প্রকাশ : ১৯ মে ২০২২, ০০:০০
বিশ্বের ২য় সেরা প্রধানমন্ত্রী, সৎ সরকার প্রধান হিসেবে শীর্ষ তিনজনের অন্যতম, বিশ্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবচেয়ে বিচক্ষণ নেতা, পঞ্চাশ নম্বর পেয়ে বিশ্বের ৫ম শীর্ষ নেতা, জাতির অহঙ্কার, বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা নারী সরকার প্রধান হিসেবে বিশ্বে রোল মডেল। বিশ্বের ১০০ শীর্ষ চিন্তাবিদের তালিকায় ইতোপূর্বে তাঁর অবস্থান ছিল ১৩তম। এছাড়াও জাতিসংঘের উঁচু পর্যায়ের প্যানেলেও রয়েছেন তিনি। গত বছর ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ বছরসহ ১৪ বছর তিনি বাংলাদেশ শাসন করেছেন। এটা কেবল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যে গৌরবের নয়, এ গৌরব বাংলাদেশের জনগণেরও। কারণ শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯ বার হত্যার হুমকি ও নানা ষড়যন্ত্রকে সামাল দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, করে আসছেন।
খ্যাতনামা মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজ উইকে’ প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটে ‘সত্যিকার’ বীর নারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ অনেক ধনী ও প্রভাবশালী নেতাদের পেছনে ফেলেছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছোটবোন শেখ রেহানাসহ দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। দীর্ঘ ৬ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরণার্থীদের মত জীবন অতিবাহিত করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে প্রিয় মাতৃভূমিতে ‘ঝড়ের আকাশে শান্তির কপোত’ হিসেবে ফিরে আসেন। প্রিয় মাতৃভূমি ও জনগণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ২১ বছরের (১৯৭৫-১৯৯৬) ভয়াবহ অতীত, ২০০১-২০০৭ এবং জরুরি অবস্থায় (২০০৮-২০০৯) দুই বছর বাদে মাত্র দুই মেয়াদে ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৩ শেখ হাসিনার সরকার এদেশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই বিরল। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর চতুর্থবারের মতো দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০০৯ সালের যে স্বপ্ন সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তব। হয়তো বিরোধীরাও সেটা নিয়ে আগের মত হাসি-ঠাট্টা আর তামাশা করে না। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দেশরত্ন শেখ হাসিনার এদেশে জন্ম না হলে কি আমরা এতো উন্নয়ন পেতাম? দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মনে রাখবে এমন উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিস্ময়কর মুদ্রা রিজার্ভ, পদ্মাসেতু নির্মাণ, বিনামূল্যে মাধ্যমিকে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ (সমমানসহ), উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গঙ্গাচুক্তি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি, স্থল সীমান্ত চুক্তি, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয় ইত্যাদি। আমার দৃষ্টিতে নিকট অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ৫টি চুক্তি, বিজয় বা ঘটনার উল্লেখ করছি।
(১) গঙ্গা চুক্তি, ১৯৯৬ : ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়া দিল্লীতে হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৩০ বছর মেয়াদকালের জন্য পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য এবং স্বাক্ষরদানের পর কার্যকর হবে এই মর্মে বাংলাদেশের পক্ষে শেখ হাসিনা আর ভারতের পক্ষে এইচডি দেবগৌড়া চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। উভয় দেশের জন্যে চুক্তিটি ছিল অপরিহার্য। যার মাধ্যমে গঙ্গার পানি বন্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গৃহীত নদীর পানি বন্টন সম্পর্কিত এটিই প্রথম চুক্তি। গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি শেখ হাসিনা সরকারের অসামান্য কূটনৈতিক সাফল্য।
(২) পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ১৯৯৭ : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাঞ্জাবী শাসকরা বাঙালির চেয়েও আদিবাসীদের বেশি নির্যাতন করেছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ রিপোর্ট প্রকাশিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। ২১ আগস্ট পাকিস্তানী সৈন্যরা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে গিয়ে ভারতীয় ও বার্মার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময় কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে একলাখ আাদিবাসীকে স্থানচ্যুত করা হয়। কাপ্তাই হ্রদের নিচে হারিয়ে যায় চাকমা রাজার প্র্রসাদ। কিছু সংখ্যক চাকমা অরুণাচলে