প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৭
কবিতাকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছি : অনু ইসলাম

অনু ইসলাম। কবি, লেখক, সংগঠক। জন্ম ২৫ এপ্রিল, মুন্সীগঞ্জের নয়াগঁাও। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : জল কেটে যায় হাত স্পর্শে (২০১৫), রজতমুদ্রা (২০১৭), ধানরঙের ঘ্রাণ (২০১৯), বিকল্প শয্যায় ফুটে আছি (২০২১)। প্রবন্ধগ্রন্থ : কবিতায় রাষ্ট্রচিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১৬)। সম্পাদনাগ্রন্থ : সম্মিলন (২০১৭)। আলোকচিত্রগ্রন্থ : আলোকনগর (২০২৩)। সহযোগী সম্পাদক : ‘পটভূমি’ (সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা)। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা : কবি পরিষদ, মুন্সীগঞ্জ। পুরস্কার ও সম্মাননা : ৭ম ইলিশ উৎসব পুরস্কার, চঁাদপুর ২০১৫; চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি দোনাগাজী সাহিত্য পদক-২০১৯ এবং অন্যান্য। তার সাক্ষাৎকারটি আজ পত্রস্থ হলো।
প্রথমেই জানতে চাই, কবি অনু ইসলাম কীভাবে লেখালেখির জগতে আসলেন?
অনু ইসলাম : ‘জগৎ’ শব্দের মধ্যে যে ব্যাপকতা কিংবা বিশালতা সেই বিবেচনায় সাহিত্যের জগৎ কিংবা লেখালেখির জগৎ যাই বলা হোক না কেনো এই বিশালতার মধ্যে নিজেকে অতি ক্ষুদ্রভাবে যদি উপস্থাপন ভঙ্গিতে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় সেটা যে কোনো লেখকের জন্য নিঃসন্দেহে সৌভাগ্য। তবে যতটুকু লেখালেখির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছি এযাবৎ সেটাকে সাহিত্যের জগতের স্থান হিশেবে কতটা বিবেচ্য বলে গৌণ্য তা বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা যায়, কৈশোরের সময় থেকেই কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম অধরা প্রেমিকার প্রতি আকৃষ্ট হবার মতো। অবশ্য সেই সময়ে কবিতার প্রেমে পড়ার পরিবেশটা পেয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেবেলায় দেখেছি, বাড়িতে আব্বার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি এবং মেজু ভাই কবি সুমন ইসলামের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিলো। আব্বার এবং মেজু ভাইয়ের লাইব্রেরিতে ছিলো অসংখ্য বই। মূলত এই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করেই নিজের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। এতসব সংগৃহীত বই এবং এরূপ আবহাওয়া নিজেদের বাড়ির মধ্যে থাকা একটা শৈশব-কৈশোর সময়কালকে নাড়া দিয়ে উঠবে যেকোনো মানুষকে এমনটি হয়তো বাস্তবিক। আমার লেখালেখির ক্ষেত্রটি এরূপ আবহাওয়ার মধ্য দিয়েই অবচেতনে শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমি ক্লাস নাইনে উঠেছি মাত্র। সবেমাত্র ডায়েরির পাতায় কবিতা লেখা শুরু করি। পাঠ্যবইয়ের কবিতার পাশাপাশি সুমন ভাইয়ের লাইব্রেরিতে সংগৃহীত থাকা কবিতার বই বের করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। কখনো তার টেবিলে রাখা কবিতার বই নিয়ে কবিতাপাঠে মগ্ন হতাম। নতুন কোনো কবিতা লিখলে ঘনিষ্ট বন্ধুদের পরে শোনাতাম। পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতাপাঠাতাম, ছাপা হতো এরূপ একটা আনন্দঘোরের মধ্য দিয়ে লেখালেখির বা সাহিত্যের জগতে নিজের যাপিত জীবনকে সম্পৃক্ত রাখার গল্পটা শুরু হয়েছিলো...
আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠার সময়টা কেমন ছিল? সেই সময় কীভাবে আপনার চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলেছে?
অনু ইসলাম : স্মৃতিরোমন্থন হলেই অনুভব করা যায় শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার সময়টা ছিলো দারুণভাবে আনন্দময় এবং উপভোগ্য। ধলেশ্বরী নদীর পাশেই বেড়ে ওঠা। নদী-কেন্দ্রিক শৈশবের নানান স্মৃতি এখনো ঢেউ জাগায়। নদী কিংবা প্রকৃতির নানান মেটাফর কবিতার বিষয়বস্তু হিশেবে চিন্তায় তখন প্রভাব ফেলেছে। পরে অবশ্য নানান পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে কবিতার কাঠামো নির্মাণ বা বিষয়বস্তুতে ভিন্নতা বা নতুন আঙ্গিকে নিজেকে বিনির্মাণের প্রচেষ্টা চলেছে, এখনো চলছে...
কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাসÑতিনটি ক্ষেত্রেই আপনার আগ্রহ। কোনটিকে আপনি আপনার আত্মার সবচেয়ে কাছের মনে করেন?
