শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২১, ০০:০০

শিক্ষা আইন পর্যালোচনা
অনলাইন ডেস্ক

শিক্ষা আইন-২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ছোটখাটো বানান সংশোধন ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। এরপর ভাষাগত সংশোধনের জন্যে আইন মন্ত্রণালয় হয়ে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে এটি কার্যকর করা হবে।

২০১১ সাল থেকে শিক্ষা আইন নিয়ে কাজ শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে একাধিকবার অভিমত নেওয়ার পর খসড়া তৈরি হয়। একবার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনও করা হয়, কিন্তু নানা অসংগতির কারণে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

আইনে পাঁচ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে প্রথম শ্রেণির আগের প্রাক-প্রাথমিক, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক এবং এরপরে উচ্চশিক্ষা স্তর। তবে এখন যে স্তরই চালু থাকুক না কেনো, সরকার শিক্ষার স্তর (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে বলে প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ আছে।

২০১০ সালে সংসদে পাস করা শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক বাদে তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা আছে। ড. কুদরত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনেও অনুরূপ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ ছিলো। আইনে সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আছে। এটি শিশুর মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু সব ধারায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হবে। এ পাঠ্যপুস্তক, এর শিক্ষাক্রম ইত্যাদি তৈরি ও প্রকাশ করবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

বিদেশি শিক্ষাক্রমের আওতায় (ইংরেজি মাধ্যমসহ অন্য মাধ্যম) পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত বিষয়ও বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম নীতিকাঠামো (ন্যাশনাল কারিকুলাম পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক) প্রণয়ন করবে। এতে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণিতে চলমান পরীক্ষা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, তবে বলা প্রয়োজন।

বাংলা ভার্সন ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশনসহ সব ফি সরকার ঠিক করে দেবে। অনুমোদন ছাড়া ফি আদায় করা যাবে না। দেশের ভেতরে চালাতে হলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকতে হবে। নিবন্ধিত ট্রাস্ট বা সংস্থা সরকারের অনুমোদনক্রমে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেও এর আলাদা ব্যাংক হিসাব থাকতে হবে। কোনোক্রমেই প্রতিষ্ঠানের আয়ের টাকা সংস্থা, ট্রাস্ট বা অন্যত্র স্থানান্তর করা যাবে না।

দীর্ঘ দশ বছর ধরে আলোচনার পর প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ করল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে সহায়ক বই কোচিংসহ যে বিষয়গুলো নিয়ে এতদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে সেই বিষয়গুলো রেখেই খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

১৯৮০ সালে করা একটি আইনেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ; তবে নোট-গাইডের নামে অনুশীলন বা সহায়ক বই বাজারে চলছে। নোট-গাইডের পরিবর্তে বর্তমানে প্রকাশিত ‘সহায়ক গ্রন্থ বা রেফারেন্স বুক’ এবং সব ধরনের কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

তবে উভয়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পূর্বানুমোদনক্রমে পরিচালনা ও প্রকাশ করা যাবে। সংবাদপত্রে বর্তমানে শিক্ষা পাতায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুশীলনমূলক পাঠ বা কনটেন্ট প্রকাশ করা হচ্ছে। এটা প্রকাশ করতে হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।

নোট-গাইড বলতে সরকার অনুমোদিত সহায়ক পুস্তক বাদে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লেখা থাকে যেসব পুস্তকে এবং যা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য প্রকাশ করা হয়ে থাকে সেগুলোর প্রকাশ নিষিদ্ধ। বিধানের লঙ্ঘন করা হলে তিন বছরের কারাদ-, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- দেওয়া যাবে।

আর সরকারের অনুমোদিত সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ করা হলেও তা পাঠে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক বাধ্য করতে পারবে না শিক্ষার্থীদের। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং এর আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর কোনো সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রকাশ করতে পারবে না। যদি মুদ্রণ ও প্রকাশ করতে চায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকে সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমোদন নিতে হবে।

ব্যবসায়িকভাবে পরিচালিত সব ধরনের কোচিং সেন্টার নিবন্ধন নিয়ে চালানো যাবে। এমন বিধানসহ শিক্ষা আইন-২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে সম্মিলিত কোনো শিক্ষা আইন নেই বলে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন। নোট-গাইড নিষিদ্ধ করা সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

সহায়ক বই তৈরির কথা বলা হয়েছে; তবে অনুমোদনের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে যা একটি জটিল বিষয়। অনুমোদন নেওয়া মানে ঘুস-বাণিজ্যের ব্যাপার আছে, রাজনীতির ব্যাপার আছে। অনুমোদন কে দেবে? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, নাকি সরাসরি মন্ত্রণালয়?

