প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০১
শিশুর মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি
বাবা-মা হলেন তাদের সন্তানের জগতের জানালা এবং তার প্রথম শিক্ষক। শিশুটি প্রায়শই তার বাবা-মাকে রোল মডেল বা "সুপারহিরো" হিসাবে দেখে এবং বড় হওয়ার পরে ঠিক তাদের মতো হতে চায়। একটি শিশুর মানসিক, শারীরিক ও মেধাবৃত্তিক বিকাশে অভিভাবকরা বিশেষত মা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। অভিভাবকত্ব একটি সর্বদা বিকশিত প্রক্রিয়া যা শুধুমাত্র শিশুর মৌলিক লালন-পালনের চাহিদা পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একজন ভাল অভিভাবক বিদ্যালয়ে এবং বিদ্যালয়ের বাইরে সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং সামাজিক দক্ষতার বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি প্রদান করেন। সত্যিকার অর্থে শিশুকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব শুধু তাদের বিদ্যালয়ের উপরই বর্তায় না। একটি শিশুর শিক্ষা শুরু হয় নিজ পরিবারে, কারণ পিতা-মাতা শিশুদের প্রথম শিক্ষক। একজন শিশুর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, অভ্যাস, মানসিক বিকাশ ইত্যাদি গঠনে পিতা-মাতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিত্ব গঠন, পরিমিতি বোধ প্রতিষ্ঠা এবং মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে শিশুদের শৃঙ্খলা, দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা শেখানোতে পিতামাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বই পড়ে শিশুরা যা অর্জন করে তার চেয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্কের কর্মকান্ড থেকে শিশুদের শেখার সম্ভাবনা বেশি, শিশুরা তাদের পিতামাতার প্রতিটি আচরণ লক্ষ্য করে এবং অনেকাংশে তা খুব দ্রুতই গ্রহণ করে।
পিতামাতারা কীভাবে শিশুদের সাথে এবং অন্যদের সাথে আচরণ ও যোগাযোগ করে তা শিশুদের সামাজিকতাকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। একইভাবে, শিশুদের সাথে পিতামাতার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতা শিশুদের মানসিক এবং মানবিক বৈশিষ্ঠগুলো গঠন করে। প্রতিটি বাচ্চার বোঝার ও গ্রহণকরার ক্ষমতা আলাদা। সন্তানের চাহিদা অনুযায়ী, পিতামাতা তাদের ছোট বাচ্চাদের বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে যা শিখেছে তা পর্যবেক্ষন করা, হোম অ্যাসাইনমেন্টে সহযোগিতা করা, শিশুদের স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করা উচিত। বিদ্যালয় এবং বাড়িতে শিশুর কার্যকলাপের উপর নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের সাধারণ অভ্যাসগুলি পড়াশোনায় ঘনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়। তাই শিশুদের সময়োপযোগী পরামর্শ দিন এবং শৈশবকাল থেকেই যেকোনো অস্বাভাবিক আচরণ সংশোধন করুন এবং তাদের সুনাগরিক হতে উদ্বুদ্ধ করুন। পিতামাতার উচিত বাড়িতে বাচ্চাদেরএকটি শান্তিপূর্ণ এবং মনোরম পরিবেশ দেওয়া। সন্তানের উপস্থিতিতে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এবং অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া করে বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করা উচিত নয়। বাবা এবং মা উভয়েরই উচিত তাদের অধ্যয়ন জীবনের গুরুত্ব বিবেচনা করা এবং তাদের পর্যাপ্ত নৈতিক সমর্থন দেওয়া। যদি লক্ষ্য করেন যে আপনার বাচ্চা ভালো ফলাফল করছে না বা পড়াশোনায় কম গুরুত্ব দিচ্ছে, তাহলে শুরুতেই তাদের সংশোধন করুন। তবে খারাপ কথা বলে তাদের মনের শান্তি নষ্ট করা উচিত নয়। ধৈর্য ধরুন এবং আপনি যদি কোন খারাপ দিক লক্ষ্য করেন তবে শুধুমাত্র গঠনমূলক সমালোচনা করুন। শুধু তাদের দোষারোপ করার পরিবর্তে তাদের সঠিক এবং ভুল কী তা বোঝান।
