শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পাখিতীর্থ হাওরে

গাজী মুনছুর আজিজ
পাখিতীর্থ হাওরে

প্রতি বছর শীত এলে আমরা ছুটে যাই সিলেট অঞ্চলের হাওরের জলাভূমিতে। উদ্দেশ্য হাওরজলে পাখি শুমারি বা পর্যবেক্ষণ করা। এ পাখিগুলোকে আমরা বলি পরিযায়ী পাখি। শীত এলে এ পরিযায়ী পাখিদের আশি শতাংশ হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের দেশ ও বিশ শতাংশ সুদূর সাইবেরিয়াসহ মধ্য ও উত্তর এশিয়া থেকে আমাদের দেশে আসে। আবার শীত শেষে এরা যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যায়। এ পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশেরই পাখির তালিকাভুক্ত। আর বাংলাদেশে শীত মৌসুমে পরিযায়ীদের অন্যতম বসবাসের স্থান সিলেট অঞ্চলের হাওর।

বাংলাদেশে প্রায় ৭১৭ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে আবাসিক প্রজাতি প্রায় ৩৫০টি। আর পরিযায়ী প্রজাতি প্রায় ৩৬৭টি। যে পাখি সারাবছর দেশে থাকে তাদের বলা হয় আবাসিক। আর যে পাখি বছরের কিছু সময় অন্য দেশে থাকে তাদের বলা হয় পরিযায়ী। মূলত আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিযায়ী শীত মৌসুমে দেখা যায়। কিছু পরিযায়ী গ্রীষ্ম মৌসুমে এদেশে আসে। এদের সংখ্যা ১০ থেকে ১২টি। এছাড়া কয়েকটি পাখি বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশে আসে ও খানিক সময় থেকে চলে যায়। সেজন্য এদের বলা হয় পান্থ-পরিযায়ী।

আমাদের সব পাখি কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। কোনোটা বেশি দেখা যায়। কোনোটা কম দেখা যায়। কিছু আছে একেবারেই কম। অবশ্য বর্তমানে আমাদের দেশে ৭১৭ প্রজাতির পাখি দেখা যায় না। নানা কারণে এরই মধ্যে ৩০ বা ৩২টি পাখি হারিয়ে গেছে। আর কিছু আছে হারানোর পথে। আবার নতুন নতুন পাখি দেখার রেকর্ডও হচ্ছে। সেজন্য যে পাখি বেশি দেখা যায়, তাদের নামের আগে সুলভ। যে পাখি কম দেখা যায়, তাদের নামের আগে দুর্লভ; অতি কম দেখা গেলে বিরল বা বিপন্ন বা মহা-বিপন্ন শব্দ বসানো হয়।

অনেকের প্রশ্ন, আবাসিক পাখি সারাবছর দেশে থাকতে পারলে পরিযায়ী পাখিরা পারে না কেনো? মূলত পাখিরা খাবার, থাকা, বাসা বানানো ও প্রজননের জন্য এক স্থান থেকে অন্য অন্য স্থানে ভ্রমণ করে। যখন যেখানে খাবার ও থাকার নিরাপদ জায়গা পায়, পাখিরা তখন সেখানে বসবাস করে, বাসা বানায়, প্রজনন করে। আবাসিক পাখিদের খাবার সারা বছরই দেশে থাকে। সেজন্য এরা অন্য কোথাও যেতে চায় না। এদের খাবার থাকে এ দেশের বন-বাদারে, নদী-নালা, খাল-বিলে। খাবারের পাশাপাশি এসব স্থানেই আছে এদের নিরাপদে থাকা ও প্রজননের জায়গা। তাই অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবে না এরা। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, আবাসিক পাখিরা খাবার খুঁজে পেলে পরিযায়ীরা পায় না কেনো? আসলে বেঁচে থাকার তাগিদে একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খায়। কেউ পানি থেকে মাছ ধরে খায়, কেউ গাছ থেকে পোকা ধরে খায়। কেউ সাপ খায়, কেউ কেঁচো খায়। কেউ ফুল খায়, কেউ ফল খায়। কেউ খায় ফুলের মধু। এভাবে একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খেয়ে বাঁচে। এ ছাড়া কেউ বাস করে পানিতে। কেউ বাস করে জমিনে। আসলে মানুষ অন্য প্রাণির মতো পাখিদেরও থাকাণ্ডখাওয়ার নানা বৈচিত্র্য আছে।

আমাদের দেশে শীত মৌসুম শুরু হলেই অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি আসতে থাকে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীর মোহনায় জেগে ওঠা কাদাচর, সিলেটের হাওরাঞ্চলের বিল, পদ্মার চর বা সুন্দরবনে এরা বসবাস শুরু করে। তবে পরিযায়ী পাখিদের আমরা অনেকে অতিথি পাখি বলি। আমরা ভাবি, যেহেতু সারাবছর দেখা যায় না, তাই এরা অতিথি বা অন্য দেশের পাখি। এ ধারণা ভুল। এ পাখিগুলো মোটেই অতিথি নয়, এরা আমাদের দেশেরই পাখি। যেহেতু পাখিগুলো পরিব্রাযক বা পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়ায়, তাই এদের পরিযায়ী বলা হয়।

