রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

চোখের সামনে ভাই ও বোনের মৃত্যু : কষ্টকর অভিজ্ঞতা
অনলাইন ডেস্ক

আমার দু চোখের সামনে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন আমার শিমুল আপু এবং ঝিলাম ভাই। তাদের চলে যাওয়াটা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। মানতেই পারছি না তারা যে এই পৃথিবীতে আর নেই। মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। মুখটা কালো হয়ে যায়। ভাবি, আমার ভাই-বোন দুটি কই আল্লাহ! তখন চারপাশে তাকাই। বলতে থাকি, শিমুল আপু, ঝিলাম ভাই কোথায় আপনারা? তাদের এ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।

মেনে না নেয়ার অনেক কারণও আছে। তাদের শারীরিক অসুস্থতাজনিত মৃত্যু হলেও সেটা কিন্তু হঠাৎ। তাও আবার আমার চোখের সামনে। যার কারণে তাদের সাথে মৃত্যুর আগের কাটানো সময়গুলো বার বার আমার মনে পড়ে এবং আমাকে পীড়া দেয়।

স্মৃতি এমনই, যা বার বার মনে পড়ে। ঝিলাম ভাই গত দুই বছর আগে ফুসফুস ও ডায়বেটিসজনিত সমস্যায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যার ফলে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলটি কেটে ফেলে দিতে হয়। এরপর তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন এবং সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে থাকেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি আবার শারীরিক দুর্বলতাসহ চোখের সমস্যায় আক্রান্ত হতে থাকেন। সময়টা ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু।

একদিন ঝিলাম ভাই আমাকে ফোন করে বলেন, ‘নাহিন কেমন আছ্?ো এখন কই?’ আমি বললাম, ভালো, ঝিলাম ভাই। পত্রিকা অফিসে আছি। ঝিলাম ভাই বললেন, ‘ভাইয়া, আমি তো চোখ দেখাতে ঢাকায় যাবো, তুই কি আমার সাথে যেতে পারবি?’ আমি বললাম, কবে যাবেন। তিনি বললেন, ‘যাইতে চাইছিলাম তো শনিবার। রোববার বারডেম চক্ষু বিভাগে চোখ দেখাবো’। তখন দেশে লকডাউন ছিলো না। আমি বললাম, ঠিক আছে, কিন্তু ভাই আমি বাবা-মামণির সাথে কথা বলে জানাচ্ছি। আর আপনি যেহেতু ঢাকা যাবেন, সোমবার রাতে গেলে আমার জন্যে ভালো হয়। মঙ্গলবার তো আমার অফিস ছুটি। সেদিন সারাদিন আপনাকে সময় দিতে পারবো। আর মঙ্গলবার দিন ডাক্তার দেখিয়ে পরের দিন বুধবারে চাঁদপুরে এসে সন্ধ্যায় অফিস করতে পারবো। এভাবে যাই চলেন। তিনি আস্তে বললেন, ‘আচ্ছা’। এ কথাটা শোনার পর আমি ফোন রেখে দিলাম।

কিছুক্ষণ পর ঝিলাম ভাই আবার ফোন করে বললেন, ‘নাহিন দুদিন আগে গেলে ভালো না। দুদিন পরে গেলে দেরি হয়ে যায়, তুই একটু ছুটি নে না ভাই’। তারপর ভাইকে বললাম, আচ্ছা ভাই, আমি জানাচ্ছি একটু পর। পরে বাবা-মামণির সাথে কথা বলে অফিসে আমার সহকর্মী বন্ধু কনককে বললাম, আমার ভাই অসুস্থ, তাকে নিয়ে একটু ঢাকা যাবো, তুমি একটু রোববার আমার অনুপস্থিতিতে ডিউটি করবা। আর আমার ছুটির দিন তুমি ছুটি কাটিও। ও বললো, ‘আচ্ছা ভাই সমস্যা নাই’। তারপর শনিবার ডিউটি করে সেদিন রাতেই লঞ্চে উঠলাম। আমি অফিসের কাজ সেরে বাসায় গিয়ে রেডি হয়ে কোনো রকম ভাত খেয়ে ঝিলাম ভাইকে আনতে পালবাজার তাদের বাসায় হাজির হলাম। তারপর একসাথে রিকশা করে চাঁদপুর লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। রাত সোয়া ১২টায় ময়ূর-৭ লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্যে লঞ্চঘাট পৌঁছি। তারপর লঞ্চে উঠি। ঝিলাম ভাইসহ আমার আরেক ভাই সাব্বিরের মাধ্যমে ফার্স্ট ক্লাসের দুটি চেয়ার বুকিং করে রাখেন। সেদিন দুই ভাই অনেক বিষয় নিয়ে দুজনের ভেতর কথা বলতে বলতে সুন্দর মতো ঢাকায় পৌঁছলাম। কিন্তু ময়ূর-৭ লঞ্চ ভোর রাতেই অর্থাৎ ফজরের নামাজের আগেই ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছে যায়।

