প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
ছোট চাচ্চুর ওপর ভীষণ আফসোস হচ্ছে নাবিলের। কেন যে তিনি এখানে এনে ভর্তি করে দিলেন! তা না হলে এখন কত কিছুই না করতাম, জসিমদের বাগানে ফল খেতে কিংবা নদীর তীরে খেলতে যেতাম।
চারতলার একটা ব্যালকনিতে বসে বারান্দার দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছে নাবিল। দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে সবাই যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু নাবিলের কি আর ঘুম আসে! সে তো কখনোই এ সময়ে ঘুমোয়নি। এসময় খেলায় ছিলো, না হয় সহপাঠীদের সাথে কোথাও না কোথাও ঘুরতেছিলো।
নাবিলদের পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে থাকে। নাবিলও বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো। এবার সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে, সামনে জেএসসি পরীক্ষা। সবসময় খেলাধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকে নাবিল। তাই ছোট চাচ্চু নাবিলকে শহরের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। যেখানে শহরতলীর বাইরে বসবাসরত ছাত্রদের জন্য স্কুলের নিজস্ব আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। নাবিলও আবাসিকে থেকে লেখাপড়া করছে। আবাসিক ছাত্রদের জন্য রয়েছে বিশেষ তত্ত্বাবধান। সেখানে সার্বক্ষণিক দেখভাল করতে কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন। আবাসিকে নিয়মণ্ডশৃঙ্খলায় বেশ কঠোরতা রয়েছে। সময়মত পড়ালেখা, খেলাধুলা, খাবার গ্রহণ, ক্লাসে আসা সব কিছুই করতে হয়।
গ্রামের বাড়িতে থাকতে কোনো কিছুতেই এসব নিয়মণ্ডনীতি ছিলো না। যখন যা ইচ্ছে হতো তা-ই করতে পারতো। কিন্তু এখানে সারাদিন এক ঘরে বসা, তাও আবার সময়মত সব কিছু করতে হচ্ছে, এসব ভালো লাগছে না নাবিলের। কারো সাথে তেমন মিশতেও পারছে না, কারো সাথে তো তার পরিচয়ও নেই। বারবার মনে হচ্ছে বাড়ির কথা, ছোট বোন রাইসা, বহু স্মৃতিবিজড়িত তার গ্রাম, যেখানে আছে মাঠ-ঘাট, বন-বাদাড়, ঝোপ-ঝাড়, পুকুর-নদী, বিশাল বিশাল বিল আরো কত কী!
এখানে তো এসবের কিছুই নেই, আর থাকবেই বা কী করে? ইট পাথরের এই শহুরে জীবনে সেসব কেবলই স্মৃতি।
নাবিলের রুমমেট নাজিব সেও একই ক্লাসে পড়ে, তবে সে দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে আসছে। নাবিলের এই অবস্থা দেখে নাজিব জিজ্ঞেস করে-
কিরে নাবিল সারাক্ষণ এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছিস, কি কোনো সমস্যা?
নাহ, মাথা নেড়ে উত্তর দেয় নাবিল।
তাহলে?
এমনিতেই।
বাড়ির কথা মনে হচ্ছে বুঝি!
এবার নাজিবের দিকে তাকায় নাবিল, হ্যাঁ, আমি বাড়িতে চলে যাবো, এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না।
কী যে বলিস, এরকম প্রথম প্রথম আমারও হয়েছিল, দেখবি কয়েকদিন পর এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুই বলেনি নাবিল, আবারো চেয়ে থাকে বারান্দার দিকে।
এইতো কয়েকদিন হলো এখানে আসার, কিন্তু নাবিলের মনে হচ্ছে যেন কত বছর ধরেই না এখানে বন্দী হয়ে পড়ে আছে। ছোট চাচ্চু দু-একদিন পর পর নাবিলকে দেখতে আসেন, নাবিলের আব্বু বিদেশে থাকায় ছোট চাচ্চুই পরিবারের সব কিছু দেখাশোনা করছেন।
চাচ্চু দেখতে এলে নাবিল তার চাপা কষ্ট লুকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, যেন চাচ্চু বুঝতে না পারেন। ছোট চাচ্চুকে নাবিল ভীষণ ভয় পায়। তিনি যেমন আদর করতে জানেন তেমনি শাসনও করেন। সব ঠিকঠাক আছে কি না, কিংবা কোনো কিছু লাগবে কি না সব জিজ্ঞেস করেন চাচ্চু।
নাবিল তার আম্মুর কাছে কল দেয়। আম্মু তখন কল ব্যাক করেন, রিসিভ করে কোনো কথা বলে না নাবিল।
আব্বু কেমন আছো? তোমার শরীর কেমন আছে? রাতের খাবার খেয়েছো ?
কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না নাবিল।
কী হলো আব্বু কিছু বলছো না যে! কি কোনো সমস্যা?
অনেকক্ষণ পর-
আম্মু বলেই কাঁদতে থাকে নাবিল।
আব্বু তুমি কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? বলো আম্মুকে-
কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে নাবিল বলে,
আম্মু আমি বাড়িতে আসতে চাই, এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না।
আম্মু বলেই আবার কেঁদে ওঠে নাবিল।
কান্নার আওয়াজ শুনে মা তো বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। সর্বদা হাসি খুশিতে থাকা ছেলেটা আমার কাঁদছে, না জানি কী সমস্যা হলো।
এদিকে ছোট চাচ্চুর কাছে মা নাবিলের বিষয়ে জানতে চাইলে, কই নাতো কোনো সমস্যা নেই, সব কিছুই ঠিকঠাক আছে বলে জানান তিনি। তবুও কেন জানি শান্ত হতে পারছেন না নাবিলের আম্মু। মা বলে কথা! তাই পরদিন তিনি দেখতে আসেন নাবিলকে।
মাকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মায়ের সাথে কত বছর পর দেখা! ছেলের কান্নায় মা আর নিজেকে ঠিক ধরে রাখতে পারেননি। চোখ বেয়ে অশ্রু পড়তে থাকে মায়েরও। অশ্রুসিক্ত চোখে ছেলের কপালে চুমো খান মা।
আমার আব্বুটা এতো শুকিয়ে গেছে, কিছু খাওনি আব্বু?
এসো আব্বু তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, শাড়ির আঁচল বের করে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দেন মা। টিফিন বক্স থেকে একে একে সব খাবার বের করে ছেলেকে খেতে দেন। তবু খেতে পারছে না নাবিল।
কি রে আব্বু, খাচ্ছ না যে! রান্না স্বাদ হয়নি বুঝি? তোমার পছন্দের খাবার তো তৈরি করে এনেছি।
না আম্মু আমি এখানে আর থাকবো না, আমি তোমার সাথে বাড়ি চলে যাবো।
কেন আব্বু এখানে সমস্যা কী? বলো আমাকে।
আম্মু আমি বাড়ি ছাড়া অন্য কোত্থাও থাকতে পারবো না, এখানে কিছুই আমার ভালো লাগে না। আম্মু আমি আর দুষ্টুমি করবো না, নিয়মিত পড়ালেখা করবো।
ছেলের এসব কথা শুনে কী করবেন মা ভেবে পাচ্ছেন না। তবে তিনি ঠিক করলেন, ছেলেটাকে কয়েকদিন বাড়িতে রেখে সব ভালোভাবে বুঝিয়ে তারপর আবার নিয়ে আসবেন।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে তিন দিনের ছুটি নিলেন। সব কিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে মা ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন।
গাড়িতে বসে শহুরের বন্দিজীবন থেকে মুক্ত করায় মনে মনে মাকে ধন্যবাদ দেয় নাবিল।
কিন্তু অজানা এক ভাবনা এসে তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে, এখানে যদি আবারো! তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায় নাবিলের। তবে নাবিল প্রতিজ্ঞা করে এখন থেকে আর কোনো দুষ্টুমি নয়, নিয়মিত স্কুলে যাবে এবং ভালোভাবে লেখাপড়া করবে, তাহলে আর শহরের স্কুলে আসতে হবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়িতে এসে পৌঁছে তা টেরই পায়নি নাবিল। ঘরের বারান্দায় পা রাখতেই কী যে আনন্দ লাগছিলো নাবিলের! স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে আবারো ধন্যবাদ জানায় মাকে।