আশ্রয় নেয়, আবার দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। যুগের পর যুগ পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা তেরটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর ধারাবাহিকভাবে হত্যা, নির্যাতন, শোষণ, উৎখাত ও বঞ্চনাজনিত মানবাধিকার লংঘনের জন্যে বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। অশান্ত পাহাড়ি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি যেন না ঘটে সেই জন্য সরকার সেখানে পুলিশ, বিডিআরের পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি কমিটির বিরোধ আরও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে শেখ হাসিনা সরকার সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বল প্রয়োগের পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ফলস্বরূপ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় পার্বত্য শান্তি চুক্তি। এই চুক্তির ফলে পাহাড়ি তিন জেলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পাহাড়ী বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র সমর্পণ করে। ফলে দীর্ঘদিন পর এ তিনটি জেলায় শান্তি ফিরে আসে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার জন্যই চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়েছে।
(৩) সমুদ্র সীমা বিজয়, ২০০৯ : যে কোনো বিজয় আনন্দের। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম বিজয়ের আনন্দ অনেকবারই এসেছে। তার সাথে যুক্ত হয় আরেকটি ব্যতিক্রমী বিজয় তখা সমুদ্র বিজয়। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এদেশে দুটি মাইলফলক যুক্ত হয়েছে। প্রথমটি ২০১২ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়। দ্বিতীয়টি ৭ জুলাই ২০১৪ নেদারল্যান্ডের স্থায়ী সালিসি আদালতে ভারতের বিপরীতে বাংলাদেশের বিজয়। বাংলাদেশ ১ লাখ ১১ হাজার বর্গমাইল পর্যন্ত সমুদ্র সীমা অধিকার এবং ১৮টি ব্লকের মালিকানা পায়।
(৪) স্থলসীমান্ত চুক্তি ২০১৫ : ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ। এ ইতিহাস সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব আর মানবতার ইতিহাস। ৬৮ বছর ধরে যাদের রাষ্ট্র ছিল না, ছিল না পরিচয়, সবাই যাদের চিনতো ছিটবাসী হিসেবে, তারা তাদের জাতীয়তার পরিচয় পেয়েছেন। নাগরিকত্বের পরিচয় দেবে গর্বে বুক ফুলিয়ে? ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটলো। বেশ ভিন্ন রূপে হলেও এগুলো যেন হয়ে ছিল বাংলার ফিলিস্তিন। বাংলাদেশের মূল খণ্ডে ছিটমহলবাসীর বন্দী জীবন নিয়ে রাজনীতির পাশা খেলার যবনিকাপাত ঘটলো। জয় হলো মানুষের। মুছে গেলো রাষ্ট্রহীনতার কষ্ট। বাংলাদেশ পেল ১১১টি আর ভারত পেল ৫১টি ছিটমহল।
(৫) রোহিঙ্গা সংকট, ২০১৭ : একদিকে মানবতা অন্যদিকে বর্বরতা। আজ তা কথায় নয় বাস্তবে প্রমাণিত। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অর্থাৎ আরাকান ছেড়ে আসা বাঁচার জন্য ক্রন্দনরত শিশু, অসহায় বৃদ্ধ, অজানা আতঙ্কে উৎকণ্ঠিত যুবতী, অশ্রুসিক্ত নারী, সম্বলহীন পুরুষদের বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে আশ্রয়ের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে যিনি বিশ্ব দরবারে মানবিকতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব নেতাদের মধ্যে কেউ বলেছেন, বিশ্ব মানবতার বিবেক, বিশ্ব মানবতাবাদী নেত্রী, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, মানবতার জননী। বাঙালির হৃদয় যে কত বড় তা তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশ অত্যন্ত ছোট এবং ঘনবসতিপূর্ণ। আমাদের ভূখণ্ডের জনসংখ্যার তুলনায় কমতি বা ঘাটতি আছেই। কিন্তু এর পরেও আমাদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে এতোটুুকুও কার্পণ্য করেন নি। বিশ্বে যারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, জানি না তারা কত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন বা শান্তির পক্ষে কাজ করেছেন। সংঘাত বা রক্তপাত এড়িয়ে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, অশান্ত একটি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বিনিময় করা বা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রের পানি বন্টনের বিরোধ নিষ্পত্তি করাসহ কত না কাজই তিনি সম্পন্ন করেছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান একটি জটিল বা অলৌকিক কাজ হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা যেন অতি সহজতর। আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কার যারা প্রদান করেন সেই কমিটির কাছে জানতে ইচ্ছে করে, আর কী কাজ করলে নোবেল পুরস্কার পাবেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, [email protected]