প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কেউ আমাকে পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। পরিচয় হয়েছিল দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে তাঁর লেখা পড়ে। ক্রমেই আমি তাঁর লেখার একজন মুগ্ধ পাঠক হয়ে গেলাম। কৌতূহল মেটাতে বন্ধু কাজী শাহাদাত ভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম। তিনি পীযূষ কান্তি বড়ুয়া সম্পর্কে আমাকে সংক্ষিপ্ত একটা ধারণা দিলেন। ফেসবুকে বন্ধু হবার সুযোগে পীযূষ দার পোস্ট দেখার সুযোগ তৈরি হলো। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের কিছু অংশ নজরে পড়তো। চাঁদপুরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি।
ঢাকায় ইলিশ উৎসবে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চাঁদপুরে সাহিত্য উৎসবে গিয়ে তাঁর আলোচনা শুনলাম, কিন্তু একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়নি। হাই-হ্যালো পর্যন্তই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
করোনাকালে প্রবীণ জীবন নিয়ে তাঁর সাথে আমার অনলাইনে একটা ইন্টারভিউ হয়েছিল। তা থেকে প্রবীণ জীবন সম্পর্কে পীযূষদার চিন্তা-ভাবনার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল।
পীযূষদা সম্পর্কে আমি শুনেছি। কেউ প্রশংসা করেছেন, আবার কেউ সমালোচনায় কাতর হয়েছেন। প্রশংসার চাইতে সমালোচনা শুনতে ভালোবাসি। কারণ এতে সমালোচিত ব্যক্তির শক্তি, গ্রহণযোগ্যতা, মেধা, মননশীলতা, দক্ষতা সম্পর্কে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে। সমালোচনা মানুষ মন থেকে করে। প্রশংসা অনেক সময় দায়ে পড়ে, ঠেকে করে। প্রশংসা অনেকখানি মেদ নির্ভর আর সমালোচনা মেদহীন।
আমাদের যৌবনে আমরা যাঁদেরকে চাঁদপুরে শিল্প সাহিত্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছি তাঁদের তেমন একটা প্রশংসা শুনতে পাই না। পীযূষদা যখন চাঁদপুরে আসেন তখন শিল্প সাহিত্যে খানিকটা মন্দাভাব চলছিল। মূলত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এই মন্দাভাব সারা দেশেই শুরু হয়, যেটা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। পীযূষদা সাহিত্যের সঙ্কটকালে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে জ্বলজ্বল করে জ্বলছেন। তাঁর লেখায়, ছড়ায় সমকালীন জীবনের নানান সঙ্কটকে অত্যন্ত সাহসের সাথে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। চাঁদপুরে শিল্প সাহিত্যের শূন্যস্থান পূরণ করে তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। সাহিত্য চর্চায়, গদ্য রচনায়, ছড়া লেখায় তাঁর নিজস্ব একটা ভঙ্গি রয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তিনি অনেক লেখকের লেখাই পড়েন, কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত হন বলে মনে হয় না। ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা তাঁর জীবিকা, কিন্তু সাহিত্য তাঁর জীবন। তিনি সাহিত্যে বসবাস করে যাপিত জীবনকে উপভোগ করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী।
সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর অপরিহার্যতা আরো অনেক বছর থাকবে।
সাহিত্যে একটা শ্রেণি-চেতনা বিরাজ করে। লেখক মনে মনে ঠিক করে নেন তিনি কোন্ শ্রেণির পাঠকের জন্যে সাহিত্য রচনা করছেন। সাহিত্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তিনি কী অর্জন করতে চান সেটা মনে মনে ঠিক করে নেন।
আমাদের সাহিত্যে যৌনতা, ধর্ম, রাজনীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি, কারণ মানুষ সাহিত্যে এসবই আশা করে। পীযূষ দা সাহিত্যের ভিন্ন একটি ধারার সমর্থক। সেটা হলো বিজ্ঞান-সাহিত্য। বিজ্ঞান মনস্ক একটা জাতি গড়ে তুলতে হলে তার জন্যে বিজ্ঞান সাহিত্য চর্চা খুবই জরুরি।
মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে, চলনে, বলনে বিজ্ঞানের শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু চিন্তার জগতে বিজ্ঞান নয় বিশ্বাসই দাপটের সাথে বিরাজ করছে। মানুষের ভবিষ্যৎ কল্যাণ বিজ্ঞানের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিজ্ঞান সাহিত্য চর্চা বিজ্ঞান মনস্ক তৈরিতে সহায়তা করবে।
পীযূষদা একজন ভালো সংগঠক। বিতর্ককে জনপ্রিয় করতে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করছেন। বিতর্ক মানুষকে যুক্তিবাদী হতে শেখায়। কোনো কিছুকে ক্রিটিক্যালি বা গভীর ভাবে বোঝার ক্ষমতা তৈরি করে। সবচেয়ে বড় অর্জন হয় দার্শনিক সহনশীলতা। ভিন্ন মত-পথকে গায়ের জোরে নয়, যুক্তি দিয়ে পরাস্ত করার মানসিকতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিতর্ক ভূমিকা পালন করে। শুধুমাত্র বিশ্বাসকে পুঁজি করে জ্ঞান বিজ্ঞানকে নাকচ করে দেবার মানসিকতা থেকে মুক্ত করে বিতর্ক।
পীযূষদার স্ত্রী মুক্তা পীযূষ, দুই ছেলে প্রত্ন, প্রখর চাঁদপুরে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত। দাদার পুরো পরিবার শিল্প সাহিত্যে দিনযাপন করে। আমার চোখ জুড়িয়ে যায় যখন পীযূষ দার পুরো পরিবারকে ম্যাচিং করা আকর্ষণীয়, রুচিসম্মত, আধুনিক পোশাকে দেখি।
পীযূষদা সাহিত্য চর্চায় যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন, তা আমাদের আলোড়িত করে। তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরো বড় অবদান রাখবেন এই আশা বুকে লালন করি।
খ্যাতিমান লেখকরা ৬০/৭০ বছর বয়সে অনেকেই বড় ধরনের পুরস্কার পেয়েছিলেন। পীযূষ কান্তি বড়ুয়া একদিন লেখার জন্যে বড় একটা পুরস্কার পাবেন--৫০তম জন্মবার্ষিকে এটাই কামনা করছি।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।