সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাবোর্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে দুর্নীতি

রহমান মৃধা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাবোর্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে দুর্নীতি

শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আবারও ফুটে উঠেছে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা গ্রামে অবস্থিত রাণী পতিত পাবনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির নিয়োগকে ঘিরে। সদ্য এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় বিএনপির এক নেতা/কর্মী ও প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন। এটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা দুর্নীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষাখাতে দুর্নীতির এই বিস্তৃতি শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন আর কেবল জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষার এই বিপর্যয় ঠেকাতে দ্রুত, কঠোর এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, দুর্নীতির এই অব্যাহত ধারা শিক্ষাব্যবস্থাকে চূড়ান্ত সংকটের দিকে ঠেলে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হবে।

কীভাবে সংঘটিত হলো এই দুর্নীতি?

নহাটা স্কুলের সভাপতির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির যে কাহিনি উঠে এসেছে, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রের ফল।

* প্রধান শিক্ষক : দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অনিয়ম চালিয়ে গেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের অনুগতদের বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে বসিয়েছেন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

* বিএনপি নেতা ও তার বাবা : তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক প্রভাব ব্যবহার করে সভাপতির পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এই প্রক্রিয়ায় চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

* উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসার, ইউএনও ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান : তারা যথাযথ তদন্ত না করেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অভিযোগ থাকার পরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রধান শিক্ষকের পছন্দের ব্যক্তি সভাপতির পদে বসানো হয়, জনগণের অভিযোগ উপেক্ষা করা হয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষের মাধ্যমে প্রশাসনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়।

কেন এই দুর্নীতি ঘটলো?

এই দুর্নীতির মূল কারণ তিনটিÑ

১. নিয়োগ বাণিজ্য : বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ লেনদেন হয়ে আসছে।

২. সরকারি অনুদান আত্মসাৎ : বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্যে বরাদ্দকৃত সরকারি তহবিল ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

৩. বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নিয়ন্ত্রণ : প্রধান শিক্ষক নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছেন এবং যোগ্য ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে তার অনুগতদের কমিটিতে বসিয়েছেন।

এভাবে বিদ্যালয় একটি দুর্নীতির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।

রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দুর্নীতির যোগসূত্র

এই পুরো ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতার ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, স্কুল পরিচালনা কমিটিতে তার অনুসারীদের বসিয়ে স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন এবং বিদ্যালয়ের তহবিল লুটপাট করেছেন।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কি এই দুর্নীতির বিষয়ে অবগত? নাকি এই নেতা শুধুমাত্র দলের নাম ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন? যদি বিএনপি নেতৃত্ব জানতেন, তাহলে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এই প্রশ্নগুলো এখন জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

প্রশাসনের ভূমিকা : দুর্নীতি রোধের পরিবর্তে প্রশ্রয় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিলো জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের। কিন্তু তারা অভিযোগ থাকার পরও যথাযথ ব্যবস্থা নেননি।

* প্রথমে তারা তদন্তের আশ্বাস দিলেও, কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেননি।

* অভিভাবকরা দ্বিতীয়বার অভিযোগ দিলে, প্রশাসন তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।

* উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রহসনমূলক তদন্ত করে মূল অভিযোগগুলো উপেক্ষা করেন।

* বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে বিএনপি নেতার স্ত্রীকে সভাপতি করার সুপারিশ করা হয়। যখন অভিযোগ উঠলো, তখন প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু প্রশাসন উল্টো এই নেতার স্ত্রীকেই সভাপতি বানিয়ে দিলো।

শিক্ষাখাতের সার্বিক দুর্নীতি ও সংকট

নহাটা স্কুলের এই ঘটনা আসলে পুরো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রতিচিত্র। বর্তমানে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ—সব জায়গায় দুর্নীতির বিষ ছড়িয়ে পড়েছে।

এই অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছেÑএই সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী?

সমাধান ও করণীয়

শিক্ষাব্যবস্থার দুর্নীতিমুক্ত করতে নিচের পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত জরুরিÑ

১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;

* শিক্ষাখাতে দুর্নীতির জন্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে;

* বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে;

২. স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ ব্যবস্থা;

* রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে;

* সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও প্রশাসনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষা চালু করতে হবে;

* নিয়োগের প্রতিটি ধাপে ইলেকট্রনিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা :

* প্রতিটি বিদ্যালয় ও কলেজের জন্যে স্বতন্ত্র তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অবহিত করতে হবে।

৪. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর কার্যকর পদক্ষেপ :

* শিক্ষা খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়ে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে;

* দুর্নীতির শিকার শিক্ষার্থীরা যাতে নির্ভয়ে অভিযোগ জানাতে পারে, তার জন্য বিশেষ অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

৫. শিক্ষার্থীদের সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা :

* দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ জনগণকে একত্রিত করতে হবে:

* শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে সরাসরি মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়েছে। প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির শেকড় এতো গভীর যে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার হাতে ছেড়ে যাব। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছেÑআমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? নাকি এই অবস্থা বদলানোর জন্য লড়বো?

শিক্ষাখাতকে রাজনীতি ও দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করতে হলে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে, যাতে প্রশাসনের দুর্নীতি আর ধামাচাপা দেওয়া না যায়।

বাংলাদেশের শিক্ষা কি সত্যিই শিক্ষা থাকবে, নাকি এটি চিরতরে ধ্বংস হবে? সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বোর্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বাজেট ও ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। নিয়োগ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, পরীক্ষার ফলাফল ও আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনলাইন ডাটাবেজ চালু করা জরুরি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন কেবল বড়ো শহরেই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা ও সততার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতিকে ঘৃণা করে এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখে।

শিক্ষাখাত থেকে রাজনৈতিক প্রভাব ও দখলদারিত্ব সম্পূর্ণরূপে দূর করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে।

যদি এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু যদি এগুলো উপেক্ষা করা হয়, তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বোর্ডে দুর্নীতির এই চক্র অব্যাহত থাকবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।

প্রশ্ন হলোÑআমরা কি চুপ করে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে থাকবো? নাকি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো? এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

আমরা কি দুর্নীতির কাছে মাথা নত করবো, নাকি নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবো? সময় এসেছে সংগ্রামের। সময় এসেছে পরিবর্তনের।

রহমান মৃধা : গবেষক ও লেখক (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়