আমি বললাম, ভাই, এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। আর সব যাত্রীকে নামিয়ে দিচ্ছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। আর বলছে, লঞ্চ থেকে নামুন, লঞ্চ অন্য ঘাটে চলে যাবে। এটা শুনে ঝিলাম ভাইকে বললাম, কী করবেন। ঝিলাম ভাই বললেন, ‘আর একটু বসি, দেখি কী হয়’। একটু বসার মধ্যে তিনি মোবাইলে চার্জ দিলেন ও একটু ঘুমিয়ে থাকলেন। এরই মধ্যে আবারো লঞ্চ কর্মচারীদের ডাকাডাকি। পরে ভাইকে বললাম, এ রকম কেনো করে এরা? এতো রাতে সদরঘাটে নামিয়ে দিলে সাধারণ যাত্রীরা কই যাবে? পরে আর কী করা। আমাদের দুজনকে লঞ্চঘাটে নেমে পণ্টুনে অবস্থান করতে হলো। লঞ্চ থেকে নামতেও সমস্যা হলো। এক লঞ্চ থেকে আরেক লঞ্চে গিয়ে তারপর পণ্টুনের দেখা পেলাম। কখনো উঁচু, কখনো নিচু জায়গা দিয়ে পণ্টুনে নামলাম। ঝিলাম ভাইয়ের নামতে কষ্ট হলো, চোখের সমস্যা ও শরীরের দুর্বলতার কারণে। আমি নেমে তারপর ভাইকে ধরে নামালাম এবং সারাটা রাস্তা তিনি আমাকে ধরেই হাঁটলেন।

পণ্টুনে নামার পর ঝিলাম ভাই ১ কাপ চা খাওয়ার পর আমরা দুজনে অন্য কোনো খালি লঞ্চ খুঁজতে থাকলাম। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কিংবা বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। সদরঘাটে অবস্থানরত ইলিশা লঞ্চে আশ্রয়ের জন্যে উঠলাম। তখন লঞ্চের কর্মচারীরা বলে উঠলো, এখানে বসা যাবে না। তারপর তাদের চোখের আড়ালে দুই ভাই চেয়ারের এক অন্ধকার কোণে বসে পড়লাম এবং সকাল ৭টা পর্যন্ত লঞ্চে অবস্থান করলাম-কখনো ঘুমিয়ে কখনো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে, আবার কখনো লঞ্চকর্মচারীরা কী করে তা দেখে।

সকাল হওয়ার পর পর আস্তে বের হয়ে সদরঘাটের পাশে এক হোটেলে নাস্তা সেরে রিকশা করে বারডেমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বারডেমে গিয়ে দুই ভাই চক্ষু বিভাগ খুঁজে বের করে দেখি, তিনি যে ডাক্তার দেখাবেন সে ডাক্তার শনিবার ও মঙ্গলবার বসে। তখন তো মাথায় হাত। আমি বললাম, কি-ও ভাই, এখানে তো শনিবার ও মঙ্গলবার। আপনি অন্য তারিখে আসলেন কেনো। শিওর হয়ে আসবেন না? তখন ভাই বললেন, ‘ভুল হয়ে গেছে’। তখন কথা না বাড়িয়ে আমি হেসে বললাম, আরে আমার ভাই, শুধু শুধু আসলাম এতো কষ্ট করে।

এরপর কখন দেখাতে হবে সব জেনে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চাঁদপুরে পৌঁছে ভাইকে বাসায় দিয়ে আসার সময় ভাবীকে বললাম, ভাবী না জেনে শুধু শুধু গেলাম। ঝিলাম ভাইয়ের ভুলের কারণে শুধু শুধু এতো টাকা খরচ হলো।

যাক এখন কী করার আছে, সোমবার দিন রওনা দিতে হবে, মঙ্গলবার ডাক্তার দেখাতে হবে। পরে কনক (সহকর্মী বন্ধু)কে ফোন করলাম, তোমার অফিসে আসা দরকার নেই, আমি ডিউটি করবো। সোমবার রাতে রওনা দেয়ার পর সেই আগের মতোই লঞ্চঘাটে সেই একই কাহিনী। যতোবার তাকে নিয়ে ঢাকায় চোখ দেখাতে গেছি, ততোবার কখনো ইলিশা, কখনো সোনার তরী লঞ্চে উঠে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। তারপর হেঁটে সদরঘাটের পাশে একটি হোটেলে গরুর নেহারী ও তন্দুল দিয়ে নাস্তা করে, তাকে ওষুধ খাইয়ে রিকশায় করে পৌঁছাতাম বারডেমে। বাসে যাতায়াত করতাম না করোনার কারণে।

বারডেমে পৌঁছানোর পর ডাক্তার তাকে চোখ পরীক্ষার জন্যে স্ক্যানিং করতে দিলেন। স্ক্যানিং করার পর বের হলো, তার ডান চোখে রক্তক্ষরণ হয়েছে, অবস্থা তেমন ভালো না। তাই তার ডান চোখে লেজার এবং ইনজেকশন দিতে হবে। পাশাপাশি বাম চোখে যাতে এফেক্ট না করে, সেজন্যে সেই চোখেও দিতে হবে। এজন্যে ডাক্তার রোববার ও বুধবার এ দুদিনের যে কোনো একসময় এসে ইনজেকশন দিতে আসতে বললেন।

ভাইকে বললাম, ভাই, কী করবেন? ভাই বললেন, ‘টাকা-পয়সা ব্যবস্থা করে রোববার অথবা বুধবার পরপর এসে দু চোখে দুইটা ইনজেকশন দিতে হবে’। আমি বললাম, ঠিক আছে ভাই, আপনি টাকার ব্যবস্থা করেন। সামনের সপ্তাহে রোববার একটা এবং বুধবার একটা দিবো। ভাই বললেন, আল্লাহ ভরসা। পরে ঝিলাম ভাই টাকার ব্যবস্থা করেন। সামনের সপ্তাহে কনকের সাথে ডিউটি ম্যানেজ করে ঝিলাম ভাইয়ের সাথে চোখের ইনজেকশন দিতে গেলাম। ইনজেকশন দিলে পরের দিন সকালে চোখের কী রকম অবস্থা হয় তা পরীক্ষার জন্যে একদিন ঢাকায় অবস্থান করা লাগতো। তখন ঝিলাম ভাইয়ের বড় বোন বুশরা আপুর বাসায় অবস্থান করতাম। এ রকম কয়েকবার তার ডান চোখে এবং বাম চোখে ইনজেকশন দিতে এবং চোখের ফলোআপের জন্যে তার সাথে ঢাকায় যেতে হয়েছে। কিন্তু ইনজেকশেন দেয়ার পরও তার চোখ ভালো হয়নি। উল্টো তার ডান চোখ পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাম চোখে তিনি সামান্য দেখতেন। এই চোখ দিয়েই তিনি চলাফেরা, অফিস, রাস্তাঘাটে হাঁটা-চলা করতেন।

সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ তার ডান চোখের ইনজেকশন দেয়ার জন্যে ঢাকায় যাই। তার কিছুদিন আগে ঝিলাম ভাইয়ের ছোট বোন শিমুল আপু হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বারডেম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। এর মাঝখানে জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখ ঝিলাম ভাইয়ের চোখের ডাক্তারের নিকট ফলোআপ করাতে বারডেম হাসপাতলে যাই। সেখানেই শিমুল আপু কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি ছিলেন। সেই সুবাদে আমরা সেদিন তার সাথে দেখা করি এবং ডাক্তারের নিকট ঝিলাম ভাইয়ের চোখ চেকআপও করাই। চোখ চেকআপ করার পর ডাক্তার বলেছেন, আর একবার তার চোখের ইনজেকশন দেয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিবো তার চোখ নিয়ে কী করা যায়, কারণ তার চোখের প্রেশার কোনোভাবেই কমছে না। চোখের প্রেশার কমানোর জন্যে তার চোখ পুরাই বাতিল করতে হবে (যদিও তিনি ডান চোখে দেখতেন না)। আমরা ওইদিন (৩০ জানুয়ারি) চাঁদপুরের উদ্দেশ্য রওনা হই এবং পরে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ ঝিলাম ভাইয়ের চোখের ইনজেকশনের জন্যে ঢাকায় আসি।

শিমুল আপুর মৃত্যুর দিন : ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টার দিকে বারডেম হাসপাতালে আসার পর দুপুর দুটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ঝিলাম ভাইয়ের চোখের ইনজেকশনের জন্যে। কারণ সেদিন একসাথে অনেককে ইনজেকশন দেয়া হয়। ঝিলাম ভাইয়ের যেহেতু বাম চোখে ইনজেশন ছিলো, তাই তার বাম চোখ ব্যান্ডেজ দিয়ে আটকানো থাকবে ৩ ঘণ্টা এবং ডান চোখে তিনি কিছুই দেখেন না। যার ফলে তখন তার পুরো দুনিয়াটাই অন্ধকার। আমি বললাম, ভাই আপনি আমাকে ধরেন, কোনো ভয় নাই। আপনাকে সুন্দর মতো আমি বুশরা আপুর বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনে আমার ওপর ভরসা করেন। তিনি বলেন, হ্যাঁ। তারপর ভাইকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের কাছে বুশরা আপুর বাসায় পৌঁছালাম। পৌঁছানোর পর বাসায় শিমুল আপুকে অনেকটা সুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখতে পাই। তিনি বললেন, ঝিলাম ভাই, তুই এখানে আমার পাশে আস্তে শুয়ে বিশ্রাম নে। ঝিলাম ভাই শোয়ার কিছুক্ষণ পর শিমুল আপু উঠলেন। আমি বললাম, আমি নামাজ পড়ে আসি বাইরে থেকে। নামাজ পড়ে বাইরেই খেয়ে তারপর বাসায় আসি।

বাসায় আসার পর শিমুল আপু বললেন, নাহিন খেতে আয়। আমি বললাম, আপু আমি খেয়েছি। আপু হাসির ছলে বলেন, ‘ওরে শয়তান, তুমি বাইরে একা একা আমাদের রেখে খেয়ে এসেছো!’ আমিও হাসলাম। তারপর আপুর সাথে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা অনেক কথা হলো, সাথে বুশরা আপুও ছিলেন। কথা বলতে বলতে মাগরিবের আজান দিলো। এর মাঝখানে আপু চাঁদপুরে তার ছেলে আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। পুরো সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। দেখে মনে হয়নি তিনি অসুস্থ। মাগরিবের আজান দেয়ার পর শিমুল আপু মাগরিবের নামাজ পড়লেন, তারপর আমি নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে ঝিলাম ভাইয়ের চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিই। ব্যান্ডেজ খোলার পর তিনি হাত-মুখ ধুতে যান। তখন শিমুল আপু একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে শুয়ে পড়েন। তখন আমাকে বললেন, নাহিন তুই সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছিস্, এখন একটু বিশ্রাম নে। আমি বললাম, আপু এখন শোবো না, ঝিলাম ভাইকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো। শিমুল আপু বললেন, অল্প কিছুক্ষণ রেস্ট নে, তারপর যা। তারপর শিমুল আপুর পাশেই আমি শুয়ে পড়লাম। তখন বললাম জোরে জোরে, আপু একটা জিনিস লক্ষ্য করছেন, আজকে এই বাসায় শুধু আমরা ৪ ভাই-বোন, আর কেউ নেই। এটা বলে আমি কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের কথা বলে ঘুমাতে গিয়ে ঘুম ভাঙলো রাত ১১টায়। এর মাঝখানে আমি ঘুমের ভেতর সব আওয়াজ, কথা-বার্তা টের পেতে লাগলাম। ঘুম থেকে উঠবো সেই ইচ্ছে ছিলো না। এরই মধ্যে ঝিলাম ভাই ডাক দিয়ে বললেন ‘নাহিন বাইরে যাবি’ বলে? এটা শুনে শিমুল আপু হেসে হেসে বললেন, কিরে ঘুমাবি না বলছিলি, এখন তো পুরা ঘুম দিয়েই উঠলি। ঘুম থেকে ওঠার পরই বাবার ফোন আসলো। জানতে চাইলেন, কী অবস্থা তোমাদের? আমি বললাম, সব কিছু ঠিক আছে। বাবা ফোন রেখে দেয়ার পর আমি আর ঝিলাম ভাই বাইরে কিছু খাওয়ার জন্যে বের হলাম। খাওয়া শেষে ঝিলাম ভাইয়ের ৬টি ড্রপ চোখে দেয়ার জন্যে সামনের রুমে বসলাম এবং ঝিলাম ভাইকে ৫ মিনিট পর পর ড্রপ দিতে থাকলাম। এমন সময় শিমুল আপু বললেন, শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না, একটু রেস্ট নেই। ঝিলাম ভাইকে ড্রপ দেয়ার মধ্যেই শিমুল আপুর বুকে ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। আর তখন বুশরা আপু বললেন, তোর গোসল না করার দরকার ছিলো। আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এই সময় শিমুল আপু বাড়ির অনেকের সাথে কথা বলেছেন। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা এবং কথা-বার্তা বলতে থাকলেন। এক ফাঁকে গরম পানি দিয়ে গোসল করে নেন। এটা শোনার পর বললাম, আপুর গোসল করাটা ঠিক হয়নি। ওদিকে শিমুল আপুর ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তেই লাগলো।