মূলত আমাদের দেশে শীত মৌসুমে উপকূলের কাদাচর, হাওরের বিল বা জলাভূমি, পদ্মার চর বা সুন্দরবনের চরগুলোতে অল্প পানি থাকে। এ অল্প পানিতেই থাকে পরিযায়ী পাখিদের খাবার। আর খাওয়া শেষ হলে চর বা বিলের আশপাশের ঘাসের মাঠ, বালুর মাঠ, বনভূমি বা বন-বাদাড়ের নিরাপদ স্থানে এসব পাখিরা থাকে। এরপর গ্রীষ্ম মৌসুমে বর্ষার পানি বাড়তে থাকলে এসব চর ও বিল পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে পরিযায়ী পাখিরা তাদের খাবার আর খুঁজে পায় না, থাকার জায়গাও হারায়, তাই তারা খাবারের খোঁজে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায় অন্য দেশে। এভাবেই কাটে পরিযায়ী পাখিদের জীবন।

সব পরিযায়ী পাখি একই ধরনের জায়গায় থাকে? মোটেই নয়। আমাদের দেশে আসা অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি জলাভূমি বা সৈকতের কাছাকাছি থাকে। আর জলে থাকে বলেই এদের আমরা ‘জলচর’ বলি। আবার যারা সৈকতের কাছাকাছি থাকে তাদের বলি ‘সৈকত’ পাখি।

বাংলাদেশে জলচর পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ দেখা যায় ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, রাজশাহী, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সুন্দরবন ও হাওরাঞ্চলের বিল বা জলাভূমিতে। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের হাওরের বিল বা জলাভূমি পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আবাসস্থল। হওরের জলে বাসবাস করে বলে এদের জলচর পরিযায়ী পাখি বলা হয়ে থাকে। হাওরাঞ্চলের বিল বা জলাভূমির মধ্যে অন্যতম হলো মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, বাইক্কাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি। এসব হাওরে ছোট-বড় অনেক বিল আছে। শীতে এসব বিলে পানি কম থাকে বলে পরিযায়ী পাখিদের জন্য এসব বিল বসবাস ও খাবারের উপযোগী থাকে।

হাওরের মধ্যে হাকালুকি হাওর বেশ বড়। এ হাওরের অন্যতম বিল-জলা বিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওরখাল, কোয়ার কোণা, মালাম বিল, গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম, বিড়াল খালসহ ইত্যাদি।

হাওরের বিলে যেসব পরযায়ী পাখি সচারচর দেখা যায় এর মধ্যে আছে ছোট ডুবুরি, বড় খোঁপাডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, উদয়ী গয়ার, দেশি কানিবক, ধুপনি বক, লালচে বক, বড় বগা, ছোট বগা, মাঝলা বগা, গো বগা, এশীয় শামখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি শরালি, মেটে রাজহাঁস, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, সিঁথিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, টিকি হাঁস, মরচেরঙ ভুতিহাঁস, কোড়া, ধলাবুক ডাহুক, পাতি মানমুরগি, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, নেউ পিপি, দল পিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, মেটেমাথা টিটি, হট টিটি, উত্তুরে টিটি, প্রসান্ত সোনাজিরিয়া, ছোট নথজিরিয়া, কেন্টিশ জিরিয়া, ছোট ধুলজিরিয়া, ছোট বাবুবাটান, পাতি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, কালালেজ জৌরালি, তিলা লালপা, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, বিল বাটান, বন বাটান, পাতি বাটান, লাল নুড়িবাটান, গুলিন্দা বাটান, ছোট চাপাখি, টেমিকেংর চাপাখি, খয়রামাথা গাঙচিল, কালামাথা গাঙচিলসহ বিভিন্ন পাখি।

ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংগঠন সারাবিশ্বে জলচর পাখি শুমারির সমন্বয় করে থাকে। প্রতিটি দেশে এ সংগঠনের একজন জাতীয় সমন্বয়ক থাকেন। বাংলাদেশে এর সমন্বয়ক ও শুমারির নেতৃত্ব দেন পাখিবিশারদ ইনাম আল হক। তার তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর শীত মৌসুমে উপকূলের চর, হাওরের বিল ও সুন্দরবনে জলচর পাখি শুমারি করা হয়।

পাখি গবেষণায় শুমারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর গবেষণার উদ্দেশ্য হলো পাখি বাঁচিয়ে রাখা। কারণ পাখি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই পাখি বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। আর পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।

এছাড়া পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর গুরুত্বপূর্ণ বলেই টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবনকে রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এ দুটি স্থান ছাড়াও নোয়াখালীর হাতিয়ার দমারচর, ভোলার চর শাহজালাল, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিলসহ বেশ কিছু স্থানই আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া হাওরের পাশাপাশি পরিযায়ী পাখির আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভোলার চরফ্যাশনের চর শাহজালাল, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপসহ আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপ, সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশ, রাজশাহীর পদ্মার চরাঞ্চল।

শুমারির পাশাপাশি বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে গবেষণার উদ্দেশ্যে পাখির পায়ে রিং পরানো হচ্ছে। এছাড়া বসানো হয়েছে পাখির পাখায় স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়