প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
থানা-পুলিশের উপর হামলা ও জনরোষ : প্রাসঙ্গিক ভাবনা ও বিশ্লেষণ
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী থানা-পুলিশের উপর হামলাকে অনেকেই নিছক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে থাকেন, যা মোটেও ঠিক নয়। রাজনৈতিক কারণ হলো হামলা করার একটি অনুষঙ্গ মাত্র। এই হামলার কারণ বোঝার জন্য রকেট সাইন্টিস্ট কিংবা ওপেনহাইমার হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই হামলাগুলোর মূল কারণ হলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
থানায় জিডি, পুলিশ ভেরিফিকেশন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, অভিযোগ কিংবা যে কোনো কাজ করতে গেলে ডিউটি অফিসার বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সহিহ নিয়তে দানখয়রাত করা আপনার জন্য ফরজে আইন। রাজনৈতিক মামলার এজাহার ও এফআইআরে আসামীর নাম সংযোজন কিংবা বিয়োজনের জন্য থানার ওসি ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’-র মহাপরিচালকের দায়িত্ব অত্যন্ত সততার সঙ্গে পালন করেন। আমলযোগ্য বা আমল অযোগ্য মামলা দায়ের, চার্জশিট ও ফাইনাল রিপোর্টের ক্ষেত্রে মামলার আইও এবং ওসি ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’-এর শরিয়াহ্ শাখার প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
আবার আসামিকে দ্রুত গ্রেফতার কিংবা গ্রেফতারে সময়ক্ষেপণ করা অথবা গ্রেফতারকৃত আসামি গোপনে ছেড়ে দেয়া, রিমান্ড আবেদন করা বা না করা, রিমান্ডে জামাই-আদর কিংবা থার্ড ডিগ্রি প্রদানের জন্যে আসামি কিংবা তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে পুলিশ ‘বিশ্ব ব্যাংক’-এর নিয়মকানুন ইসলামি শরিয়তের মতো প্রতিপালন করে থাকেন।
পুলিশ মাদকদ্রব্যসহ আসামি ধরার পরে আসামীর সাথে হিসাববিজ্ঞানের রেওয়ামিল ও জাবেদার গুণাগুণে জব্দ তালিকায় মাদকদ্রব্যের জ্যামিতিক হারে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকেন। যার ফলে জব্দ তালিকার মাদকদ্রব্য থানার মালখানা হতে কোর্টে নিতে নিতে জন্মবিরতিকরণ পিলের অভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েকশ’ গুণ বেওয়ারিশ প্রজনন ঘটিয়ে থাকেন।
আসামি ধরা কিংবা পুলিশ ডিউটি করার সময় সিএনজি, পিকআপ কিংবা যানবাহনের ড্রাইভারকে বিরামহীন রোজার ফজিলত বয়ান করেন এবং ডিউটি শেষে ড্রাইভারকে দেউলিয়া রেখে ঋণমুক্তির দোয়া ও জিকির শিখিয়ে আসেন।
কোর্ট পুলিশের সিএসআই ও জিআরও মামলার নথি নিয়ে আসামিকে পরিসংখ্যান ও পাটীগণিতের ভয় দেখিয়ে বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতির সূত্রগুলো শিখানোর চেষ্টা করেন, আর আসামি বেচারা অংকবিদ্যা ও ক্যালকুলাসের গ্যাঁড়াকলে পড়ার আশঙ্কায় টেবিলের নিচ দিয়ে হিসাববিজ্ঞানের কাজ সেরে কোনো রকমে রেহাই পেতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন।
রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ রুহানী হাত উঁচিয়ে গাড়ির কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে ইনকাম ট্যাক্সের আয়-ব্যয়ের জটিল খতিয়ান দাখিল করেন, অগত্যা নিরীহ ড্রাইভার আয়করের উচ্চ গণিতের মারপ্যাঁচ এড়িয়ে উৎসে কর বা মিনিমাম ট্যাক্স পরিশোধ করে পুলিশি ঝামেলা হতে সবসময়ই ইহকালীন নাজাতের প্রার্থনা করেন।
সিএনজি গাড়ি হতে পুলিশ মান্থলি নামক মাসোহারা গ্রহণের বিনিময়ে চিড়িয়াখানার বাঘ, ভালুক, সিংহ, উট, জিরাফ ড্রাইভারদের নিকট গণহারে বিক্রি করেন, এছাড়াও অ্যামাজন জঙ্গলের ফল, ফুল, গাছগাছালি দিয়ে সিএনজি গাড়িকে গ্রীনহাউজ ইফেক্ট দিয়ে দেন। আবার কখনো কখনো দেশকে নিরক্ষরমুক্ত রাখার পবিত্র উদ্দেশ্যে ড্রাইভারদের ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালার সহজ পাঠ শিখিয়ে দেন। আর সবশেষে যাত্রাপথে আসমানি ও জমিনি বালা-মুসিবত হতে ড্রাইভারদের নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহর রুহানী রহমত কামনা করেন।
রাস্তার ফুটপাতের হকার ও ভাসমান দোকানি, যানবাহনের বিভিন্ন স্ট্যান্ড ও টার্মিনালের ইজারাদারদেরকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কিংবা অ্যালিকো লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কেয়ামত পর্যন্ত অফেরতযোগ্য দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখার বিনিময়ে পুলিশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মতো এদের উচ্চ নিরাপত্তা জোরদার করে থাকেন।