ঝিলাম ভাইয়ের চোখের ড্রপ দেয়া শেষ করার পরই আমরা দুজনেই শিমুল আপুর কাছে দ্রুত অবস্থান করলাম। বুশরা আপু শিমুল আপুকে পানি খাওয়াচ্ছিলেন। আমি দেখতে পেলাম, আমার সুস্থ আপুটা বুক ব্যথার যন্ত্রণায়-অস্থিরতায় ছটফট করছিলেন। আমি তার পেছনে গিয়ে বসলাম এবং আমার হাতের উপর তাকে হেলান দিতে বললাম। যদি আপুর বুক ব্যথার কষ্ট একটু হলেও কমে। কিন্তু আপু বুক ব্যথার অস্থিরতায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন। আমি কী করবো চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঝিলাম ভাই অসুস্থ, বুশরা আপু কী করবে বুঝতে পারছেন না। আমি ঢাকা শহরের কিছুই চিনি না, কোথায় নিয়ে যাবো এতো রাতে? তখন রাত সাড়ে ১২টার উপরে বাজে। আমি দ্রুত আনন্দ ভাইকে ফোন করলাম। বললাম, ভাই শিমুল আপুর বুকের ব্যথা উঠেছে, কী করবো, আমি তো কিছুই চিনি না। আপুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আপনার কি পরিচিত কোনো লোক আছে কিংবা অ্যাম্বুলেন্স? তিনি বললেন, নাই। তারপর তিনি বললেন, তুমি ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আনো। আমি দ্রুত ‘৯৯৯’ নম্বরে কল দিলাম। সেদিন ভাগ্য ভালো আমার মোবাইলে টাকা ঢোকানো ছিলো। ‘৯৯৯’ নম্বরে কল দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর চাইলাম। তারা বললেন, ফোন কাটবেন না, আমি নম্বর ম্যানেজ করছি, আপনার লোকেশন বলেন। আমি তখন বললাম, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ। তারা ১০ মিনিটে একটি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে দিলেন। অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করার পর অ্যাম্বুলেন্সের আসতে সময় লেগেছে ২৫ মিনিট। আমি ঝিলাম ভাইকে বললাম, ভাই আপনে মসজিদের কাছে যান আর অ্যাম্বুলেন্সটা গলির ভেতরে ঢোকান, অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে। ওদিকে শিমুল আপু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন আর বুশরা আপু তৈরি হতে লাগলেন। আমি ভাবলাম, ঝিলাম ভাই খুঁজে পাবে না, এমনিতে তিনি অসুস্থ। কারণ তিনি ঠিকমত চোখে দেখেন না কিংবা হাঁটতে পারেন না। আমি বললাম, আপনি শিমুল আপুর কাছে থাকেন। আমি দ্রুত দৌড়ে মসজিদের সামনে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পায়চারি করতে থাকলাম টেনশনে। পরে দেখতে পেলাম একটি অ্যাম্বুলেন্স আসছে। অ্যাম্বুলেন্স করে গলির ভেতরে বাসার সামনে হাজির হলাম। দ্রুত স্ট্রেচার নামিয়ে নিচতলার ওই বাসায় হাজির হলাম। তখন দেখতে পেলাম শিমুল আপু সামনের রুমে। তিনি হাঁপাচ্ছেন। আমি বললাম, আপু, একটু কষ্ট সহ্য করেন, অ্যাম্বুলেন্স চলে আসছে। আপু বলেন, নাহিন, ধর। আমি পারতেছি না। আমি আপুকে তুলতে চাচ্ছি, কিন্তু পারতেছি না। কারণ তিনি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছেন। তখন বাসার দারোয়ান আর অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাকে বললাম, দ্রুত আমার বোনকে ধরে স্ট্রেচারে ওঠান। তারপর তিনজনে স্ট্রেচার ধরে আপুকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠালাম। আমি প্রথমে, তারপর ঝিলাম ভাই, তারপর বুশরা আপু আর শিমুল আপু পাশে শোয়া। গাড়িতে কোনো অক্সিজেন নেই। গাড়িটা কিছুক্ষণ চলার পর দেখতে পেলাম, আপু একটা হিক্কা দিয়ে আস্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমি বললাম, ঝিলাম ভাই, শিমুল আপু তো চুপচাপ হয়ে গেছে। তখন ঝিলাম ভাই, ‘শিমুল... শিমুল...’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। আমি ডাকতে লাগলাম, শিমুল আপু... শিমুল আপু...। আপু কোনো সাড়া দেয় না। তার কিছুক্ষণ পর আপু আরো একটা হিক্কা দিলেন। তখন বললাম, ভাই, শিমুল আপু আবার হিক্কা দিছে। বুশরা আপু শিমুল আপুর পায়ের তলা মেসেজ করতে লাগলেন। আমি ডাকতে লাগলাম, আপু আপু। এ রকম কিছুক্ষণ চলার পর বারডেমের কাছাকাছি আসার পর আপু আরো একবার হিক্কা দিলেন। তারপর আর তাকে হিক্কা দিতে দেখিনি। গাড়ি থেকে নামাতে আপুকে ৫ মিনিট সময় লেগেছে। কার্ডিওলজি জরুরি বিভাগে আপুকে দ্রুত নামিয়ে ডাক্তারের কাছে চেকআপ করতে দেই। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বললেন, রোগী আপনাদের কী হয়, উনি তো নেই। তিন ভাই-বোন সবাই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি, কী করবো, কী বলবো কিছুই মুখে আসছিলো না। যে আপুর সাথে সারাদিন স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বললাম, একটুও অসুস্থ দেখি নাই। হাসলো। কথা বললো সবার সাথে। সেই আপু এখন নাই এটা যেনো ভাবতেই পারছি না। তার সাথে আর কথা হবে না। এতো অল্প বয়সে তিনি চলে গেলেন তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে রেখে! সবাইকে জানানো হলো শিমুল আপু আর নেই। তারপর যে অ্যাম্বুলেন্সে আপুকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সেই অ্যাম্বুলেন্সে আপুর লাশ পেছনের সিটে একা শুইয়ে রেখে তিন ভাই-বোন ঢাকা থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।

