প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
নাম তার অর্থ। বয়স প্রায় ৮/৯ বছর। স্কুল ড্রেসের জামাটি গায়ে দিয়ে যন্ত্রদানব ট্রাক্টরের ওপর খেলা করছে। তার সাথে আরেক ছোট বন্ধুও রয়েছে। মোটরযান থামিয়ে প্রথমে একটি ছবি তোলার পর নাম জিজ্ঞেস করার পর বললো, সে ফরিদগঞ্জ বালিকা উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ‘এখানে কেনো’ এই প্রশ্নের উত্তরে সে বললো, বাড়িতে আর ভালো লাগে না, তাই খেলতে রাস্তার পাশে এসেছি। ‘স্কুল ভালো লাগে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে একটু হতচকিত হয়ে নিজের গায়ে থাকা স্কুল ড্রেসটির দিকে তাকিয়ে, একটু ভেবে বললো, ‘ভালো লাগে’, তারপর ভোঁ দৌড়। তার সাথে কথা বলার সময় সায়েম নামে আরেক শিশু ওই গাড়িটির দিকে ছুটে এলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিসে পড়ো? বললো, সে উম্মে কোরআন ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এখন প্রতিদিন তাদের ক্লাস হয়, ভালো লাগে। তবে তার বাবা নিয়ে না যাওয়ায় গত ক’দিন তার মাদ্রাসায় যাওয়া হয়নি। দুটি শিশুর স্কুলে যাওয়ার ব্যাকুলতায় স্পষ্ট, তারা ঘরে নয়, শিক্ষাঙ্গনে থাকতেই পছন্দ করে।
মায়ের সাথে ঔষধের জন্যে আসা সাহাপুর মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া জানায়, বাড়িতে ভালো লাগে না। তাই মায়ের সাথে বাজারে এসেছি। ‘স্কুলের স্যারদের কথা মনে পড়ে?’ বললো, হ্যাঁ।
জিহাদ স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। তাকে কাছে ডেকে ‘কোথায় গেলে?’ জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গেছি’। পাশে থাকা লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেনের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললো, ‘আমি এই স্কুলের ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুল বন্ধ থাকায় ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে স্যারেরা আমাদের খোঁজখবর নেয়। পড়া দেখিয়ে দেন’।
বল হাতে বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে বেলা ডুবে এমন সময় সামনে পেয়ে নাম ও স্কুলের কথা বললে সে জানায় তার নাম ইয়াছিন আরাফাত রিজভী। ফরিদগঞ্জ আদর্শ একাডেমির ৯ম শ্রেণির ছাত্র। ‘স্কুলের সময়ে খেলতে ভালো লাগছে’ এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, ‘কী করবো স্কুল বন্ধ। বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না, বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে বের হয়েছি’। ‘স্কুল খুললে ভালো লাগবে?’ এ প্রশ্নের জবাবে বললো, ‘অবশ্যই। পড়ালেখা ছাড়াও স্যার ও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা হবে, কথা হবে। এটার মতো আনন্দ আর কোথাও নেই’।
সৌপ্তিক ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের বর্ণমালা কিন্ডারগার্টেনে কেজি শ্রেণিতে পড়ছে। তাকে ‘স্কুল ভালো না বাসা ভালো’ জিজ্ঞেস করতেই উত্তর খুঁজে পেলো না। পরে বললো, স্কুলে গেলে মজা লাগে। বন্ধুদের সাথে খেলতে পারি। তার বাবা দন্তচিকিৎসক জানালো, ক’দিন পূর্বে তার চেম্বারে তার ছেলের ক্লাসের একটি শিশুকে নিয়ে এসেছিলো তার অভিভাবক। সৌপ্তিক ও সেই শিশুটি পরস্পরের বন্ধু বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়ে তার ছেলের সাথে ওই শিশুটির যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও একে-অপরকে চিনতে পারেনি। গত দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক যে আবহ তথা বন্ধুত্ব, খেলাধুলা, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিলো তা স্তিমিত হয়ে গেছে।
সৌপ্তিকের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মামুন হোসাইন জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। ভর্তির পর তার দুষ্টুমি এবং অমনোযোগিতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু ১৭ মার্চ করোনাভাইরাসজনিত কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় তিন মাসে আমি তার মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করি। প্রতিদিন স্কুলে আসার কারণে সে আগের চেয়ে মনযোগী হয়, দুষ্টুমি কম করে। স্যার বা ম্যাডামদের কাছে পড়া বলতে চেষ্টা করছে। অর্থাৎ তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। স্কুল যদি বন্ধ না হতো আমি বিশ^াস করি, সৌপ্তিক তার ক্লাসের সেরা একজন শিক্ষার্থী হতো।
করোনা আমাদের জীবন থেকে শুধু প্রায় দেড় বছর কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। খেলাধুলা থেকে বিচ্যুত শিশুরা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। হয়ে পড়ছে খিট খিটে স্বভাবের।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেরার ব্যাকুলতার কথা জানিয়ে একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, যতোই অনলাইন বলুন আর গুগলমিট বলুন, শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসে শ্রেণিশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই। করোনাকালীন হয়তোবা আমরা অনলাইনের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের এতে আগ্রহ দেখা গেলেও পরে তা অনাগ্রহে পরিণত হয়। তবে বর্তমানে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাওয়া ও জমার মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করছে। যা তাদের মানসিক শক্তিকে কিছুটা হলেও প্রশস্ত করছে।