পরীক্ষার জন্য শিশুদের প্রস্তুত করুন, যখন তাদের পরীক্ষার সময় তখন তাদের পড়ার সময় একা রেখে যাবেন না। ভাল দিকনির্দেশনা এবং সমর্থন দিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে তাদের সাহায্য করুন। এমনকি তাদের পরীক্ষার উদ্বেগ এবং উত্তেজনা কমাতে আপনি প্রকৃত পরীক্ষার আগে বাড়িতে ছোট পরীক্ষাও নিতে পারেন। যে বিষয়ে শিশুর দুর্বলতা রয়েছে সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত সহায়তা দিতে পারেন । ভালো ফলাফলের জন্য শিশুদের পুরস্কৃত করা উচিত। একটি বাচ্চার পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করার জন্য ভালো অনুপ্রেরণা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিশুরা পরীক্ষায় কিছু ভাল ফলাফল নিয়ে আসলে তাদের পুরস্কৃত করতে দ্বিধা করা উচিত নয়। এটি শিশুদের পরবর্তীতে আরও ভাল ফলাফল করার অনুপ্রেরণা দেয়। ছুটির দিনে শিক্ষামূলক ভ্রমণে যাওয়া একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। পাঠগুলিকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করার জন্য তারা যা অধ্যয়ন করছে তার সাথে কিছু প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে এমন গন্তব্যগুলি ভ্রমণ করুন। অভিভাবক শিক্ষক সমাবেশ বা মিটিং এড়িয়ে যাবেন না। আপনার বাচ্চার জন্য শিক্ষকদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা ভাল। তাদের কাছ থেকে স্কুলে শিশুর কার্যকলাপ সম্পর্কে জানুন এবং কিছু ভুল হলে শিশুটিকে সংশোধন করতে ভুলবেন না। একটি শিশু স্কুলে কতটা ভালো করছে তা নিয়ে কথা বলার জন্য শিক্ষক হলেন সেরা ব্যক্তি। প্রায়শই, শিক্ষক শুধুমাত্র একাডেমিক দিক নয় আবেগগত এবং সামাজিক দিকগুলিতেও প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হন। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন সমস্যা থাকলে অভিভাবকদের সচেতন করা শিক্ষকদের দায়িত্ব। একটি শিশুর শিক্ষায় পিতামাতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল তাদের সন্তানদের কম বয়সে ক্যারিয়ারের সমস্ত প্রত্যাশার বোঝা থেকে মুক্ত করা এবং তাদের আগ্রহ আছে এমন একটি ক্ষেত্র বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া। এইভাবে তারা তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হবে সামগ্রিক শিক্ষার সময় তারা আনন্দের বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত কঠোর পরিশ্রম করে।
সন্তানদের কৃতিত্ব উদ্যাপন করে এবং তাদের পুরস্কৃত করে পিতা-মাতা সন্তানের শিক্ষাজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এটি তাদের আরো ভাল করতে অনুপ্রাণিত করবে এবং তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে আরো ভাল শেখার ক্ষমতা উন্নত করবে। অভিভাবকদের তাদের সন্তানের বিদ্যালয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের সন্তানের স্কুলে কীভাবে উন্নতি হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের সচেতন হওয়া উচিত। অনলাইন গ্রেডিং পোর্টাল, রিপোর্ট কার্ড, এবং স্কুলের অগ্রগতি প্রতিবেদনগুলি শিক্ষার্থীর কর্মক্ষমতা - গ্রেড, উপস্থিতি, আচরণ এবং শিক্ষকের মূল্যায়নের একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি অভিভাবকদের কাছে প্রদান করে। অভিভাবক-শিক্ষক সভা শিক্ষার্থীদের পিতামাতা এবং শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি সভা যেখানে বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের অংশগ্রহণমূক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়ার সুবিধার্থে করা হয়। বেশিরভাগ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি আছে। পিতা-মাতা-শিক্ষকবৃন্দ ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি শিশুদের শিক্ষাগত চাহিদাগুলিকে সমর্থন করে এমন প্রোগ্রামগুলি বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা পরিবার, স্কুল এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্বের বন্ধন তৈরী করে।
