প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৫
ফরিদগঞ্জে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা!
‘সিআইপির অভ্যন্তরীণ নদী ও খাল দখলের মহোৎসবেই এমন জলাবদ্ধতা’
এ বছর আগস্ট, বাংলা ভাদ্র মাসে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে চাঁদপুরে। টানা ২৪ ঘণ্টা আড়াইশ’ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এমন বৃষ্টিতে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প (সিআইপি) বেড়িবাঁধের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। সেখানে জলাবদ্ধতায় পুরো বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করে। চাঁদপুর জেলার মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলায় এবার স্মরণকালের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ভাদ্র মাসে সাধারণত এতো বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তারপরও ১৮ আগস্ট রাত থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়। কখনো ১/২ দিন টানা, আবার কখনো থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টি ছিলো স্মরণকালের রেকর্ড। বৃষ্টিতে গোটা উপজেলার কোথাও বুক সমান, কোথাও কোমর সমান, আবার কোথাও হাঁটু সমান পানি জমে যায়। ডুবে যায় রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর, মাছের ঘের, পুকুর এবং ফসলসহ ফসলি জমি। হাজার হাজার মানুষ হয়ে পড়ে পানিবন্দি। যাদের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে তারা বাধ্য হয়ে সরকার ঘোষিত আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ হয়েছে যে, প্রশাসন উপজেলাজুড়ে ২৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলতে বাধ্য হয়েছে। ২৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্ট বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি মানুষ। দীর্ঘ প্রায় মাসখানেক জলাবদ্ধতার কষ্টে ছিলো ফরিদগঞ্জের মানুষ। পানি যখন কমতে শুরু করে তখন ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দৃশ্যমান হতে থাকে।
|আরো খবর
এমন বৃষ্টিতে মাছের ঘের, ঝিল, খাল, নদী, পুকুর ভেসে যায়। এতে মাছ চাষীদের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগও ভেসে যায়। ভেসে যায় অসংখ্য মানুষের স্বপ্নও।
মাছ উৎপাদনে ফরিদগঞ্জ উপজেলা দেশের মধ্যে চতুর্থ। তার মানে এই উপজেলায় কী পরিমাণ মাছ চাষ হচ্ছে এবং কী পরিমাণ অর্থ মাছ চাষে বিনিয়োগ হয়েছে বা হচ্ছে তা অনুমান করা যায়।
মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চাষকৃত জমি মোট ২,৬৯৫ হেক্টর। ৪/৫ দিনের অতিবর্ষণের কারণে বেড়ির ভেতরে প্রায় ৭শ' হেক্টর জলাশয়ের মাছ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৯ কোটি টাকা। যারা মাছ চাষের সাথে জড়িত তাদের ভাষ্যমতে, এ ক্ষতির পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার সমপরিমাণ হবে।
কৃষকের রোপণকৃত আউশ, আউশের বীজতলা, আখের ক্ষেত, বিভিন্ন জাতের শাক সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত শ্রাবণ মাসের শেষে এবং ভাদ্রের শুরুতে আউশ ধান লাগানো হয়। ঠিক সে সময়ই হয়েছে জলাবদ্ধতা। বীজতলা বা রোপণকৃত চারা উভয়ই নষ্ট হয়ে গেছে। সময় নষ্ট হয়েছে প্রায় মাসখানেক। এ সময়ে স্বাভাবিক যে বীজ তা পুনরায় ব্যবহার করে ফল পাওয়া যাবে না বলে কৃষিবিদদের মত। সে ক্ষেত্রে আমন বিনা ১৭ জাতের বীজটি লাগাতে হবে বলে মত দেন কৃষিবিদরা। তারা জানান, এটা ১শ' দিনের মধ্যে ফল দেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ বীজটি সহজলভ্য নয়। সরকারিভাবে এবং ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম সংগঠনের মাধ্যমে যেটুকু ধানের বীজ দেয়া হয়েছে তাতে শতভাগ চাহিদা পূরণ হয়নি। তার ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ের স্বল্পকালীন বৃষ্টিতে আবার জলাবদ্ধতা হয়। যে ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে তাতেও শতভাগ চারা গজায়নি। জলাবদ্ধতায় শাকসবজিও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, আউশ ধান ৪৫ হেক্টর, রোপা আমনের বীজতলা ৯১ হেক্টর, রোপণকৃত আমন ৩১২ হেক্টর, বিভিন্ন জাতের গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ৬৯ হেক্টর ও আখ ১৩ হেক্টরসহ মোট ৫৩০ হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৩০ লাখ ২২ হাজার টাকা।
ক্ষতি এখানেই শেষ নয়। রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা রাস্তার মাটি ক্ষয় হয়েছে। সলিং রাস্তার মাটি সরে যাওয়াতে ইট সরে গেছে। পাকা রাস্তার কার্পেটিং নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে অনেক বড়ো বড়ো গাছ পড়ে গিয়ে রাস্তার অংশে গর্ত হয়েছে। পানির স্রোত রাস্তার যে পাশ দিয়ে নেমে গেছে সে অংশ ভেঙ্গে গেছে। উপজেলা প্রকৌশল অফিস ৩১ আগস্ট পর্যন্ত যতটুকু পরিমাপ করতে পেরেছে, তাতে উপজেলার প্রায় ৭০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তবে এ হিসাব আংশিক। কারণ তখন পর্যন্ত সকল রাস্তা দৃশ্যমান হয়নি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ অঞ্চল সিআইপি বাঁধের ভেতরে। এ কারণে এখানে বন্যার পানি বাঁধভাঙ্গা ছাড়া প্রবেশের সুযোগ নেই। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় উপজেলাবাসীকে অতিবৃষ্টি হলে পানির নিচে থাকতে হয়। এ অবস্থার জন্যে একশ্রেণীর দখলদারদের নদী ও খাল দখলের মহোৎসবই দায়ী। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, এভাবে যদি নদী, খাল, হালট, জলাশয় ভরাট এবং দখল হয়ে যায়, অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য বড়ো বড়ো শহরের মতো গোটা ফরিদগঞ্জ জলাবদ্ধতায় ডুবে যাবে। সেই আশঙ্কা ২০২৪ সালে বাস্তবে দেখতে পেলো উপজেলাবাসী। প্রকৃতি যেনো চপেটাঘাত করে জানিয়ে দিলো, ‘তোমরা (মানুষ) যদি পরিশুদ্ধ না হও ভবিষ্যতে এরকম আরো জলাবদ্ধতার জন্য প্রস্তুত থাকো’।
উপজেলাবাসী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সিআইপির অভ্যন্তরীণ বিশেষ করে ফরিদগঞ্জ উপজেলার খালগুলো আস্তে আস্তে অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কর্তৃপক্ষসহ কারোরই নজর নেই। খাল দখল তথা ভরাট হলে অশান্তি বাড়বে সর্বসাধারণের। খাল বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, ফরিদগঞ্জ বাঁচবে। খালগুলো দখল হয়ে গেলে ওয়াপদা তথা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বা উপজেলা প্রশাসন ফরিদগঞ্জের কিছু যাবে আসবে না। কারণ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা আজ আছেন কাল চলে যাবেন। সে অর্থে তাদের কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না। ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া অথবা অশান্তির পুরোটাই এ অঞ্চলে বসবাসকারী এবং পরবর্তী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। অবাধ দখলদারিত্বের মাধ্যমে আমরা নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি।
সিআইপির ১০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দ্বারা সংরক্ষিত চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার ৫৭ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে ডাকাতিয়া নদীর দুই পাড়ে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বিস্তৃত। এর মধ্যে চাঁদপুর জেলার অংশ ৩১,৩০০ হেক্টর। এই বাঁধের চাঁদপুর জেলার অধিকাংশই ফরিদগঞ্জ উপজেলার। ১৯৬৫ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও ২ দফায় কাজ বন্ধ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় কাজ শুরু করে ১৯৭৮ সালের জুন মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