শিমুল আপু মারা যাওয়ার পর ঝিলাম ভাইকে আর ঢাকা নিয়ে যেতে পারিনি। কারণ এর মধ্যে লকডাউন দিয়ে দিয়েছে পুরো দেশে। এরপর ঝিলাম ভাই চাঁদপুরেই চক্ষু হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যেতেন। এর মধ্যে একবার আমি ও সাব্বির ভাই ঝিলাম ভাইকে নিয়ে চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলাম (সব সময় আমরা তিনজন কোথাও একসাথে গেলে ভালো লাগতো)। ঝিলাম ভাই, কখনো ভাবী বলতেন ডাক্তারের কাছে যেতে। ফোন করে ঝিলাম ভাইয়ের সাথে সময় ঠিক করে চক্ষু হাসপাতাল কিংবা ডায়াবেটিক হাসপাতালে যেতাম। একসাথে ক’দিন আগে চক্ষু হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে চশমা নিয়ে দিয়েছি। একসাথে কোরবানির ঈদের নামাজও পড়েছি। একসাথে এক টেবিলে ভাতও খেয়েছি। ভাইকে এটা বলেছি, কোনো সমস্যা হলে বলবেন, আর দ্রুত চিকিৎসা করাবেন। আপনার যদি কিছু হয়, কী করবে ভাবী দুটি মেয়েকে নিয়ে ? বিশেষ করে ওয়ার্দা। ভাইয়ের বাসায় যখন যেতাম, তখন ভাইকে শুয়ে থাকতে দেখতাম। বলতাম, ভাই উঠেন, সারাদিন শুয়ে থাইকেন না। শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। উঠেন, কথা বলেন। কিন্তু আজ সেই ভাই নেই। কাকে বলবো এ কথা ?

