্রমণকে আমরা অনেক সময় বাস্তব জগতেও টেনে আনতে দেখেছি।

কারও সমালোচনা করা অবৈধ নয়; যদি সেটা সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। তবে আমরা প্রায়শই অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে সমালোচনা করার পবিবর্তে আক্রমণ করে বসি। এতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে তিক্ততা। আরব দেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান আরিফী তার ঊহলড়ু ুড়ঁৎ ষরভব গ্রন্থে কারও সমালোচনা করার সহজ একটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। এতে সম্পর্কে কোনো তিক্ততা সৃষ্টি হয় না এবং যে ব্যক্তির সমালোচনা করা হচ্ছে তিনি সহজেই নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারেন। সকলেই জানি, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু ভালো দিক রয়েছে; সে যত খারাপ মানুষই হোক না কেন। ড. আরিফীর মতে, কারও কোনো মন্দ কাজের সমালোচনা করতে হলে প্রথমে তার ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করা উচিত। তারপর মন্দ কাজগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা উচিত। এতে যে কেউ তার ভুলগুলো সহজে উপলব্ধি করে খারাপ কাজ থেকে সরে আসতে পারে। আমি বাস্তব জীবনে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ভালো ফল পেয়েছি। কিন্তু সমস্যা হল, কোনো বিষয়কে গভীরভাবে দেখার পরিবর্তে আমরা একপেশে অবস্থান থেকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

শিক্ষা এখন নীতি-নৈতিকতাবিহীন। একটা বিষয়কে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হলে তার জন্য প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। এই শ্রম শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই দিতে হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কারোরই যে হাতে সময় নেই! অনেক সময় শিক্ষার্থীর সময় থাকলে সময় থাকে না শিক্ষকের। আবার শিক্ষকের সময় থাকলে সময় থাকে না শিক্ষার্থীর। এভাবে পরস্পরের মেলবন্ধন সম্পন্ন না হওয়ার ফলে শেষপর্যন্ত ফলাফল শূন্যই থেকে যায়। আমাদের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সময়টা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি কিংবা অন্য যে কোনো উপায়ে ব্যয় করে থাকে। এখানে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার মতো সময় কোথায়! বহুকাল ধরে চলে আসা এই সিস্টেম আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে শিক্ষককে ‘মহান’, ‘জাতির বিবেক’ বলে অভিহিত করে থাকি, তারাই নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে গবেষণাপত্র ছাপিয়ে নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন এবং পত্রিকার পাতায় এই লজ্জাজনক সংবাদ পাঠ করে শিউরে উঠছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালির মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।’

প্রকৃতপক্ষে অন্যের নিন্দা করার জন্য গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় না। ফলে এই কাজটা আমরা বেশ ভালোই পারি। একটি জাতি গভীর চিন্তাভাবনা ছাড়া শক্ত ভিতের ওপর এসে দাঁড়াতে পারে না কিছুতেই। কোনো একটা ঘটনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে হলে যে সময় ও শ্রম ব্যয় করা প্রয়োজন তা আমাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। ফলে চিন্তা, গবেষণা এবং দূরদর্শিতার ক্ষেত্রে অন্য সকল জাতি আমাদের পেছনে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা কেবলই গভীর খাদের দিকে এগিয়ে চলছি। এখন প্রয়োজন একটি গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের। আশার কথা হল, ধীরে ধীরে তরুণদের চোখ খুলতে শুরু করেছে। অল্প হলেও একটি ক্ষীণ আলোর রেখা উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। চিন্তাশীল মানুষ এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারলে একদিন নিশ্চয়ই সফলতার মুখ দেখতে পাবো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়