এর যে কোনো এক জায়গা থেকে হলেও সেটা সহজ কোনো বিষয় নয়। তবে সহায়ক বই থাকতেই হবে, কারণ এনসিটিবির একটি বই দিয়ে জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো যায় না। সরকারি অফিস থেকে কোনো কিছুর অনুমোদন নেওয়া মানে তো কোনো ট্রান্সপারেন্ট কাজ নয়। সে ব্যাপারটি সরকার কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটি একটি প্রশ্ন।

প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে অভিভাবকদের লিখিত সম্মতিতে স্কুল সময়ের আগে-পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যাবে।

ফ্রিল্যান্সিং কোচিং চালাতে বাধা থাকবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলার সময়ে কোচিংয়ে যেতে পারবেন না। বিষয়টি অইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভর্তি, চাকরি, ও এবং এ লেভেল, আইইএলটিএ-জিআরইসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার চলবে।

পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাকেও বৈধ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তা হচ্ছে, একজন শিক্ষক তার নিজের শিক্ষার্থীকে নিজের কোচিং সেন্টারে নিতে পারবেন না। একই প্রতিষ্ঠানে দেশি ও বিদেশি কারিকুলামে পাঠদান করা যাবে না, করলে তিন বছরের কারাদণ্ড, দশ লাখ টাকা জরিমানা এবং উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

জনসংখ্যার ঘনত্বসহ সাতটি কারণে সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পুনঃস্থাপন করতে পারবে। আবার প্রয়োজন না থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত, একীভূত অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ করানো বা স্থানান্তর করা যাবে। ইচ্ছা হলেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে, যা সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। কোনো শিক্ষক নৈতিকতাবিরোধী কর্মকা-ে জড়ালে তার শিক্ষক নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। জাল সনদে চাকরি নিলে তা ১৮৬০ সালের আইনের অপরাধ বলে গণ্য হবে।

সরকার মনে করলে সব ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ তিন বছরের জন্য নিয়োগ দিতে পারবে। এ ছাড়া সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্য থেকেও একই ধরনের পদে নিয়োগ দিতে পারবে।

শিক্ষা আইনের খসড়ায় নয়টি কারণে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও আংশিক বা সম্পূর্ণ সাময়িকভাবে বন্ধ ও কর্তন এবং বাতিলের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, এর চেয়ারম্যান কার্যপরিধির বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এবং এ কারণে কোনো অনিয়ম বা পাঠদান বাধাগ্রস্ত হলে কমিটি সার্বিকভাবে বা ক্ষেত্রমতে চেয়ারম্যান দায়ী হবেন।

এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ ওই কমিটি বাতিল বা ক্ষেত্রমতো চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারবে। উল্লেখ্য, মূলত এসব কমিটিতে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতারা থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ওপর বিধিনিষেধ এবং শিক্ষক সুরক্ষার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সাময়িক পরীক্ষাও ধারাবাহিক পদ্ধতিতে মূল্যায়নের অধীনে আনা হবে। পরীক্ষায় নকলে সহায়তা করা এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এতে সংশ্লিষ্টতা দ-নীয় অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য দুই বছর কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা দণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে।

একটি বিষয় এখানে খেয়াল রাখতে হবে, সব আইন শুধু শিক্ষকদের ভীতির মধ্যে রাখার জন্য যেন না হয়, কারণ শিক্ষকরা এ সমাজেরই মানুষ। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বিষয়টি যাতে কলুষমুক্ত থাকে সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়