ঝিলাম ভাইয়ের মৃত্যুর দিন : ২ আগস্ট সোমবার। সেদিন রাতে কেনো যেনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে উঠি। নামাজ পড়ে কিছুক্ষণের জন্যে শুয়ে পড়ি ফজরের আজানের জন্যে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান, কানে শব্দ পেলেও উঠবো উঠবো করে ঘুমিয়ে পড়েছি এবং একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন দেখা শেষ, এমন সময় বাবা ‘নাহিন’ বলে ডাক দেয়ার সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে ফজরের দুই রাকাত কাজা নামাজ পড়ে খারাপ স্বপ্নের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করি। সেদিন বাসায় বুয়া কাজ করতে না আসার কারণে বাবা বললেন বাইরে থেকে একটা পাউরুটি নিয়ে আসতে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে বের হলাম পাউরুটি আনতে। পথে লাউশাক পেয়ে বাসায় নিয়ে আসার পর পরই রুমে ঢুকে বসার সাথে সাথেই ঝিলাম ভাইয়ের মোবাইল থেকে ভাবীর কল আসে। ভাবী বললেন, হ্যালো, নাহিন। কী করো, তোমার ঝিলাম ভাই তো একটু অসুস্থ, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তুমি কি যেতে পারবা? আমি বললাম, কেমন অসুস্থ? ভাবী বললেন, গত রাত থেকে হালকা শ্বাসকষ্ট। আমি বললাম, বেশি না কম? ভাবী বললেন, কম। আমি বললাম, ঠিকমতো বলেন, বেশি না কম ? যদি বেশি হয় তাকে কিন্তু ডায়াবেটিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভাবী বললেন, তেমন না। এখন তুমি কি যেতে পারবা? আমি বললাম, ঠিক আছে জানাইয়েন কখন যাবেন। পরে ফোন রেখে দেয়ার পর মামণিকে বললাম, আপনি একটু ভাবীকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন তো কী রকম অসুস্থ। কারণ এখন করোনার সময় কোন্ ডাক্তারের কাছে যাবে আপনি একটু খোঁজ নেন। মামণি ভাবীকে ফোন করলেন এবং বললেন, কী হয়েছে ঝিলামের ? আমাকে যা বললেন, মামণিকে তা-ই বলেছেন এবং ভাবী মামণিকে কোন্ ডাক্তারকে দেখালে ভালো হয় সেটা জিজ্ঞেস করছেন। মামণি বললেন, ঠিক আছে। আমি উজ্জ্বল (চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের আইটি অফিসার)কে জিজ্ঞেস করে জানাচ্ছি। তারপর উজ্জ্বল ভাই কাকে দেখাতে হবে সব কিছু জেনে আমাকে ফোনে ফোনে লিখতে বললেন। আমি নাস্তা খেয়ে রওনা দিলাম আবুলের দোকানের দ্বিতীয় তলায় ডাঃ সোহেল আহমেদের চেম্বারে সিরিয়াল দিতে। সিরিয়াল দেয়ার আগে বাসায় থাকা অবস্থায় সাব্বির ভাইকে ফোন করে বললাম, ভাই, ঝিলাম ভাই অসুস্থ। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তার ফুসফুসের চেকআপের জন্যে। আপনি ঝিলাম ভাইয়ের বাসায় যান দ্রুত। আমি ফোন দিলে তাকে নিয়ে আসবেন। সাব্বির ভাই তখন ঘুমে ছিলেন। তখন ৯টা ৫০ বাজে। আমি সিরিয়াল দেয়ার পরই নিচে নামলাম। আর তখনই মামণি ফোন দিলেন। বললেন, কী অবস্থা? আমি বললাম, মামণি সিরিয়াল দিয়েছি। মামণি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তখন সাব্বির ভাইকে কল দিয়ে বললাম, ভাই, আমি সিরিয়াল দিয়েছি ১১টার দিকে। এখন আমি বাসায় যাই, আপনি ঝিলাম ভাইকে সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ে বের হয়ে ফোন দিলে একসাথে যাবো। সাব্বির ভাই বললেন, ওকে। আমি রিকশা দিয়ে বাসায় যাওয়ার পথে ঝিলাম ভাই আমাকে কল দিলেন, নাহিন সিরিয়াল দিয়েছো ভাইয়া? আমি বলেছি, জ্বি। ‘তুই কি আসবি?’ আমি তখন একটু রাগ করেই বললাম, ভাই, সাব্বির ভাই তো আছে। তিনি নিয়ে আসতে পারবেন, আর আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। সাব্বির ভাই আমাকে বাসার সামনে থেকে নিয়ে যাবেন। তখন তিন ভাই একসাথে যাবো। ভাই বললেন, আচ্ছা। তারপর ফোন রেখে দেয়ার পর কয়েক সেকেন্ড পর ভাবী ফোন দিলেন। আমি বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে আমার রুমটা গুছিয়ে দিদির সাথে লাউশাক কুটতে বসলাম। ভাবী বললেন, নাহিন, সাব্বির তো নিজেই অসুস্থ, ও তো পারবে না মনে হয়। তুমি কি আসবা? আমি হেসে বললাম, আচ্ছা ভাবী আমি আসতেছি। মামণি তখন ফোন আমার কাছ থেকে নিয়ে বললেন, তুমি কি সগীরকে বলেছো? ওকে বললে তোমার ডাক্তার দেখাতে সুবিধা হতো না? আর নাহিনকে আমি এখনই পাঠাচ্ছি। আমি রেডি হয়ে দ্রুত রিকশায় উঠবো, এমন সময় সাব্বির ভাই ফোন দিলেন। আমি বললাম, ভাই, আমি আসতেছি ঝিলাম ভাইকে নিয়ে নামেন। সাব্বির ভাই বললেন, আচ্ছা আয়, ঝিলাম ভাইকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি রাগ করে বললাম, জেনারেল হাসপাতালে কেনো ? আমি না সিরিয়াল দিয়ে রাখছি। তখনও সাব্বির ভাই বলেন না যে, ঝিলাম ভাইয়ের শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। আমি ৩ মিনিটের মধ্যে পালবাজার পৌঁছলাম। বকুলতলার বাসায় ঢুকতেই দেখি সাব্বির ভাই সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো। আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি আয়। আমি বললাম, ঝিলাম ভাই কই? সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখি, ঝিলাম ভাই বাসার নামাজের রুমের সামনে একটা টুলে শ্বাসকষ্টে হাঁপাচ্ছেন। ভাবী ঝিলাম ভাইয়ের পিঠ ম্যাসেজ করছিলেন। পাশে ফুপি হুইল চেয়ারের দড়ি খোলায় ব্যস্ত ছিলেন । ঝিলাম ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। আমি দ্রুত হুইল চেয়ারের দড়ি খুলে পার্টে পার্টে লাগিয়ে নিচে নিয়ে গেলাম। হুইল চেয়ারটি ৩৫ কেজির মতো ভারী। দোতলা থেকে আস্তে আস্তে নামালাম চেয়ারটি। আর সাব্বির ভাইকে বললাম, ঝিলাম ভাইকে নিয়ে গেটের কাছে আসেন তাড়াতাড়ি। আমি হুইল চেয়ারটি বাইরে নিয়ে যাই। ঝিলাম ভাইয়ের নামতে কষ্ট হয়েছে অনেক। ৭ মিনিটের মতো গেটের কাছে আসতে সময় লেগেছে। ঝিলাম ভাইয়ের তখন দম নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। ভাবীকে বললাম, আপনি রেডি হয়ে আসেন, আমরা যাই। তারপর ঝিলাম ভাইকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে চৌধুরী মসজিদ ও পৌর ঈদগাহের সামনে দিয়ে দৌড়িয়ে জোরে জোরে হুইল চেয়ারটি ঠেলে জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলাম। শুধু সাব্বির ভাইকে বলছি, ভাই, আপনি শুধু রিকশা গাড়ি সাইড করেন। কারণ ঝিলাম ভাইকে রিকশা কিংবা অটোতে করে