এসপি অফিস ও থানার গোলঘরে রীতিমতো জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত তথা ‘আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে)' বসিয়ে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলা, জমিজমার মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং ফর্মুলার অপপ্রয়োগ ও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে একতরফা আপোষরফা ও নিষ্পত্তির মাধ্যমে ন্যায় বিচারক হিসেবে খোদার বেহেশতে রাজউকের ডুপ্লেক্স বাড়ি নিশ্চিত করেন।
আওয়ামী সরকার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য এক সময়ের দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীকে দানবীয় বর্বর ইসরাইলী বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন এবং পুলিশকে দুর্নীতি করার জন্য দায়মুক্তিসহ খোদায়ী ফতোয়া-ফরমান অঘোষিতভাবে জারি রাখেন।
অপরদিকে পুলিশের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্তা তাদের মাঠ-প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে ঐশী বাণীর শুদ্ধতার সবক শুনিয়ে নিজেরা ফেরেশতা সেজে মিয়ামি আর পাতায়ার নাইটক্লাবে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রাত্রিযাপন করেন। এরপর অবসর পরবর্তী সময়ে আরব্য রজনীর আলিফ লায়লা আর আলাদিনের চেরাগের মতো মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে কয়েকশত গুণ উচ্চতা বিশিষ্ট এই ফেরেশতাদের অবৈধ অর্থ-সম্পত্তির হদিস মেলে এবং এই অর্থের পাহাড়সম ওজনের কারণে সুইস ব্যাংকের ভোল্ট উপচে পড়ার কথাও ওহি-এলহামের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি।
রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে দুনিয়াবি খোদার আদেশে পুলিশ কর্মকর্তারা মেসি ও নেইমারের মতো বিরোধী দলের চীফ হুইপকে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের মতো লং কিক-গোল করে গোল্ডেন বুট নিশ্চিত করেন। আর পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমন করার জন্য মারেফাতের বাইয়াত গ্রহণ করে কারবালার ময়দানের মতো নিষ্ঠুর ইয়াজিদ ও বর্বর ইসরাইলী বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, খুন ও নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করেন।
ডিবি হারুন দেশের রাজনীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক, আলেমণ্ডওলামা, লেখক, গবেষক, শিল্পীদের গ্রেফতারপূর্বক জোর করে ভাত খাইয়ে, তার ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করে ডিবি অফিসটাকে ফাইভস্টার মানে উন্নীত করে হোটেল শেরাটন ও ইন্টারকন্টিনেন্টালের সমকক্ষতায় নিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘে উজ্জ্বল করেছেন।
আবাসিক হোটেল ও অভিজাত বিউটি পার্লারে অভিযান চালিয়ে পুলিশ লাল পরী, নীল পরী ও জান্নাতি হুরদের আটক করেন, তারপর সেখান থেকে উন্নতমানের ফিজিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান বীজ যাচাই-বাছাই শেষে নারীলিপ্সু লম্পট দুশ্চরিত্র পুলিশ কর্মকর্তারা বায়োকেমিস্ট্রি ও মাইক্রোবায়োলজি গবেষণাগারে নিয়ে রাতভর ফুলশয্যায় কাটিয়ে এই লাস্যময়ী পরী ও জান্নাতি হুরদের ভার্জিন টেস্ট শেষে নিষ্কৃতি প্রদান করেন। আর অবশিষ্টদের বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলারের বিনিময় রেটে গোল টেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে নিরাপদ জায়গায় কিংবা পতিতা ও দেহব্যবসার তকমা লাগিয়ে কোর্টে প্রেরণ করেন।
অতীতে পুলিশের এই সকল নানান অপকর্ম ও দুর্নীতি এবং সর্বশেষ জুলাইয়ে নৃশংসভাবে ছাত্র গণহত্যার কারণে জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিলো। আর সামান্য সুযোগ পেয়েই প্রলয়ঙ্করী সুনামি ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ন্যায় শক্তিশালী হয়ে আগ্নেয়গিরির টগবগে জ্বলন্ত লাভার মতো দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও ঘৃণা জনরোষে পরিণত হয়ে পারমাণবিক মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।
যে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দিয়ে বেড়াতো, আজ তারাই নিরাপত্তার অভাবে পালিয়ে বেড়ায়! যে পুলিশ নিরীহ মানুষকে ঘর ছাড়া করেছে, আজ তারাই থানা ছাড়া হয়ে গেছে!! প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম!!!
তবে এ কথা শতভাগ সত্য যে, সব পুলিশ একই রকম নয়, বাহিনীতে এখনো অনেক সৎ ও দেশপ্রেমিক পুলিশ আছে, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম ও গৌরবময় ভক্তি।
লেখক : সাইফুল খন্দকার, আইনজীবী, চাঁদপুর জজ কোর্ট। ০১৮৫৩২২২৮৮৮