অনু ইসলাম : কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা ইতিহাস এই তিনটি ক্ষেত্রেই কাজ করতে ভালো লাগে এবং আনন্দ খুঁজে পাই, কাজের মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ তো থাকেই। তবে আত্মার সবচেয়ে কাছের বলতে মূলত আজীবন কবিতার কাছেই বঁাধা থাকতে চাই। কবিতাই প্রথম প্রেম এই প্রেমটুকু বহন করে যেতে চাই আমৃত্যু।
আপনার লেখা প্রথম বইটি কী ছিল? সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অনু ইসলাম : জীবনের প্রথম প্রেম যেহেতু কবিতা। কবিতার ঘোরে বসবাস করেছি বলেই প্রথম বই হিশেবে কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো। যার নামকরণ ছিলÑ’জল কেটে যায় হাত স্পর্শে’ (২০১৫)। প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা এদেশের তরুণদের জন্য খুব একটা সুখকর নয় এটা টের পেয়েছি। তরুণদের এখনো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করতে হয় বা হচ্ছে। প্রকাশকদের তরুণদের প্রতি যত্নশীল হওয়াটা জরুরি। ভালো বা মানসম্মত যে কোনো পাণ্ডুলিপি প্রকাশকদের দায়িত্ব নিয়ে তরুণ লেখকদের পাশে দঁাড়ানো দরকার। দুই একজন প্রকাশক তরুণদের পাশে দঁাড়াচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে কিন্তু জোরালোভাবে পাশে থাকা দরকার শর্তহীন।
আপনার লেখার প্রক্রিয়াটা কেমন? আপনি কীভাবে একটি প্রবন্ধ বা কবিতা শুরু করেন?
অনু ইসলাম : লেখার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা জটিল। কেননা কোনো একটা লেখাকে নির্দিষ্ট কোনো প্রক্রিয়ায় ফেলা যায় না। একেকটা লেখা একেকভাবে ধরা দেয়। কবিতাকে কী আপনি কোন প্রক্রিয়ায় ফেলতে পারবেন? কেউ কি পেরেছে? যদি পেরেও থাকে তাহলে সেই প্রক্রিয়ার স্থায়ীত্ব নিয়ে কী প্রশ্ন উঠবে না! প্রবন্ধের ক্ষেত্রে যে বিষয় নিয়ে প্রবন্ধটি লিখিত হচ্ছে তার জন্য কিছুটা পূর্বপাঠ-প্রস্তুতি নেয়া যায় এবং তার ব্যাখা বিশ্লেষণ করাটা জরুরি। না হলে লেখকের আলাদা নির্মাণ কৌশল বা বৈশিষ্ট্য তৈরি করা যায় না। প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে অন্তত এই প্রক্রিয়াকরণের কার্যত চেষ্টা থাকে।
আপনার লেখায় ইতিহাসের প্রভাব বা উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
অনু ইসলাম : গভীর অর্থে প্রভাব নেই। তবে নিজের অঞ্চলকে কখনো কখনো কবিতার মধ্যে তুলে ধরার প্রয়াস ছিলো। সেটা পাঠক আমার ‘রজতমুদ্রা’ গ্রন্থের কবিতাপাঠের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও খুঁজে পাবেন। এভাবে কবিতায় শুধুমাত্র নিজ অঞ্চলের ইতিহাসকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবার দাবি রাখে সেটা আলোচনা সাপেক্ষ।
আপনি কীভাবে বিষয় নির্বাচন করেন? একটি লেখার জন্য কতটা গবেষণা করেন?
অনু ইসলাম : মূলত প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিষয় নির্বাচন করার পরেই নানামুখি গবেষণা জরুরি। গবেষণা ভালো হলে একটি প্রবন্ধ মানসম্মত হয়ে উঠার সুযোগ পায়। সেই সাথে লেখকের নিজস্ব ব্যাখা, বিশ্লেষণ ও মতাদর্শ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসমূলক কিছু লিখতে হলে তো আরো ব্যাপকভাবে ইতিহাসের গবেষণা জরুরি। যতটা পারি নিজের অবস্থান থেকে চেষ্টা করি প্রবন্ধ বা ইতিহাসমূলক কিছু লিখলে গবেষণালব্দ হয়ে কাজ করার।
ইতিহাসের প্রতি আপনার আগ্রহ কোথা থেকে জন্ম নিয়েছে?
অনু ইসলাম : ইতিহাসের প্রতি আগ্রহটা জন্মেছে ইতিহাস গবেষক ও লেখক গোলাম আশরাফ খঁান উজ্জ্বল উনার সাথে পথ চলতে গিয়ে। না হলে হয়তো ‘আলোকনগর’ গ্রন্থের মতো একটি বৃহৎ কাজ আমার হতো না। কখনো হতো না।
আপনি কি মনে করেন, ইতিহাসচর্চা ও সাহিত্যের মধ্যে কোনো সেতুবন্ধন রয়েছে?