নিয়ে যাওয়ার সেই সময় ছিলো না। ওখানে বাবা সংবাদিক মানিক দাস আংকেলকে ঠিক করে রেখেছিলেন। জরুরি বিভাগে ঝিলাম ভাইকে হাই ফ্লো অক্সিজেন দিলাম, কিন্তু তারপরও ঝিলাম ভাই শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণায় টিকতে পারছিলেন না। ঝিলাম ভাই অনেক কষ্টে বললেন, অক্সিজেন কই? আমি বললাম, ভাই, অক্সিজেন চলতেছে। আমি ডাক্তারকে বললাম, আমার ভাইয়ের অক্সিজেন নিতে কষ্ট হচ্ছে, একটু অক্সিজেনটা বাড়িয়ে দিন। ডাক্তার বললেন, অক্সিজেনের মাত্রা পুরোপুরি দেয়া, আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি অক্সিমিটার দিয়ে ভাইয়ের অক্সিজেন মাপলেন, তখন তার অক্সিজেন মাত্রা ছিলো ৮০-৯০। ডাক্তার বললেন, ভালোই আছে। ডাক্তার বললেন ওনাকে ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে হবে। আমি বললাম, ওয়ার্ডে তো করোনা রোগী। ওখানে নিলে তো ভাই আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমি বললাম, ভাবী, ঝিলাম ভাইয়ের ডায়াবেটিস ফল করছেনি? আমি এটা বলার সাথে সাথে সাব্বির ভাই এবং আমি দ্রুত জুস আনার জন্যে দৌড় দিলাম। জুস আনার পর ঝিলাম ভাইকে জুস খাওয়াতে বললে তিনি খেতে চাননি। তিনি তখন বললেন, কী খাওয়াও ? তার কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই চেয়েছেন জুস এবং এক ডোক খেয়েছেন। এর মধ্যে আমি কী করবো সেটা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সাব্বির ভাই ও ভাবীকে ঝিলাম ভাইয়ের পাশে বসিয়ে বাবাকে ফোন করলাম, বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা বললেন, ঝিলামকে করোনা টেস্ট করিয়ে দ্রুত ডায়াবেটিক হাসপাতালে নিয়ে যাও, ওখানে সব রেডি আছে। বাবার কথা মতো করোনা টেস্টের জন্যে মানিক আংকেলকে ব্যবস্থা করতে বললাম। কিন্তু করোনা টেস্টের জন্যে রোগী এতোটা এসেছেন যে, সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। পরে মানিক আংকেল এবং আমি হাসপাতালের এক পরিচিত আংকেলকে বললাম। তিনি তাকে প্যাথলজিতে নিয়ে করোনা টেস্ট করিয়ে আনার জন্যে বললেন। তার কথা মতো দ্রুত হুইল চেয়ারে করে প্যাথলজিতে নিয়ে করোনা টেস্ট করালাম। একে তো শ্বাসকষ্ট, তার ওপর নাকের ভেতর তুলা ঢুকিয়ে পরীক্ষা, ঝিলাম ভাই আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাকে দেখে। আমি টেস্ট করার সাথে সাথে ঝিলাম ভাইকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে আসলাম এবং মানিক আংকেলকে অক্সিজেনসহ অ্যাম্বুলেন্স রেডি করতে বললাম। তখন ওইখানে আমার ফুফা অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার উপস্থিত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অটোতে করে নিতে। আমি তাতে বাধা দেই। আমি বলেছি, নাহ্, ভাইকে অ্যাম্বুলেন্সে করে অক্সিজেন দিয়ে নিয়ে যাবো। কারণ ভাইয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স আসতে ৭ মিনিট সময় লেগেছে। এরই মধ্যে আমি দৌড়ে দেখতে গেলাম কেনো অ্যাম্বুলেন্স আসছে না। অবশেষে অ্যাম্বুলেন্স আসার পর ভাইকে গাড়িতে উঠলাম। আমি, ফুফা, ভাবী, সাব্বির ভাই গাড়িতে উঠে পড়লেই অ্যাম্বুলেন্সটি ডায়াবেটিক হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। অ্যাম্বুলেন্সটি যেতে কিছুটা বেশি সময় লেগেছে রাস্তায় জ্যামের কারণে। ওদিকে ঝিলাম ভাইয়ের গাড়ির অক্সিজেনেও কাজ হচ্ছে না। ছটফট করতে লাগলেন। এর মধ্যে ডায়বেটিক হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে উজ্জ্বল ভাইকে ফোন করে বললাম, ভাই স্ট্রেচার রেডি করে রাখেন, আমরা এসে পড়েছি। উজ্জ্বল ভাই বললেন, সব রেডি, আসো। আমরাও চলে আসলাম হাসপাতালে। আমরা দ্রুত নেমে ঝিলাম ভাইকে নামাবো এ সময় হাসপাতালের কর্মচারী ঝিলাম ভাইকে গাড়িতে বসিয়ে অক্সিমিটার দিয়ে চেক করতে হাতের আঙ্গুলে সেটি দিলেন। তিনিই হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। অক্সিমিটার দেয়ার পর অক্সিজেনের মাত্রা শো করছিলো না। তাই অন্য আঙ্গুলে লাগানো হলো, তা-ও হচ্ছে না। সবাই বলে উঠলো, হাত নাড়তেছে, তাই হইতেছে না। আমি পাশে ছিলাম। ঝিলাম ভাইয়ের হাত ধরে রাখছি, তারপরও হচ্ছে না। আমি তখন জোরে বললাম, এগুলো পরে মাপা যাবে। ভাইয়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আগে উপরে নিয়ে যাই। স্ট্রেচারে ভাইকে আস্তে শুইয়ে দেই ধরে। তারপর ভাইকে উঠিয়ে তিন তলার শেষ রুমে নিয়ে গিয়ে ফ্লোরে স্ট্রেচারটি রাখি। তারপর ভাইকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেই। তিনি নিজেই উঠেছেন। শুধু আমি আর ডায়াবেটিক হাসপাতালের এক কর্মচারী ধরে উঠিয়ে দিয়েছি। বসানোর সাথে সাথে নার্সরা চলে আসলেন। উজ্জ্বল ভাই তখন নার্সদেরকে বললেন, ভয় পাইয়েন না করোনা টেস্ট করা হয়েছে, করোনা নেগেটিভ। তারপর উজ্জ্বল ভাই আমাকে বললেন, তুমি দ্রুত নিচে গিয়ে ভর্তি করিয়ে ফাইলটা নিয়ে আসো। আমি এতো কিছু চিন্তা না করে দ্রুত নিচে গিয়ে ভর্তির কাগজ রেডি করতে থাকি। তখন ঝিলাম ভাইয়ের কাছে ভাবী ছিলো। আমি হুইল চেয়ার ও ভর্তির ফাইল তৈরি করে ৮ মিনিটের মধ্যে যখন উপরে উঠি, সাব্বির ভাই, ফুফাসহ ওঠার সাথে সাথে উজ্জ্বল ভাই আমাকে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, তুমি ফোন ধরো না কেনো? এতো বার ফোন দিছি, তোমার ভাই নাই। আমরা তো অবাক। আমি দ্রুত দৌড়ে রুমের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, ভাবী আমাকে বলতেছে, নাহিন তোমার ভাই নাই। যাইতেছে গা। আমিও তখন ‘ঝিলাম ভাই ঝিলাম ভাই’ ডাকা শুরু করলাম। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আমি লক্ষ্য করলাম, আমার ভাই আমার চোখের সামনেই বাচ্চাদের মতো হালকা জিহ্বা বের করে ফেনার মতো থুথু বের করতেছে। আমি ঝিলাম ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন ভাবী বার বার বলতেছিলেন, তুমি কই যাও, তুমি কই যাও, যাইও না, যাইও না তুমি। আমারে আর পাগল মাইয়ারে একা রাইখা যাইও না। কিছুক্ষণ পর ঝিলাম ভাই নিস্তেজ হয়ে গেলে ভাবী আমাকে বললেন, গেছে গা তোর ভাই গেছে গা। এভাবে ঝিলাম ভাই ১১টা ৫০ মিনিটে আমার চোখের সামনে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।