আধুনিক যুগে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান। শিক্ষা গ্রহণ ক্ষেত্রেও আধুনিক ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি করা হচ্ছে।। শিক্ষার্থীদেরও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে এসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার শিখতে হবে, তবে অবশ্যই সেটা হবে ভালো শিক্ষা গ্রহণ নিমিত্তে কেননা এসব ডিভাইস খারাপ কাজেও ব্যবহৃত হয়। তাই অভিভাবক কে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার্থী এসব ডিভাইস কি কাজে ব্যবহার করছে, অভিভাবকের উচিত নিজ দায়িত্বে এসব আধুনিক ডিভাইস সম্পর্কে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া। আধুনিক ডিজিটাল যুগে একজন শিক্ষার্থীর তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল, এ কথা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জন্য যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য একজন শিশুর ক্ষেত্রে। কেননা শিশু বয়সেই মানুষের দৈহিক গঠন ও বৃদ্ধি হয়। এ সময় অবশ্যই শিশুকে সুষম খাদ্য গ্রহণ ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অভিভাবককে অবশ্যই শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার, তা না হলে শিশুর পুষ্টিহীনতা, রোগ শোক, দৈহিকবৃদ্ধিতে বাধা ইত্যাদি সমস্যা হয়। পুষ্টির অভাবে শিশু দুর্বল, রূগ্ন, অপরিপক্ক হয়ে বেড়ে ওঠে এবং তারা সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে দঁাড়ায়। তাই একজন অভিভাবক কে শিশুর সঠিক ও পরিমিত খাদ্য তালিকা প্রস্তুত রাখা, সে অনুসারে খাদ্য খাওয়ানো এবং সন্তানের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অনন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। সর্বপরি আজকের শিশু আপনার, সমাজের ও রাষ্ট্রের আগামী। শিশুর যত্ন নিশ্চিত করলেই আগামীর দিনগুলো সুন্দর হবে।
শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কাজেই আদর্শ সমাজ ও উন্নত পরিবেশে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। শিশুরা কেমন করে উন্নত চরিত্র এবং আদর্শের অধিকারী হতে পারে সে বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। শিশুদের আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে না। যদি কারও চরিত্রচ্যুতি ঘটে, তবে এর কারণে সে নিজেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; বরং এ ক্ষতির প্রভাবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অকল্যাণ ডেকে আনবে। কাজেই শিশুদের চরিত্র গঠনে অভিভাবকদের সদা সচেতন থাকা আবশ্যক।
প্রত্যেক পিতা-মাতারই প্রয়াস থাকে যে, তাদের সন্তানরা যেন কোনো প্রকার কষ্ট না পায়। অন্ততপক্ষে তাদের কোনো প্রকার অভাব-অনটন না দেখা দেয়। পার্থিব সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী জীবনে সন্তানের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করলেও পরবর্তী অনন্ত জীবনে সন্তান সুখে থাক এ চিন্তা খুব কম পিতা-মাতাই করে থাকেন। অথচ এ কথা পিতা-মাতাকে সব সময় খেয়াল রাখা প্রয়োজন ছিল।
নরম কাদা মাটিসদৃশ শিশুরা শৈশবে যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তার প্রভাব তার জীবনে স্থায়ী হয়ে যায়। এ কারণে পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। এ সময় পিতা-মাতা নিজেদের ব্যক্তিত্ব দিয়ে এবং ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের প্রতিপালন করবেন।
মানব শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক কালগুলোকে সাধারণত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাগ করা যায়। যথা- শিশুকাল, কিশোরকাল এবং যৌবনকাল। সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকাল ধরা হয়। এ সাত বছর শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন অর্থাৎ এ সময়ে সে যা কিছু তাই করবে।
এভাবে শিশু প্রথম সাত বছর কাটিয়ে দ্বিতীয় সাত অর্থাৎ আনুগত্য ও আদেশ পালন করার পর্বে উপনীত হবে। এ পর্বে শিশুকে আর স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া হবে না। বরং তাকে পিতা-মাতা বা অন্য গুরুজনদের কথা মেনে চলতে হবে। এ সময় থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত যদি একটি শিশু যথাযথভাবে বেড়ে ওঠে, তাহলে তৃতীয় সাত বছর অর্থাৎ একুশ বছর বয়সকাল পর্যন্ত শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সংসার পরিচলনায় পিতা-মাতার একজন যথার্থ সহযোগী।
লেখক : রাশেদা আতিক রোজী, ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, হাজীগঞ্জ, চঁাদপুর।