প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৫, ১১:২৯
নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন কেবল সামাজিক ন্যায়বিচারের অংশ নয়, এটি একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম মূলভিত্তি। সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি জাতির সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান শর্ত। বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা অনেক দেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
আধুনিক বিশ্বে নারীর উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে বহু উন্নত দেশ সফলতা অর্জন করেছে। জাপান এ ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে, যেখানে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে জাপানে নারীদের কর্মসংস্থানে প্রবেশের হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে ১৯৯৯ সালে “ইধংরপ খধি ভড়ৎ ধ এবহফবৎ-ঊয়ঁধষ ঝড়পরবঃু” আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। কর্মজীবী নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি, উদ্যোক্তা সহায়তা, কর্মক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত হয়রানি প্রতিরোধ আইনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশেও নারীর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (ঝগঊ) নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে, এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেমনÑনারী নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, গৃহস্থালি শ্রমের স্বীকৃতির অভাব, এবং আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোতে নারীদের আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হলে বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই পরিকল্পনার প্রয়োজন। নারীদের প্রতি বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করতে হবে। কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সহায়তা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা
নারীর উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মূলত তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে—নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, এবং বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারীদের কল্যাণ। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের প্রতিষ্ঠিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজনÑ
স্বল্প সুদে ঋণ ও সহজ শর্তের অর্থায়ন : অনেক নারী উদ্যোক্তা মূলধনের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। তাই সরকার, ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। জাপানে ঝগঊ (ঝসধষষ ধহফ গবফরঁস ঊহঃবৎঢ়ৎরংব) ব্যাংকের মাধ্যমে নারীদের ব্যবসায়িক ঋণ দেওয়া হয় এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য পৃথক ফান্ড গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও একই মডেলে ‘নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করা যেতে পারে।
বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা : অনেক নারী ব্যবসা করতে চান, কিন্তু দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে পড়েন। তাই তাদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, বিপণন, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল লেনদেনের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
মহিলা চেম্বার ও সহযোগী সংগঠন : নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ চেম্বার ও সহযোগী সংগঠন তৈরি করতে হবে, যা ব্যবসা সম্প্রসারণ, বাজারজাতকরণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণে সহায়তা করবে।
নারী পরিচালিত স্টার্টআপ ও ব্যবসার জন্য বিশেষ সুযোগ : টেন্ডার, কর ছাড়, প্রদর্শনী ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নারীদের ব্যবসার জন্য অগ্রাধিকারমূলক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের সমস্যা নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায়। কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীদের প্রতি বিদ্যমান সহিংসতা। এটি প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরিÑ
কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ : নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, অনাকাক্সিক্ষত হয়রানি ও শিশু বিয়ে রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জাপানে উঠ (উড়সবংঃরপ ঠরড়ষবহপব) আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন নির্যাতিত নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও আইনি সহায়তা প্রদান করে। বাংলাদেশেও এই ধরনের কেন্দ্র ও আইনি সহায়তার সুযোগ আরও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
নারীদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি : কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থলে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে কিছু ট্রেনে শুধু নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা থাকে, যা বাংলাদেশেও চালু করা যেতে পারে।
নারীদের জন্য হেল্পলাইন ও আশ্রয়কেন্দ্র : জরুরি সহায়তার জন্য নারী নির্যাতন প্রতিরোধ হেল্পলাইন চালু এবং তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাপানের মতো বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারীদের কল্যাণ
প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য একটি সুসংহত নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। এই অংশের অধীনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারেÑ
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ : সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা যেতে পারে। জাপানে ‘খড়হম-ঞবৎস ঈধৎব ওহংঁৎধহপব (খঞঈও)’ নামে একটি ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য আর্থিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। বাংলাদেশেও একটি টেকসই পেনশন ও বীমা কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে।গৃহস্থালি নারীদের জন্য পেনশন সুবিধা : দীর্ঘদিন ধরে যারা গৃহস্থালি কাজে যুক্ত ছিলেন, তাদের জন্য সরকারি পেনশন সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের পুনর্বাসন : প্রবীণ বা বিশেষভাবে সক্ষম নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গঠন, চিকিৎসা সহায়তা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন : একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ নারীর ক্ষমতায়ন কেবল তাদের নিজস্ব উন্নতির জন্যই নয়, বরং সমাজ ও জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের নেতৃত্বের সুযোগ বৃদ্ধি, তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিÑএই তিনটি বিষয় নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে জাপানে, নারীদের নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের জন্য নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশেও নারীর ক্ষমতায়নকে আরও কার্যকর করতে হলে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
নারীদের নেতৃত্বের অবস্থান বৃদ্ধি
নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি করা মানে কেবল তাদের উচ্চ পদে বসানো নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগ প্রয়োজন।
কোটা ব্যবস্থা ও নীতিগত সহায়তা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে কর্পোরেট বোর্ডে অন্তত ৩০% নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উচ্চপদে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
নারী নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন
নেতৃত্বের জন্য দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তাই, নারীদের জন্য আলাদা নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে, যেখানে ব্যবসা পরিচালনা, নীতিনির্ধারণ, এবং সংকট ব্যবস্থাপনা শেখানো হবে।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
নারীরা যদি রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হন, তাহলে তারা আইন ও নীতিনির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাই নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং নারীদের জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমর্থন প্রদান করতে হবে।নারীদের অধিকার সুরক্ষা
নারীদের কর্মক্ষেত্রে ও পরিবারে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ
অনেক কর্মক্ষেত্রে এখনো নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন। একই ধরনের কাজের জন্য নারী ও পুরুষের সমান বেতন নিশ্চিত করা জরুরি।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা
জাপানে কর্মজীবী নারীদের জন্য ১৪ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশেও এই সুবিধাগুলোকে আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যাতে কর্মজীবী মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)