তখন আমাকে এতো অসহায় লাগছিল যে, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার মতো নয়। জীবিত ভাইটাকে কয়েক মিনিটের চোখের আড়াল হতে না হতেই নিস্তেজ দেখতে হলো। আমি কী করবো, কী বলবো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। চুপচাপ এক নজরে ঝিলাম ভাইয়ের দিকে চোখের পানি ফেলে বলে উঠলাম, ভাই আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না। মাফ করে দিয়েন।

ঝিলাম ভাইয়ের এই চলে যাওয়াটাও আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। ভুলতেই পারি না। তাকে যখন জেনারেল হাসপাতালে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দৌড়িয়ে নিয়ে যাই, মনে হচ্ছিলো রাস্তা শেষই হচ্ছে না। হাসপাতালে যাওয়ার পর ঝিলাম ভাইকে শ্বাসকষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হাসপাতালের এক পাশ থেকে আর এক পাশে দৌড়িয়েছি। শিমুল আপুকে দ্রুত হস্পিটলে নিয়ে যাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারপরও আমি দুটি মানুষকে বাঁচাতে পারিনি। চোখের সামনেই হারাতে হলো দুজনকে। যাদের সাথে মৃত্যুর আগেও হাসি-খুশি স্বাভাবিক কথা বলেছি। ভাবলেই বুকটা কেঁপে উঠে। ঝিলাম ভাই ও শিমুল আপুর মৃত্যুর পর তাদের কবরের মাটিতে রাখার সময় আমি নামতে সাহস পাই নি। শিমুল আপুর সময় আমার এক ছোট ভাই বাইজিদ এবং ঝিলাম ভাইয়ের সময় আনন্দ ভাই তাদের কবরে রাখেন। আমি কাছে বসে তাদেরকে মাটিতে রাখার দৃশ্যে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম, আর আমার চোখের পানি ঝরছিলো। মহান আল্লাহ যেন তাদের কবরের আজাব মাফ করে দেন এবং আমার ভাই ও বোনকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।

উল্লেখ্য, চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ডস্থ পৌর কবরস্থানে শিমুল আপুকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, তার পাশে ঝিলাম ভাইকেও সমাহিত করা হয়েছে। জানি কবরে শুয়ে বোনের সাথে ভাই নিশ্চিতভাবে কথা বলতে পারবেন না, তবে আমরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথা স্মরণ করে তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতে পারবো।

ঝিলাম ভাইয়ের পুরো নাম কামরুল আহসান ঝিলাম। তিনি ডেলটা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির গণগ্রামীণ বীমার চাঁদপুর জোন অপারেশন সেন্টারের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর তার ছোট বোন মারজানা নার্গিস শিমুল ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সেলিম আকবরের ছোট ভাই এহসানুল কবিরের স্ত্রী। দুলাভাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়