অনু ইসলাম : সাহিত্যের ক্ষেত্রকে যদি ইতিহাসের বিবেচনায় আনা যায় সেক্ষেত্রে সাহিত্যচর্চা ও ইতিহাসচর্চার মধ্যে নিশ্চয় সেতুবন্ধন করা যায়। আপনার ইতিহাস ঐতিহ্যকে যদি সাহিত্যে স্থান করে দিতে পারেন নতুন উপস্থাপন ভঙ্গিতে পাঠকের কাছে সেক্ষেত্রে সেতুবন্ধনটা দৃঢ় হবার সুযোগ পাবে। হোক তা কবিতায়, গল্পে বা উপন্যাসে।
আমাদের সমাজে সাহিত্য ও ইতিহাসচর্চার স্থান কতটা, আপনার মতে?
অনু ইসলাম : আমাদের সমাজে সাহিত্য বা ইতিহাসচর্চার স্থান কম করে হলেও আছে। আমাদের হাতে পরিমাপ করার কোনো নির্ণায়ক নেই। সমাজে এই দুইয়ের চর্চা হয়তো কম করে হলেও থেকে যাবে। এই কম চর্চার শক্তিটা আবার অনেক বেশি। অনেকটা সু-শিক্ষার মত শক্তিশালী।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আপনার কী বার্তা থাকবেÑবিশেষ করে যারা সাহিত্য ও ইতিহাসে আগ্রহী?
অনু ইসলাম : তরুণ প্রজন্মকে এই সময়ে এসে পথ দেখাবার বা বার্তা দেবার সুযোগ নেই। গ্লোবালি তারা এখন উন্মুক্ত। নানা পথ বা বার্তা তাদের হাতের মুঠোয়। শুধুমাত্র ইচ্ছে শক্তিটা কাজে লাগাতে পারলেই তারা নিজের পথ নির্মাণ করে নিতে পারবে। সেটি হোক সাহিত্য বা ইতিহাসচর্চার অংশে কিংবা জীবন গড়ার ক্ষেত্রে।
এমন কোনো বই বা লেখক কি আছেন, যঁারা আপনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন?
অনু ইসলাম : অনেকের লেখাই অবচেতনে হয়তো দাগ ফেলে যায়। নির্দিষ্ট অর্থে আমার পাঠের মধ্যে এমন কোনো বই নেই, তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা বারবার পাঠযোগ্য বলে মনে হয়। সেটা বিষয়বস্তু, ভাষা, আঙ্গিক বয়ান বা চরিত্র নির্মাণ যেভাবে মূল্যায়ন হোক। এছাড়া কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার জীবনবোধের যে দর্শন সেটা আমাকে প্রভাবিত করে মূলত, যে সকল কবিতায় জীবন দর্শন খুঁজে পাই সেই ধরণের কবিতা আমাকে প্রভাবিত করে হোক সে যেকোন বিখ্যাত কবি কিংবা কোন তরুণ কবির কবিতা।
আপনি যখন লেখেন না, তখন কী করতে পছন্দ করেন?
অনু ইসলাম : কবিতার প্রতি একটা অদৃশ্য অনুভব, অদৃশ্য পৃথিবী অবলোকন করার প্রত্যয় নিয়ে জেগে থাকি এখনো। যদিও সব সময় কবিতা লেখা হয়ে ওঠে না। কবিতা লিখতে এখন কেনো যেন একধরনের সংকোচ হয়। আদৌ কি কবিতা লিখতে পেরেছি কোনো! কবিতা তো অধরা কোনোকিছুতে তাকে কি ধরতে পারবো? যখন লেখা হয়ে উঠে না কিংবা লেখালেখিতে সময় দিতে পারি না তখন ভবঘুরে হয়ে উঠি এবং পাঠের মধ্যে থাকতে পারলে সাহিত্যের সম্পৃক্ততা অনুভব করি।
আগামীতে আপনার কী লেখার বা গবেষণার পরিকল্পনা রয়েছে?
অনু ইসলাম : কবিতা দিয়ে শুরু হলেও সাহিত্যের মূলস্রোতে কবিতা-প্রবন্ধ নিয়ে যুগলভাবেই হেঁটে চলেছি। মাঝে-মধ্যে ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু সেভাবে অগ্রসর হতে পারিনি। কবিতাকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছি। জীবন অভিজ্ঞতা এবং কবিতার ধারাবাহিক পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে আহরিত যে বোধ নিজের মধ্যে নির্মিত হয়েছে তার বাইরে গিয়ে কখনো কিছু লিখিনি। কেননা কবিতার মধ্য দিয়ে আমি আমার সময়কাল এবং জীবনবোধ উন্মোচিত করার প্রয়াস খুঁজেছি সবসময়। কবিতা ছাড়া জীবনে তেমন কিছুকেই অপরিহার্য বিবেচনাবোধ করিনি। তবে আগামীতে ছোটগল্প লেখার ইচ্ছে আছে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জের সামগ্রিক সাহিত্যচর্চা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। যদি সময় করে নিজ অঞ্চলের সাহিত্যের গবেষণার কাজটুকু করে যেতে পারি।