এক সময় ফরিদগঞ্জে জালের মতো ছড়িয়ে ছিলো বহু খাল। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অবহেলায়, নজরদারির অভাবে বহু খাল দখল হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দু-একটি স্থানে নদী এবং খাল দখলমুক্ত করা হলেও আবারও দখল চলতে থাকে। মূলত প্রভাবশালীরা এসব খাল দখল করছে। তারা পরিবেশ পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় আনছেন না। এটাও ভাবছে না যে, সবার দুর্ভোগ মানে তাদেরও দুর্ভোগ। উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নেই খাল ও নদী দখল হচ্ছে। এ যেনো খাল দখলের মহোৎসব। প্রতিযোগিতা দিয়ে খাল এবং নদী দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার বহুতল ভবনও করছে। এ যেনো জোর যার মুল্লুক তার। সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের সর্বোচ্চ প্রদর্শন চলছে ফরিদগঞ্জে। অধিকাংশ স্থানে দোকানঘর করা হয়েছে। কেউ কেউ খাল দখল করে নামাজের স্থানও গড়ে তুলেছে। বিষয়টি কতটুকু ধর্মীয় দিক থেকে সঠিক হচ্ছে তা চিন্তা না করেই গড়ে তোলা হচ্ছে এসব স্থাপনা। আবার কেউ কেউ ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে নামাজের স্থান, পরবর্তীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এ দৃশ্য উপজেলাজুড়ে। বিশেষ করে চান্দ্রা বাজার, সেকদী, বালিথুবা বাজার, বাশারা বাজার, লক্ষ্মীপুর চৌরাস্তা, আনন্দ বাজার, কামতা বাজার, আষ্টা বাজার, গল্লাক বাজার, খাজুরিয়া বাজার, চৌরাঙ্গী বাজার, পাইকপাড়া চৌরাস্তা, আমিরা বাজার, বটতলী, দায়চারা, গোয়ালভাওর বাজার, আলোনিয়া গুদাড়াঘাট, ফিরোজপুর বাজার, বিরামপুর বাজার, গলাকাটা বাজার, কালিরবাজারে দেখা যাচ্ছে বেশি। মোট কথা উপজেলার এমন কোনো স্থান নেই যেখানে খাল দখল হয়নি। উপজেলাবাসীর দাবি, এখনই সময় দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করা। গাব্দেরগাঁও গ্রামে চতুরা খালের সাথে সংযোগ খালটির কিছু অংশ সম্পূর্ণ ভরাট করে ফেলেছে দখলদার দুর্বৃত্তরা। খালের দুই অংশ ভরাট করে মাঝখানে সরু কালভার্ট করে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এ রকম একাধিক কালভার্ট রয়েছে উপজেলাজুড়ে।
ফরিদগঞ্জে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকা। এ উপজেলায় এমনিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতার ফলে ধানী জমি, পুকুর, জলাশয় ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টির পানির ধারণ ক্ষমতা দিনকে দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। খালগুলোতে নিয়মিত মাটি না কাটাতে পলি জমে জমে খালের গভীরতা কমে যাচ্ছে। এছাড়া খালের দুই পাড় কখনোই পরিষ্কার করা হয় না। ফলে দুই পাড়ে তৃণলতা এবং গাছ গজিয়ে উঠে পানির প্রবাহ ক্ষমতাকে নষ্ট করছে। সচেতন মহলের মতামত হচ্ছে, যেখানে নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে, দ্রুত সে বাঁধ কেটে দিতে হবে। কচুরিপানা অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাঁধ সৃষ্টি করে মাছ চাষ করা যাবে না। প্রয়োজনে উপজেলার সামাজিক সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। বর্তমানে উপজেলায় অঞ্চল ভিত্তিকও সামাজিক সংগঠন রয়েছে। খাল পরিষ্কার এবং খননের কর্মসূচি হাতে নিলে জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচানো যাবে উপজেলাকে।